পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কলকাতা ময়দানের আগস্ট বিপ্লব

  • 23 August, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 543 view(s)
  • লিখেছেন : শুভ্রদীপ ঘোষ
জন্মলগ্ন থেকে ফুটবল একটি আদ্যন্ত রাজনৈতিক খেলা। এই খেলা কেবল বিনোদন নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আত্মপরিচয়। লাতিন আমেরিকার বিখ্যাত ভাষ্যকার এদুয়ার্দো গালেনো তাঁর “Football in the Sun and Shadow” বইতে স্পষ্ট ভাষায় এই কথাগুলোই লিখেছেন। ফুটবলের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বিশেষত ক্লাব ফুটবলের ক্ষেত্রে এর চেয়ে সত্যি কিছু হয় না। বিশ্বখ্যাত এবং অখ্যাত নানা ফুটবল ক্লাবের তৈরি হওয়া, গড়ে ওঠার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস - সেই জনগোষ্ঠী যাদের রাজনৈতিক পরিচয়ই ক্লাবের সমর্থক গোষ্ঠীর আত্মপরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৩১ মে, ২০২০।

কোভিডের কামড়ে আশঙ্কায় দুরুদুরু গোটা পৃথিবী সেঁধিয়ে আছে ঘরের ভিতরে। ব্রাজিলের সাও পাওলো শহর কিন্তু সেদিন জনারণ্য। অতি দক্ষিনপন্থী রাষ্ট্রপতি জাইর বলসোনারোর কুশাসনের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে মানুষ। মিছিলের নাম “ফ্যাসি বিরোধী মিছিল, গণতন্ত্রের পক্ষে মিছিল।” মিছিলের ডাক দিয়েছে কারা? শহরের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী চারটি ফুটবল ক্লাবের বামপন্থী মনোভাবাপন্ন সমর্থকদের গোষ্ঠী - করিন্থিয়ান্স দলের “ Gavioes da Fiel”, পালমেইরাসের “ Mancha Alviverde”, সাও পাওলোর “ Indipendente” এবং সান্তোসের “ Torcida Jovem” । করিন্থিয়ান্স এবং পালমেইরাসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কলকাতা শহরের ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে তুলনীয়। তুলনায় কমজোরি হলেও কিংবদন্তী পেলের খেলে যাওয়া ক্লাব সান্তোস এই শহরের ক্লাবভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃতীয় প্রধান, অনেকটা কলকাতার মহামেডান স্পোর্টিং এর মত। এ সত্ত্বেও বলসোনারোর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামল প্রতিদ্বন্দ্বী ফুটবল ক্লাবের সমর্থকদের একটা বড় অংশ। সেদিন সাও পাওলোর রাস্তায় একত্র হয়ে স্বৈরাচারীর সমর্থকদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে গেল একদল মানুষ যারা ফুটবল স্টেডিয়ামে নিজেদের মধ্যে হিংসাত্বক লড়াই লড়ার জন্য পরিচিত ছিল। বিশ্বজুড়ে ফুটবল ক্লাব এবং তার সমর্থক গোষ্ঠীর ইতিহাসে এমন ঘটনা সম্ভবত প্রথমবার ঘটল।

 

আগস্ট ২০২৪। 

কাট টু কলকাতা। ভারতীয় ফুটবলের প্রাণকেন্দ্র, আজও। কারণ এই শহরেই আছে তিনটি শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাব যাদের নিজস্ব সমর্থকগোষ্ঠী আছে, যে সমর্থকগোষ্ঠী জন্ম নিয়েছে, লালিত হয়েছে জৈব (organic) প্রক্রিয়ায়। কোন ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক কর্পোরেট লালিত বিজ্ঞাপনী সমর্থকগোষ্ঠী এরা নয়। কলকাতা শহরে আগস্টের শুরুতেই প্রাতিষ্ঠানিক মদতে এক মহিলা ডাক্তারের ধর্ষণ এবং নির্মম হত্যার যে ঘটনা ঘটে গেল সরকারী তৎপরতায় তা ধামাচাপা দেবার চেষ্টার বিরুদ্ধে গর্জে উঠল শহর। এদিকে সেই সময়েই মরশুমের প্রথম বড় ম্যাচে মুখোমুখি হবে চির প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান। ছোটবেলা থেকে একমাত্র ফুটবল খেলার সঙ্গে বেড়ে ওঠার সুবাদে আমি আজন্ম এই দুইয়ের একজনের সমর্থক। সামাজিক মাধ্যমের যুগে স্বাভাবিকভাবেই সেই ক্লাবের সমর্থক গোষ্ঠীগুলির সমাজ মাধ্যমের গ্রুপেও যুক্ত। ১৮ তারিখ ম্যাচের দিন তিন চার আগে থেকে খেয়াল করলাম সেই গ্রুপগুলিতে আলোচনা একটু অন্য খাতে বইছে। সকলেই চাইছে কদিন আগেই ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনার বিচার, চাইছে সরকার যেভাবে ঘটনার অভিমুখ ঘোরানোর চেষ্টা করছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। মুহুর্তে তৈরি হল সমর্থন, শুধু নিজেদের মধ্যেই নয়, চির প্রতিদ্বন্দ্বীর সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যেও। সিদ্ধান্ত হল সেদিন গ্যালারি হবে অন্যরকম। সেদিন দুই দলের সমর্থকরা একে অপরের বিরুদ্ধে তো দুরস্ত, এমনকি নিজের দলের হয়েও গর্জন করবেন না। দুই দলের সমর্থক একজোট হয়ে কেবল বিচার চাইবেন এই লজ্জাজনক, ঘৃণ্য ঘটনার। ঠিক হল পুলিশ যদি ব্যানার, টিফো নিয়ে না ঢুকতে দেয়, তবে ৯০ মিনিট বিচার চেয়ে টানা স্লোগান চলবে। “অ রাজনৈতিক” সমর্থকদের এমন রাজনৈতিক মেজাজ এবং ঐক্যের বাতাবরণ দেখে সরকার এবং পুলিশ বাতিল করল বড় ম্যাচ। আগুনে ঘি পড়ল। যা কেবল সরকার কেন, আমার মত আরও অনেকেই ভাবতে পারেনি, তাই ঘটল। দুই দলের প্রধান সমর্থক গোষ্ঠী আহ্বান জানাল খেলা বাতিল হলেও সেইদিন স্টেডিয়ামের বাইরে পোস্টার, ব্যানার, স্লোগান নিয়ে তারা হাজির থাকবে, ন্যায়বিচার চাইবে। এরপর কী হল সবার জানা। দুই প্রধানের সঙ্গে একজোট হল তৃতীয় প্রধান মহামেডান স্পোর্টিং এর সমর্থক গোষ্ঠী। পুলিশের প্রাথমিক আক্রমণে বিহ্বল হয়ে পড়লেও শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাঁরা জমায়েত করলেন, যে জমায়েত যত সময় গড়াল কলেবরে বাড়ল। শুধু তাই নয়, এতদিন যারা এই বড় ম্যাচটির শুরু এবং শেষে পরস্পরকে কটূক্তি থেকে শুরু করে মারধোর করার ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে আসছিলেন, যারা একে অপরের প্রতি কেবল অসীম ঘৃণা ছুঁড়ে দিতেন, তাঁরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে দাঁড়ালেন, পরস্পরের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ালেন, একে অপরের পতাকা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। এমনকি প্রতি ম্যাচের শেষে যে জায়গা শিরোনামে আসত এক দলের দাঙ্গাবাজ সমর্থকদের অন্য দলের উপর চড়াও হবার জন্য, ঠিক সেই জায়গাতেই সেই উগ্র সমর্থকরাই পুলিশের হাত থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বিপন্ন সমর্থকদের উদ্ধার করলেন, গলিঘুঁজির ভিতর দিয়ে রাস্তা চিনিয়ে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিলেন। কলকাতা দেখল এক অবাক করা দৃশ্য - মোহনবাগান সমর্থকের কাঁধে চেপে বিচারের দাবিতে গলা ফাটাচ্ছেন এক ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। অভাবনীয় এই দৃশ্যের সামনে অসহায় হয়ে পিছু হটল পুলিশ, এবং বকলমে স্বৈরাচারী সরকার। ১৮ আগস্টের কলকাতা জায়গা নিল ৩১ শে মে’র সাও পাওলোর পাশে। একইসঙ্গে ঘটতে থাকল অভূতপূর্ব কিছু ঘটনা। ১৭ আগস্ট রাতে বড় ম্যাচ বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করলেন ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড় শৌভিক চক্রবর্তী। তাঁর বক্তব্য ছিল - আবেগের এই ম্যাচ না খেলতে পারায় তিনি হতাশ বটে, কিন্তু এই মুহূর্তে সর্বাগ্রে প্রয়োজন কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া এই নারকীয় ঘটনার বিচারের দাবী। ১৮ ই আগস্ট স্টেডিয়ামের সামনে জমায়েতে হাজির হলেন মোহনবাগানের অধিনায়ক শুভাশিস বসু। জমায়েতের সঙ্গে গলা মেলালেন তিনি - উই ওয়ান্ট জাস্টিস। এই প্রবণতার ধারাবাহিকতায় অনূর্ধ্ব-২০ সাফ ফুটবল প্রতিযোগিতায় ভারত - ভুটান ম্যাচে ভারতের একমাত্র গোলদাতা মনিরুল মোল্লার জার্সির তলায় দেখা গেল বিচার চেয়ে স্লোগান লেখা। কলকাতা লীগের খেলায় মহামেডান স্পোর্টিং দলের মহীতোষ এবং ইস্রাফিল তুলে ধরলেন বিচার চেয়ে স্লোগান লেখা দলের জার্সি। একই ঘটনা ঘটল কলকাতা লিগে ইস্টবেঙ্গল -  রেনবো ম্যাচে - দুই দলের খেলোয়াড়রাই আলাদা করে বিচারের দাবিতে লেখা জার্সি তুলে দেখালেন। ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে দেখা গেল একই দাবিতে বিশালকায় ব্যানার। শিলং এর মাঠে ডুরান্ড কাপের ম্যাচে গোল করে ইস্টবেঙ্গল সিনিয়র দলের নন্দকুমার জার্সি তুলে গ্যালারির উদ্দেশ্যে দেখালেন নিচে লেখা স্লোগান - “ মহিলাদের সম্মান করুন।”

 

কলকাতার তিন প্রধানের সমর্থকদের একত্র প্রতিবাদ। সূত্র ঃ ইন্টারনেট।

 

 

বাঁ দিকে ঃ মহামেডান স্পোর্টিং এর খেলোয়াড়েরা এবং ডান দিকে ঃ ভারতের অনূর্ধ্ব ২০ দলের মনিরুল মোল্লা, আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ করছেন। সূত্র ঃ Sportskeeda

 

জন্মলগ্ন থেকে ফুটবল একটি আদ্যন্ত রাজনৈতিক খেলা। এই খেলা কেবল বিনোদন নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আত্মপরিচয়। লাতিন আমেরিকার বিখ্যাত ভাষ্যকার এদুয়ার্দো গালেনো তাঁর “Football in the Sun and Shadow” বইতে স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন ঃAn astonishing void: official history ignores soccer. Contemporary history texts fail to mention it, even in passing, in countries where soccer has been and continues to be a primordial symbol of collective identity. I play therefore I am: a style of play in a way of being that reveals the unique profile of each community and affirms its right to be different. Tell me how you play and I’ll tell you who you are.

ফুটবলের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বিশেষত ক্লাব ফুটবলের ক্ষেত্রে এর চেয়ে সত্যি কিছু হয় না। বিশ্বখ্যাত এবং অখ্যাত নানা ফুটবল ক্লাবের তৈরি হওয়া, গড়ে ওঠার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস - সেই জনগোষ্ঠী যাদের রাজনৈতিক পরিচয়ই ক্লাবের সমর্থক গোষ্ঠীর আত্মপরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের সাথে সাথে ফুটবল বেশি বেশি কর্পোরেট হয়ে উঠলেও এই সমর্থকগোষ্ঠী সেই রাজনৈতিক পরিচয় বদলায়নি। উদাহরণ হিসেবে লিভারপুল ক্লাবের কথা বলা যেতে পারে। লিভারপুলের শ্রমজীবী মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক লিভারপুল ফুটবল দল একবিংশ শতকের বাজারি চাহিদা মেনে চললেও সমর্থকদের চাপে বাধ্য হয়েছে কয়েক বছর আগে প্রস্তাবিত অভিজাত টুর্নামেন্ট ইউরোপিয়ান সুপার লিগ থেকে নাম প্রত্যাহার করতে। উদাহরণ আরও আছে । স্কটল্যান্ডের সেল্টিক ক্লাবের মূল ফটকে খোদাই করা আছে “ উদ্বাস্তুরা স্বাগত।” এই দুটি শব্দই বুঝিয়ে দেয় ক্লাব এবং ক্লাব সমর্থকদের রাজনৈতিক দর্শন। সেল্টিকের খেলায় অহরহ দেখা যায় ফ্যাসিবিরোধী ব্যানার, প্যালেস্টাইনের সমর্থনে স্লোগান। রোমের লাজিও ক্লাবের সমর্থক বাহিনী গোটা বিশ্বে কুখ্যাত তাদের খোলাখুলি ফ্যাসিবাদ সমর্থনে। গত বছর উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সেল্টিক বনাম লাজিওর খেলায় সেল্টিক গ্যালারিতে ভেসে ওঠা একটি পোস্টারে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির অন্তিম পরিণতি। যে করিন্থিয়ান্স ক্লাবের কথা দিয়ে এই লেখার শুরু ৭০ এবং ৮০ দশকে সেই করিন্থিয়ান্সের ফুটবল দল এবং সমর্থকরা নিজেদের পরিচিতি তৈরি করেছিলেন স্বৈরতন্ত্রের বিরোধী এবং গণতন্ত্রপন্থী হিসেবে। সামরিক শাসনে থাকা ব্রাজিলে সে ছিল অসীম সাহসের কাজ। এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ব্রাজিলের বিখ্যাত রাজনৈতিক ফুটবলার সোক্রাতেস।

 

লিভারপুল ফুটবল দলের সমর্থকগোষ্ঠী “ লিভারপুল আল্ট্রাস” এর ইন্সটাগ্রাম পোস্টার।

 

ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে সঙ্গে ফুটবলারদের রাজনৈতিক পক্ষ নেওয়ার উদাহরণ প্রচুর। ৩০ এর দশকে ইতালির ফিওরেন্তিনার ব্রুনো নেরির ফ্যাসিস্ট সেলাম দিতে অস্বীকার করা থেকে শুরু করে ফ্যাসিস্ট ফ্র্যাঙ্কোর স্পেনে খেলার মাঠেই বার্সেলোনার ইওহান ক্রুয়েফের কাতালান স্বাধীনতার স্বপক্ষে প্রতীকী প্রতিবাদ, মারাদোনার প্রকাশ্যে লাতিন আমেরিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাদাগিরির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হওয়া এবং প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতার দাবির পাশে দাঁড়ানো, ক্লাবের শাস্তির তোয়াক্কা না করে জার্মানির মাইনজ ক্লাবে খেলা হল্যান্ডের ফুটবলার আনোয়ার এল ঘাজির গাজায় চলমান গণসংহারের প্রতিবাদ, বার্সেলোনার জোয়াও কনসেলো, প্যারিস সা জা’র ওসুমান ডেম্বেলে, জুভেন্তাসের মার্কাস থুরম, মহিলা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্পেন দলের খেলোয়াড় আইতানা বনমাতির গাজা ঘটনার প্রতিবাদে প্রকাশ্য বিবৃতি - তালিকা যথেষ্ট দীর্ঘ।

এর পাশাপাশি যদি ১০০ বছরের বেশি পুরনো বাংলার ফুটবল ক্লাবগুলি এবং খেলোয়াড়দের কথা ভাবি, তাহলে এমন উদাহরণ একেবারেই অনুপস্থিত বলা চলে। কলকাতার তিন বড় দল, যারা, এমনকি এই ফ্র্যাঞ্চাইজি ফুটবলের আমলেও ভারতীয় ফুটবলের মুখ, জন্ম নিয়েছিল রাজনৈতিক সামাজিক পটভূমিকায়। মোহনবাগান ক্লাবের সূচনা ব্রিটিশ ভারতে বাঙ্গালী ছেলেদের জন্য ক্লাব তৈরির মাধ্যমে সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিসর তৈরির তাগিদে। মহামেডান স্পোর্টিং তৈরি হয়েছিল বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের অন্যতম সূচক হিসেবে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলার আত্মপরিচয়ের টানাপোড়েনের রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে। অথচ এই ক্লাবগুলি বা তাদের সমর্থকবাহিনী জমি তৈরি থাকা সত্ত্বেও বিশ্বজোড়া ফুটবল ক্লাবের মত রাজনৈতিক পরিচিতি তৈরি করতে পারেননি। ১৯১১ সালে আই এফ এ শিল্ড জয়ী মোহনবাগানের সাফল্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মননে ঢেউ তুললেও, স্বাধীন ভারতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে ক্লাব বা সমর্থক কেউই নিজেদের একাত্ম করেননি। দেশভাগের করুণ প্রেক্ষাপটে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব পূর্ববঙ্গের হিন্দু উদ্বাস্তুদের পরিচিতির আধার হয়ে দাঁড়ালেও তা থমকে থেকেছে সেখানেই। ক্লাব বা সমর্থকদের গোষ্ঠী বিশ্বজোড়া উদ্বাস্তুদের যন্ত্রণার শরিক হয়নি। মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবও নিছক বিনোদনের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে।

 

ক্লাব, সমর্থক এবং খেলোয়াড়দের এই “অরাজনৈতিক” ঝোঁক, বাংলা তথা ভারতের ফুটবলকে স্থিতাবস্থার সমর্থক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে বিগত এক সপ্তাহের ঘটনাযথেষ্ট ইতিবাচক এবং আশাব্যঞ্জক। আধা পেশাদার ভারতীয় ফুটবল কাঠামোয় ফুটবলারদের আর্থিক নিরাপত্তা পশ্চিমি দেশগুলির সমতুল্য নয়। এ সত্ত্বেও এবং ক্লাবগুলির প্রশাসনিক অনুমোদন ব্যতিরেকেই ( তিন দলের সচিবদের সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথা স্পষ্ট যে খেলার মাঠে ফুটবলারদের বিচার চাইবার মত আপাত নিরীহ রাজনৈতিক ইস্যুতে পক্ষ নেওয়া তাঁরা সমর্থন করেন না ) মহীতোষ, ইস্রাফিল, মনিরুলের মত অপ্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়রা প্রতিবাদ জানানোর ঝুঁকি নিলেন। অবশ্যই ঘটনাটির ভয়াবহতা এবং ঘটনাস্থল খোদ মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় তার অভিঘাত নাড়া দিয়েছে বহু মানুষের মত ফুটবলার এবং সমর্থকদের। কিন্তু তার সঙ্গে বোধহয় যোগ হয়েছে চলমান ব্যবস্থার প্রতি পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। প্রতিটি ক্ষেত্রে শাসক দলের মন জুগিয়ে চলা, ক্লাব প্রশাসনে তাদের সম্পূর্ন দখলদারি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের আখের গোছানো, এ সবকিছুই ভেঙ্গে দিয়েছে ধৈর্যের বাঁধ। ফলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর রোষানলকেও কেউ তোয়াক্কা করেনি, বরং এতদিনের পারস্পরিক বৈরিতার স্থিতাবস্থা ভেঙ্গে ফেলে তৈরি করেছে সলিডারিটি।

 

আর জি করের ঘটনাটিতে চলতি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের জমা ক্ষোভের দুটি দিক আছে - একটি হল ক্ষমতাসীন দলের তুমুল দুর্নীতি এবং দাদাগিরির বিরুদ্ধে ক্ষোভ। আর একটি হল মহিলাদের নিরাপত্তার অস্তিত্বহীনতার বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় মদত পাওয়া ধর্ষণ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ। এই দ্বিতীয় বিষয়টি বাংলার ক্লাব ফুটবলের সমর্থক গোষ্ঠীর ভয়াবহ আকারের নারী-বিদ্বেষী সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান দুই বড় ক্লাবের গ্যালারির বৈশিষ্ট্যই হল প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়, সমর্থক থেকে শুরু করে এমনকি নিজের দলের খেলোয়াড়দের প্রতিও রেপ রেটরিকের যথেচ্ছ প্রয়োগ। গ্যালারি থেকে সামাজিক মাধ্যম সর্বত্র এর প্রতিবাদ করেন ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী। সঙ্গে সঙ্গে রে রে করে তেড়ে আসেন একদল যাঁদের বক্তব্য হল এটাই নাকি ফুটবল সংস্কৃতি। ফুটবল পুরুষকারের পরিচায়ক। আর, কে না জানে  পুরুষকারের পরিচয় যৌন- গন্ধী মন্তব্যে, প্রতিপক্ষ দলের মহিলাদের যৌন হেনস্থার ইচ্ছা প্রকাশে? ঝগড়া, ঝামেলার অজুহাতে সমর্থকদের একটা বড় অংশ নীরব থাকেন। তাঁরা হয় বোঝেন না এই প্রবণতার পরিণাম কিংবা বুঝেও সুবিধাবাদীর মত নীরব থাকেন। এই ঘটনায় প্রথম চোখে পড়ল এই প্রবণতাকে প্রতিহত করার সচেতন প্রয়াস। সমর্থকগোষ্ঠীর সামাজিক মাধ্যমের পাতায় বহুবার বলা কথাগুলো ফের বলায় কেউ তেড়ে এল না। উল্টে অনেকেই একে অপরকে বোঝাতে লাগল যে এই নারী বিদ্বেষী মন্তব্য আর “ জাস্টিস ফর আর জি কর” একসঙ্গে যায় না। এমনকি তুমুল বর্ণবিদ্বেশী লোটা-মাচা শব্দবন্ধ পরিত্যাগ করার কথাও উঠল এবং কেউ প্রতিবাদ করল না।

 

শুধু প্রতিবাদ করাই নয়, চলমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গর্জে উঠে রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করাই নয়, আমরা নিজেরাই সমস্যার অংশ কিনা এ নিয়ে ফুটবল গ্যালারির ভাবার সময় এসেছে। কলকাতা ময়দানের আগস্ট বিপ্লব খুব ক্ষীণ হলেও একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। সমর্থকগোষ্ঠীগুলি যদি সত্যিই ১৮ আগস্টের ইতিহাস গড়ার পরভিন্ন সংস্কৃতি তৈরি করতে আগ্রহী হয় তবে তাদের উচিৎ এই ভাষা সন্ত্রাস যা আসলে ধর্ষন সংস্কৃতিকে উৎসাহ দেয় তা নির্মূল করার জন্য নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা গোষ্ঠী, বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যা বিভাগের সাহায্য নিয়ে নিয়মিত কর্মশালা এবং প্রচারাভিযানের ব্যবস্থা করা। হয়ত একটু বেশিই আশা করা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু স্থিতাবস্থায় অভাবনীয় নাড়াচাড়া হলে অনেক কিছুই সম্ভব হতে পারে।

দিন দুই আগে কথা হচ্ছিল চিকিৎসক বন্ধুর সঙ্গে। ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক বন্ধুটি ১৮ আগস্ট স্টেডিয়ামের বাইরে ছিলেন। পুরো সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী। প্রসঙ্গ উঠতে বন্ধু বললেন

“ আর জি কর কাণ্ডে সুবিচার হবে কিনা জানি না। আজকাল আর আশা করতে পারি না। কিন্তু যতদিন বেঁচে থাকব স্টেডিয়ামের সামনে সেদিন যে দৃশ্য দেখেছি  তা ভুলতে পারব না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বলতে পারব একটা অন্তত নতুন দিন দেখেছিলাম। “ময়দানের আগস্ট বিপ্লব ফুল ফোটাবে কিনা জানি না, কিন্তু ১৯৮০ র আগস্টের মৃত্যুর শীতলতার পর এই আগস্টে ঘোর বর্ষাতেও বসন্ত এসেছে কলকাতা ময়দানে। চারপাশে হতাশার মধ্যে এটুকু প্রাপ্তি বড় কম নয়।

 

 

 

0 Comments

Post Comment