নাটক বিনোদনের মাধ্যম হলেও তা কখনো কখনো হয়ে ওঠে প্রতিবাদের হাতিয়ার। এই কাজটাই করেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ সরকার। যিনি থিয়েটার জগতে বাদল সরকার নামে পরিচিত। খানিকটা শখের থিয়েটার থেকে যাত্রা শুরু হলেও পরে তাঁর হাত ধরে জন্ম নেয় এক নাট্য দর্শনের।
গণসস্কৃতি আন্দোলনের একজন পুরোধা কর্মী হয়ে ওঠেন এবং জীবনে শেষদিন পর্যন্ত থিয়েটারকে গণসস্কৃতির এক ধারালো অস্ত্র হিসেবে শান দিয়ে গেছেন। চাকরির সূত্রে বিভিন্ন দেশবিদেশ ঘুরেছিলেন। তার ফলে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা ও থিয়েটার খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। ইউরোপে থাকাকালীন বিভিন্ন ধরনের নাটক দেখার সুযোগ পান । যা তাঁর উপর গভীর প্রভাব ফেলে। পরবর্তীকালে যা তাঁর নাট্যদর্শনে এক নতুন বোধের জন্ম দেয়। যার উন্মেষ ঘটতে দেখা যায় তাঁর রচিত বিভিন্ন নাটকে।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি তাঁর নাটক "এবং ইন্দ্রজিৎ" সাড়া ফেলে বাংলা তথা ভারতের নাট্য জগতে। একের পর এক নাটক বেরিয়ে আসতে থাকে তাঁর কলম থেকে। " পাগলা ঘোড়া", "বাকি ইতিহাস" বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত এবং অভিনীত হতে থাকে।
সাতের দশকে শহরাঞ্চলে, মফস্বলে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের চর্চা চলছিল। যা এখনও চলে। নাটকের মাধ্যমে যে বক্তব্য রাখা হচ্ছিল তা শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছিল। গ্রামাঞ্চলে বা সাধারণ মানুষের মধ্যে সেভাবে পৌঁচ্ছচ্ছিল না। ফলে থিয়েটারে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ঘটছিল না বা বলা যায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে একটা দূরত্বের সম্পর্ক থেকে যাচ্ছিল। এই বিষয়টি তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
সেই সময় বাদল সরকার অন্য ধরনের থিয়েটারের কথা ভাবেন। সেই ভাবনাকে বাস্তবে রূপদানের জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেন। সঙ্গী হিসেবে কিছু মানুষকে সঙ্গেও পেয়ে গেলেন। প্রয়োজন পড়ল নাটককে নির্মেদ ও বহনযোগ্য করে গড়ে তোলার। যা সহজে পৌঁছে যাবে গ্রাম, মফসসলের সাধারণ মানুষের কাছে। ট্রেনে, বাসে, সাইকেলে, মাঠে-ময়দানে অভিনয় করে ঘুচিয়ে ফেলা হল দর্শক এবং অভিনেতার মধ্যের দূরত্ব।
জন্ম নিল নতুন ধারার থিয়েটারের। বাদল সরকার নাম দিলেন "থার্ড থিয়েটার"। তৈরি হল "মিছিল", " ত্রিংশ শতাব্দী", "বোমা", "পিকাদান"। দলের নাম দিলেন " শতাব্দী"। তাঁর "শতাব্দী" ঘুরতে থাকল গ্রাম থেকে মফসসলে। দর্শকের সঙ্গে তৈরি হল নিকট সম্পর্ক। "শতাব্দী" দোসর হিসেবে পেল কাঁচরাপাড়ার " পথসেনা" এবং বেহালার " আয়না"কে।
শিয়ালদার লরেটো স্কুলে নিয়মিত নাট্যচর্চা হতে লাগল। প্রতি তিনমাস অন্তর দুদিনের নাট্যোৎসব চলল। নন্দন চত্বরে মাসের প্রথম ও তৃতীয় রবিবার হল থিয়েটারের প্রর্দশন। থার্ড থিয়েটার এক নতুন দর্শনের জন্ম দিল। এছাড়া গ্রামের মানুষের কাছে থিয়েটারকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য করা হল "গ্রাম পরিক্রমা"।
বর্তমানে কল্যাণীর "রক্তকরবী" মঞ্চে এবং "নিরঞ্জন সদনে" থার্ড থিয়েটারের নিয়মিত অভিনয় হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষের মধ্যে থিয়েটারকে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস এখন অব্যাহত। থিয়েটারকে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ফ্রেমের বাইরে, প্রেক্ষাগৃহের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বাদল সরকার আজীবন করেছিলেন। এখন তাঁর দল "শতাব্দী" এবং আরো অনুগামী দল আজও সে কাজ করে চলেছে।