পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

পেশাগত অসুখের সামাজিক অসুখ (এ্যাসবেস্টসিস একটি উদাহরণ)

  • 29 March, 2025
  • 2 Comment(s)
  • 448 view(s)
  • লিখেছেন : উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়
মানব স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকারক প্রভাবের কারণে ১৯৯৩ সাল থেকে ভারত সরকার এ্যাসবেস্টস খনন নিষিদ্ধ করেছে। তবু এটি এখনও ক্রাইসোটাইল এ্যাসবেস্টস আমদানি এবং ব্যবহারের অনুমতি দেয়, যা হোয়াইট এ্যাসবেস্টস নামেও পরিচিত, মূলত নির্মাণ উদ্দেশ্যে যেমন এ্যাসবেস্টস-সিমেন্ট ছাদ এর জন্য।

মানবাধিকার স্খলনের চূড়ান্ত উদাহরণ হলো হিউম্যান-স্ক্যাভেঞ্জিং। মাত্র কয়েক বছর আগেও , ধরুন ২০০৭ সালে নৈহাটি শহরে তখনও স্ক্যাভেঞ্জার (মলবাহক) পদটি ছিল পৌরসভাতে। তাঁরা ঠিকা শ্রমিকের মতন পরিশ্রমিক বা মাইনে পেতেন।


একই ভাবে বলা যেতে পারে এ্যাসবেস্টস এর ব্যবহার থেকে এ্যাসবেস্টসিস হয় ও পরে তা লাঙ্- ক্যানসারে মৃত্যু হয়। এ্যাসবেস্টস এর চোঁছ্ গুলো দেখতে অনেকটা ছুঁচ্ এর মতন যা নিঃশ্বাসের সাথে ঢোকে এবং এর এমন কোন কায়দা নেই যে সেগুলো ওখান থেকে বের করা সম্ভব হয়ে ওঠে। অনেকটা কাঁথা স্টিচিং মানে মনে করুন ছুঁচ্ দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে সেলাই করছেন যা আঁটকেই থাকে কাঁথাটার সাথে। এভাবেই ফুসফুসে হয় প্লূরাল প্লাক , তারপরের স্টেজ মেসোথেলিওমা ও সর্বশেষে লাঙ্-ক্যানসার ও অবধারিত মৃত্যু। প্রশ্নটা এখানে নয়। এ্যাসবেস্টস নিয়ে কাজ করাটাই হানিকর। পৃথিবীর ১২০ টারও বেশি দেশে এ্যাসবেস্টস ব্যবহার নিষিদ্ধ। সেখানে TLV (Threshold Limit Value) জিরো। ACGIH ( American Conference of Governmental Industrial Hygienists) রা বলেছিলেন যে TLV র ইউনিট হলো  ফাইবার / কিউবিক সেন্টিমিটার-এ। অর্থাৎ প্রতি কিউবিক সেন্টিমিটার অঞ্চলে এ্যাসবেস্টসের ফাইবার কতটা আছে। আমেরিকা , ব্রিটেন , কানাডা , ইউরোপের দেশ , এমনকি ভূটান , নেপাল, সিঙ্গাপুর , আরব দেশ গুলো সহ পৃথিবীর ১২০ টা দেশে TLV শূণ্য। কারণ সেই দেশগুলো তে এ্যাসবেস্টস ব্যবহার নিষিদ্ধ । আমাদের দেশে এখনও তা ৩। এ যেন সক্রেটিস এর বিষপান। হেমলক খেয়েছিলেন সক্রেটিস।  হেমলক কতটা খাওয়া যায়? এক চামচ? দু চামচ ? তিন চামচ ? চার চামচ? চার চামচ খেলে তো মানুষ মারা যাবে! অতএব তিন চামচ খেলে মরবে না। এ যেন সেরকম যুক্তি। ভারতে এ্যাসবেস্টসের ব্যবহার নিষিদ্ধ নয়। সিমেন্ট শীট্ বলে বাণিজ্যিক শিল্পপতি রা যেগুলো চালায় সেগুলো আদপে চক্ষুলজ্জায় ; আর এ্যাসবেস্টস শীট বলে না , সিমেন্ট শীট্ বলে যেহেতু সিমেন্ট দিয়েই এ্যাসবেস্টস এর বাইন্ডিং ক্যাপাসিটি (BC) সবথেকে ভাল। কানাডায় এ্যাসবেস্টস ব্যবহার নিষিদ্ধ কিন্তু কানাডা, সাউথ আফ্রিকা র খনি খনন করে এখানকার শ্রমিকরা ওখানে গিয়ে খনিজ এ্যাসবেস্টসের আকরিক যা নিজেও শলাকাযুক্ত ভঙ্গুর ওখান থেকেই সংগ্রহ করে অর্থাৎ খনন করে। এইভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা সহ কানাডা রপ্তানি বাজারটা খোলা রাখে কিন্তু নিজের দেশবাসী রা তাতে যুক্ত হন না ,হবার কথাও নয়। যা নিয়মও নয়, স্বাস্থ্যের হানিকারক কারণে, অথচ রেভিনিউ উপায়ের রাস্তাটা জারি থাকে ওদেশের। আমরা আমদানি করি। আমাদের ইন্ডাস্ট্রীগুলোতে বিশেষ করে যেখানে এ্যাসবেস্টস শীট্ তৈরি হয়, রং তৈরির কারখানা গুলো তে এবং বাতানুকুল ডাক্ট এও এ্যাসবেস্টস ফাইবার ভালভাবে প্রয়োজন হয় এদেশে। তার কারণ এ্যাসবেস্টস ভীষণ ভাল তাপ পরিবাহী। ওসব দেশে অন্যভাবে সিন্থেটিক তুলো ব্যবহার করা হয়।
এ্যাসবেস্টস শীট এবং অপরিশোধিত এ্যাসবেস্টস ফাইবারগুলি থেকে তৈরি অন্যান্য পণ্যগুলি এখনও তাদের সাথে সম্পর্কিত স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ভারতে তৈরি এবং ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে, ভারত বিশ্বের বৃহত্তম আমদানিকারক এবং এ্যাসবেস্টসের ভোক্তা, যা বিশ্বব্যাপী আমদানির প্রায় ৪৪%  হিসাবে রয়েছে।


মানব স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকারক প্রভাবের কারণে ১৯৯৩ সাল থেকে ভারত সরকার এ্যাসবেস্টস খনন নিষিদ্ধ করেছে। তবু এটি এখনও ক্রাইসোটাইল এ্যাসবেস্টস আমদানি এবং ব্যবহারের অনুমতি দেয়, যা হোয়াইট এ্যাসবেস্টস নামেও পরিচিত, মূলত নির্মাণ উদ্দেশ্যে যেমন এ্যাসবেস্টস-সিমেন্ট ছাদ এর জন্য।


ভারতে প্রায় ১৩ টি বৃহৎ আকারের এবং ৬৭৩ টি ছোট আকারের এ্যাসবেস্টস কারখানা রয়েছে, যার বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।
এই কারখানাগুলি প্রায়, ৬০০০ কর্মীকে প্রত্যক্ষ এবং ১০০,০০০ পরোক্ষভাবে নিয়োগ দেয় ।

ভারতে এ্যাসবেস্টস ফাইবার থেকে তৈরি কিছু পণ্যগুলির মধ্যে রয়েছে:
এ্যাসবেস্টস সিমেন্ট শীট :
ছাদ এবং দেয়ালগুলির জন্য ব্যবহৃত।
এ্যাসবেস্টস সিমেন্ট পাইপ :
জল সরবরাহ এবং নিকাশী সিস্টেমের জন্য ব্যবহৃত।
এ্যাসবেস্টস টেক্সটাইল : নিরোধক এবং ফায়ারপ্রুফিংয়ের জন্য ব্যবহৃত।
এ্যাসবেস্টস-ভিত্তিক ব্রেক লাইনিংস :
স্বয়ংচালিত শিল্পে ব্যবহৃত।

কিন্তু তবু এটা লক্ষণীয় যে অনেক দেশ কার্সিনোজেনিক বা ক্যানসার প্রবণতার কারণে এ্যাসবেস্টস ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। হু (WHO) জানিয়েছে যেকোন রকমের বা যেকোন ভাবে এ্যাসবেস্টস এর ব্যবহার স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর।
যাইহোক এই প্রতিবেদক এ নিয়ে খবরাখবর সংগ্রহ করে একটি গবেষণা করেন এবং একটি তথ্যচিত্র, "প্লাইট অফ্ এ ব্রোকেন নেস্ট" (একটি ভাঙা ঘরের ইতিকথা) নির্মাণ করেন ২০১২ সালে।
এবারে আসি, এ্যাসবেস্টস এর ফলে স্বাস্থ্যের কথায়। ESI (Employees State Insurance) Act তৈরি হয় ১৯৪৮ এ। তখনও ঐ আইনে লেখা ছিল , যা এখনও আছে যে এ্যাসবেস্টোসিস কারুর হয় তখনই যখন সে কোন এ্যাসবেস্টস কারখানায় কাজ করেন। যারা এ্যাসবেস্টস নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেন না তাদের এই রোগ হবার কথা নয়। এই রোগের ক্ষেত্রে সেই কোম্পানির মালিকের পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়া ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া আবশ্যিক। আইনে আছে। রমরমা করে এ্যাসবেস্টস শীট বাড়িতে বাড়িতে , বাস স্ট্যান্ডে , রেল‌ স্টেশনে ছাদে টাঙানো আছে , অথচ কারুর এ্যাসবেস্টসিস অসুখটাই হয়নি ? এরকম হতে পারে? অথচ আইনে আছে? পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। ১৯৪৮ সালের পর ১৯৯৬ সালে প্রথম এই অসুখের ডিটেকশন সম্ভব হলো বা ডায়াগনোসিস হলো। এতগুলো বছরে কারুর এ্যাসবেস্টোসিস হয়নি? লিপিবদ্ধ নেই। কেন? কারণ রাষ্ট্রের অনীহা। বোঝাই যায় রাষ্ট্র কার হয়ে কাজ করে। শ্রমিক দরদী চেষ্ট স্পেশালিস্ট ইএসআই হাসপাতালের ডাঃ কুণাল দত্ত এই অসুখ টিকে প্রথম নির্ণয় করেন। নির্ণয় করার প্রথম সেই রোগিটি আর বেঁচে নেই; তার নাম এখন করাই যায় - হাওড়া অঞ্চলের এ্যাসবেস্টস কোম্পানির শ্রমিক গঙ্গাশরণ লোধ। এইভাবে, একে একে ডাঃ কুণাল দত্ত ঐ অঞ্চলের পরিবেশ কে সন্দেহ করে ১২ টি কেস ডায়াগনোসিস করেন। প্রত্যেকেই মারা যান। এবং উনি একা  অসাধারণ ভাবে এক অসম লড়াই চালিয়ে প্রতিটি শ্রমিক পরিবারের জন্য মালিকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেন। বর্তমানে অবসর নিয়েও শ্রমজীবী শ্রীরামপুর হাসপাতালে এখনও ডাঃ কুণাল দত্ত নিয়মিত চিকিৎসা করেন।
আসলে, যেটা বলতে চাইছি তা হলো Occupational Disease (OD) Medical Science এর একটি বিষয়। কিন্তু এটার এতো গ্ল্যামার নেই - এই বিষয়ে কোন পুরষ্কার,অস্কার নাই। কারণ এই রোগগুলো গরীব মানুষদের হয়। তাই এই রোগ গুলোর গবেষণাও সেকেন্ড ক্লাস সিটিজন এর মতন। কদর নাই। ডাক্তাররাও ইন্টারেস্টেড নন।
অথচ আইনে কী কী বলা আছে?
ভারতে পেশাগত রোগের জাতীয় তালিকায় কী বলা আছে?

ভারতীয় কারখানা আইন ১৯৪৮ তৃতীয় তফসিল অনুসারে, ধারা ৮৯ এবং ৯০ - উল্লেখযোগ্য রোগের তালিকা, এখানে ২৯ টি তালিকাভুক্ত রোগ রয়েছে।
এর মধ্যে সীসা, টেট্রা-ইথাইল , ফসফরাস, পারদ, ম্যাঙ্গানিজ, আর্সেনিক, নাইট্রাস ফিউমস্ , কার্বন বিসালফাইড, বেনজিন, তাদের নাইট্রো বা অ্যামিডো ডেরিভেটিভস বা তাদের সিকোলেট, ক্রোম আলসারেশন, অ্যানথ্রাকোসিস, সিলিকোসিস, রেডিয়াম বা হোলগেটস, রেডিয়োএ্যাক্টিভস, রেডিওএকস, প্রভূত -  সাথে বিষক্রিয়াগুলি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়াও
রক্তাল্পতা, জন্ডিস, তেল ব্রণ বা ডার্মাটাইটিস খনিজ তেলের কারণে,বাইসিয়নোসিস, অ্যাসবেস্টোসিস, কমিউনিকেবল্ ডার্মাটাইটিস, বিকট শব্দ-প্ররোচিত শ্রবণশক্তি হ্রাস, বেরিলিয়াম, কার্বন মনোক্সাইড, কয়লা খনিজ সংক্রান্ত নানান রাসায়নিক গ্যাস ,যেমন ফসজিন, এছাড়াও আছে আইসোক্যানেটস, পেশাগত ক্যান্সার এবং বিষাক্ত নেফ্রাইটিস।

ক্ষতিপূরণ কী বলা আছে?

কর্মীদের ক্ষতিপূরণ আইন, ১৯২৩ এর চারটি অধ্যায় এবং নিম্নলিখিত সময়সূচী রয়েছে: তফসিল ১, অংশ ১ (স্থায়ী আংশিক অক্ষমতার ফলস্বরূপ বিবেচিত আঘাতের তালিকা) এবং  শিডিউল ২ (কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের তালিকা) আর, শিডিউল ৩ এ দ্বিতীয় অধ্যায় অনুসারে, কর্মীদের ক্ষতিপূরণ, ধারা ৩ এ বর্ণনা আছে। ক্ষতিপূরণের জন্য নিয়োগকর্তার দায়বদ্ধতা, যদি তার কর্মসংস্থানের বাইরে এবং তার কর্মসংস্থান চলাকালীন দুর্ঘটনাক্রমে কোনও কর্মীর কাছে ব্যক্তিগত আঘাতের কারণ হয়ে থাকে তবে তার নিয়োগকর্তা এই অধ্যায়ের বিধান অনুসারে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে দায়বদ্ধ হবেন।
এতটুকুই বলা আছে।


এর কোন ডিপার্টমেন্ট ভারতে হয়তো কোথাও আছে কি? থাকলেও বিরল। অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন এ্যান্ড পাবলিক হেলথ্, কলকাতায় একটা ছোট্ট ডিপার্টমেন্ট আছে সেখানে অকুপেশনাল ডিজিজ পড়ানো হয়, এছাড়া ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট অফ অকুপেশনাল হেলথ , আহমেদাবাদ এ আছে। এগুলো সবই একটা তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের  আধার কিন্তু কেস টু কেস - একটি রোগিকে খুঁজে বার করে তাঁর রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা - হয়তো কোন হাসপাতালেই আলদা করে কোন ফ্যাকাল্টি নেই ভারতে। শুনেছি JIPMER, Pondichery একটি ডিপার্টমেন্ট করার কথা ভাবা হচ্ছে।  সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে হুগলী শ্রীরামপুরে শ্রমজীবী হাসপাতালে ডাঃ কুণাল দত্তের তত্ত্বাবধানেই এই ডিপার্টমেন্ট টা শুরু হয় কিছুদিন আগে।

কজন জানে অকুপেশনাল ডিজিজ এর মধ্যে খাদান খনিতে কাজ করছন যে যে শ্রমিকেরা - প্রত্যেকের ৪০ বছরের পরেই দেখা যায় সিলিকোসিস?
মানুষের দাম কোথায়?


 

2 Comments

Rabin Chaktaborty

29 March, 2025

পেশাগত অসুখের বাপারে সাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এই লেখার জন্য ধন্যবাদ লেখককে। তার সাথে ধন্যবাদ জানাবো ডাক্তার কুণাল দত্তকে, তাঁর এই অসুখের অস্তিত্ব প্রমাণের নিরলস প্রয়াসের জন্য। আক্ষেপ হয় পেশাগত অসুখের ব্যাপারে শ্রমিক সংগঠনগুলির উদাসীনতা দেখে।

Post Comment