পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বাবরি মসজিদ এবং…

  • 06 December, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1218 view(s)
  • লিখেছেন : মেহফুজ আলম
এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে বাবরি মসজিদের ধ্বংসের পরে এর গুরুত্ব কোথায় দাঁড়িয়েছে? শুধুই মুষ্টিমেয় কতগুলি সংগঠনের প্রতিবাদ সভা আর দৈনিক সংবাদপত্রে এবং ওয়েবজিনে দু কলম লেখা, এতেই কি আমাদের যাবতীয় বক্তব্য আবদ্ধ হয়ে থাকছে?

বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার কিছুদিন পরের কথা। দেশে তখন দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে আনাচে কানাচে। কলকাতার কাছে একটি জেলাশহরে গ্রাম থেকে এসে বাসে চেপেছেন এক সংখ্যালঘু ভদ্রলোক। তার মাথায় ফেজ টুপি, গালে দাড়ি। খানিক পরে বাসে তার সামনে এগিয়ে এলেন এক সংখ্যাগুরু ভদ্রলোক। আলগা করে দাড়িতে হাত বুলিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে সেই সংখ্যাগুরু ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন,

“কি মিয়াঁ, আর কদ্দিন এই দ্যাশে?”

সংখ্যালঘু ভদ্রলোক এই আচমকা ঘটনায় কেঁপে গেলেন। বাস ভর্তি সংখ্যাগুরু ভদ্রলোক। অনেকেই শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে।

এই ঘটনার তিরিশ বছর পরে সেই সংখ্যালঘু ভদ্রলোক যখন এই ঘটনার স্মৃতিচারণা করছেন, তখন জানিয়েছিলেন যে তার কিরকম অচেনা মনে হচ্ছিল এতদিনের চেনা রাস্তাটা কে।

বাবরি মসজিদ। এই শব্দটা গত তিরিশ বছরে হয়ত ভারতীয় ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত শব্দ। ১৫২৮ সালে মীর বাকি মুঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে অযোধ্যাতে যে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাই কালেক্রমে বাবরি মসজিদ নামে খ্যাতি পায়। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর করসেবক দের হাতে ধ্বংস হবার আগে এবং পরে ভারতীয় রাজনীতির ক্রমবিবর্তনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৮৮৫ সালে মোহন্ত রঘুবীর দাস তার পুজো করার আবেদনের মাধ্যমে যে ধর্ম-রাজনীতির সূচনা করেন, ১৯৯২ সালে লালকৃষ্ণ আদবানীর হাতে তা পূর্ণতা পায়। হিটলার আর মুসোলিনীর অনুগামী হিন্দুত্ববাদী শক্তি তাদের ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির অন্যতম পাথেয় হিসেবে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা আন্দোলন কে কাজে লাগিয়েছে।

প্রশ্নটা হচ্ছে যে এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে বাবরি মসজিদের ধ্বংসের পরে এর গুরুত্ব কোথায় দাঁড়িয়েছে? শুধুই মুষ্টিমেয় কতগুলি সংগঠনের প্রতিবাদ সভা আর দৈনিক সংবাদপত্রে এবং ওয়েবজিনে দু কলম লেখা, এতেই কি আমাদের যাবতীয় বক্তব্য আবদ্ধ হয়ে থাকছে?

২০০৪ সালে নোবেল জয়ী লেখক ভি এস নইপাল দিল্লীতে বিজেপি অফিসে এসে বলেছিলেন, ‘“Ayodhya is a sort of passion. Any passion is to be encouraged. Passion leads to creativity." ভি এস নইপালের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ নতুন তথ্য নয়। কিন্তু এই ধারণা শিক্ষিত হিন্দুর মধ্যে ভারতবর্ষে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সাবিত্রীবাই ফুলে ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুহাস পালসিকর তার এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে বাবরি মসজিদের ধ্বংসের পর ভারতীয় নাগরিক সমাজ সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে। এমনটা নয় যে নেহরু পরবর্তী সময়ে ভারতীয় সমাজে সংখ্যাগুরুর প্রভাব ছিল না। কিন্তু তার কোথাও একটা সীমা টানা ছিল। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর এই মুখোশ টা আর রাখার কোনো প্রয়োজনীয়তা ভারতীয় সংখ্যাগুরু নাগরিক সমাজের ছিল না।

বাবরি মসজিদ ধ্বংস ভারতীয় সমাজের মানসিকতার পরিবর্তনে উল্লেখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। আমরা সাধারণতঃ ভারতীয় সমাজে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার গুরুত্ব বৃদ্ধিতে বিজেপির ভূমিকার কথাই উল্লেখ করে থাকি। কিন্তু এক্ষেত্রে কংগ্রেসের ভূমিকাও কিছু কম ছিল না। তারা নরম হিন্দুত্বের তাস খেলতে চেয়েছিল মুসলিম দের রক্ষণশীল অংশ দের কাজে লাগিয়ে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি হিন্দুত্বের রথের জয়যাত্রার জন্যে বিজেপি অনেক নির্ভরযোগ্য অস্ত্র ছিল তাদের চেয়ে।  বাবরি মসজিদ ধ্বংস ভারতের সোসাল ফ্যাব্রিক কে বিনষ্ট করে দিয়েছিল। ভারতীয় রাজনীতিতে জাতপাতের আধিপত্যের জায়গায় ধর্ম অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিতে শুরু করে।

বাবরি মসজিদ ধ্বংস ভারতীয় সমাজের দুটি উল্লেখ্য ঘটনার সূচনা ঘটায়। প্রথম তো অবশ্যই, ধর্ম রাজনীতির আধিপত্য। এবং দ্বিতীয়টি হল, রাম জন্মভূমি আন্দোলন কে ঘিরে বিজেপি’র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ। বিজেপি তাদের রাজনৈতিক জনভিত্তি যোগাড় করে ফেলে। এবং রামরাজ্যের শ্লোগান কে সামনে রেখে বিজেপি তাদের ভব্যিষত পলিটিক্যাল এজেন্ডাও স্থির করে। এবং এই সময় কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে বোফর্স কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছিল।সেই মুহুর্তে বিজেপির রামরাজ্যের সুশাসনের প্রতিশ্রুতি সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত জনমোহিনী হয়ে উঠেছিল।

এতো গেল নেহাতই তাত্ত্বিক দিক। আম আদমি, যাকে ম্যাঙ্গো পিপল বলে অভিহিত করা হয় তাদের জীবনে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অভিঘাত টা ঠিক কোথায়? বহুগুণা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংকের স্নাতক স্তরের ছাত্র পরবর্তীকালে উগ্র হিন্দুত্বের রাজনীতির অন্যতম মুখ হয়ে উঠবেন, এটাই কি তাহলে ফলাফল?

হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত বরাবরই নড়বড়ে ছিল। বিজয়ী আর বিজিতের মিলন কোনো কালেই ঠিকভাবে হয় নি। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে নিকটবর্তী প্রতিবেশী দেশ ধর্মের আদলে থাকলেও, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘকাল নির্দিষ্ট কোনো ধর্মীয় পরিচয় থেকে নিজেকে অফিসিয়ালি মুক্ত রাখতে পেরেছিল। যদিও এটা নিয়ে নিশ্চয়ই তর্ক থাকবে। সংস্কৃতি তে সংখ্যাগুরুর আধিপত্য এবং ধর্মীয় অনুষঙ্গকে সংস্কৃতির মধ্যে মিশিয়ে নেওয়ার প্রবৃত্তি সহজাত। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার সরকারে পদাধিকারী কোনো ব্যক্তি পোশাক দেখে সন্ত্রাসবাদী চিনতে চান নি বা সরকারী মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘৃণার রাজনীতির প্রোপাগান্ডা করেন নি।

বাবরি মসজিদ ধ্বংস থেকে শুরু করে দেওয়ালির দিনে সরকারী খরচে যোগী আদিত্যনাথের প্রদীপ প্রজ্বলন, সবই আদতে একটি  দীর্ঘ সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক যাত্রা। Thomas Blom Hansen লিখেছেন যে বাবরি ধ্বংসের পরে ভারতে মুসলিমদের যাবতীয় পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে ছাপ দেওয়া হতে শুরু করে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল নাজি জার্মানীতে ইহুদীদের সাথে। নাজি জার্মানীতে শিক্ষিত জার্মান রা অনেকেই হিটলারের নীতিকে সমর্থন করতেন। যারা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানিয়েছিলেন, যারা সেখানে অত্যাচার চালাতেন, তারা কেউ ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা ডাক্তার। হিটলারের ইহুদী-নিধন তত্ত্ব কে জাস্টিফাই করার জন্যে শিক্ষিত জার্মান রা সিনেমা বানিয়েছিলেন, বই লিখেছিলেন, ছবি এঁকেছিলেন।

এখনকার ভারতের সাথে কি আমরা এখনও মিল পাচ্ছি না?

ফ্রিজে নিষিদ্ধ মাংস আছে সেই অজুহাতে অনায়াসে এই নতুন ভারতে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়। গোরক্ষার অভিযোগে সংখ্যালঘুদের পিটিয়ে পুড়িয়ে মেরে জাস্টিফায়েড হয়ে গেছে। গণতন্ত্রের পীঠস্থান পার্লামেন্টে নির্বাচিত সংখ্যালঘু জনপ্রতিনিধি কে তার ধর্মীয় পরিচয় তুলে গালাগাল দেওয়া যায়। নতুন ভারতে উচ্চবর্ণের লোক নিম্নবর্ণের মানুষের উপর প্রকাশ্যে প্রস্রাব করতে পারে। ধর্মীয় বিদ্বেষ কে সুড়সুড়ি দিতে প্রোপাগান্ডামূলক সিনেমা বানানো হয়। হাফ-বেকড তথ্য ছড়িয়ে দাঙ্গা লাগানো হয়।

এবং এইখানে, ঠিক এইখানে, আমাদের শিক্ষিত সংখ্যাগুরু নাগরিকদের ভূমিকা খুব আশ্চর্যজনক। ক্রমহ্রাসমান মধ্যবিত্ত তাদের লুকোনো ঘৃণা আর লুকিয়ে রাখে না। সাম্প্রদায়িক হওয়া আর অগৌরবের বিষয় নয় মধ্যবিত্তের কাছে। প্রতিবেশি দুই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ধর্মীয় অনুপ্রবেশ দেখে আমাদের শেখা উচিত ছিল।

আমরা তো  মার্টিন ন্যুয়েমলার পড়িনি। অথবা পড়লেও তা বোঝার চেষ্টা করিনি।

অপেক্ষা, শুধু আগুন লাগার…

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment