পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

অসমের বন্দীশিবির যেন নাৎসি ডিটেনশন ক্যাম্প

  • 19 November, 2019
  • 0 Comment(s)
  • 2688 view(s)
  • লিখেছেন : মিলন দত্ত
আন্তর্জাতিক আইন বলছে, বিদেশীদের জেলে বন্দী করে রাখা যায় না। তাঁদের সঙ্গে অপরাধীর মতো ব্যবহার করা যায় না। কোনও দেশে অবৈধভাবে কেউ বসবাস করলে তাঁদের মুক্ত শিবিরে নজরবন্দী করে রাখা যেতে পারে। জেলে কখনই আটক করে রাখা যায় না। এটা ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নিয়মাবলীর সরাসরি লঙ্ঘন। অসমের বন্দীশিবিরগুলোতে সেটাই ঘটে চলেছে।

অসমের যাঁদের বিদেশী ট্রাইব্যুনাল ইতিমধ্যেই বিদেশী বলে চিহ্নিত করেছে তারা কোথায় কেমন আছেন সেটা দেখলেই, বিদেশী বলে যাঁদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া চলছে সেই ১৯ লাখ মানুষের অবস্থাটা কী হবে, তার একটা আন্দাজ আমরা পেতে পারি। ইতিমধ্যে বিদেশী বলে চিহ্নিত মানুষদের অসমের বিভিন্ন জেলের মধ্যেই গড়ে তোলা বন্দীশিবিরে রাখা হয়েছে। বেশ কিছু মানুষ তো গত এক দশক ধরে এই ভাবে বন্দীশিবিরে আছেন। ছাড়া পাওয়ার কোনও আশা সম্ভবত তাঁরা আর দেখেন না। ওইসব বন্দীশিবিরগুলোতে মানবাধিকার সংগঠন বা মানবাধিকার কর্মীদের প্রবেশ নিষেধ। ফলে এইসব শিবিরের মানুষদের অবস্থা কখনই সাধারণ মানুষের সামনে আসে না।

২০১৭ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যখন মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মন্দারকে সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ পর্যবেক্ষকের পদে নিয়োগ করলে তিনি অসমের এই বন্দীশিবিরগুলো ঘুরে দেখার আবেদন জানান। ২০১৮ সালের ২২ থেকে ২৪ জানুয়ারি তিনি গোয়ালপাড়া আর কোকড়াঝাড়ের জেলের মধ্যে যে বিশেষ বন্দীশিবির রয়েছে সেগুলো ঘুরে দেখেন। সেখানে বন্দীদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। মানবিক এবং আইনগত— দু’দিক থেকেই ওই বন্দীশিবিরগুলোর ভয়াবহ অবস্থা দেখে তিনি শঙ্কিত হয়েছিলেন। বন্দীশিবির নিয়ে হর্ষ মন্দারের করা রিপোর্ট কিন্তু আজও প্রকাশিত হয়নি। বারে বারে মনে করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও মানবাধিকার কমিশন, কেন্দ্র অথবা রাজ্য সরকার তাঁকে জানায়নি যে, বন্দীশিবির নিয়ে তিনি যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন তার পরিণতি কী হল।

এর পরে তিনি সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ পর্যবেক্ষকের পদটি ত্যাগ করেন। বন্দীশিবির নিয়ে যে রিপোর্ট তিনি জমা দিয়েছিলেন সেটা প্রকাশ করে দেন। রিপোর্টে তিনি জানান, ওই সব বন্দীশিবিরে বিদেশী বলে চিহ্নিত যে মানুষরা আটক রয়েছেন তাঁদের বেশীরভাগই ন্যূনতম আইনি সহায়তা পান না। অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশী ট্রাইব্যুনালে ওই মানুষেরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাননি। বেশীরভাগ মানুষকেই নজরবন্দী করে রাখা হয়েছে এই কারণে যে, ট্রাইব্যুনাল বার বার নোটিশ পাঠানোর পরেও তাঁরা হাজিরা দেননি। তবে বন্দীশিবিরের বেশীরভাগ মানুষই হর্ষকে জানিয়েছিলেন, ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দেওয়ার জন্য কোনও নোটিশ তাঁরা পাননি।

মানবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার কারণে এ দেশে ধর্ষণ বা খুনের মতো কঠিন অপরাধে অভিযুক্তদেরও আইনি সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু অবৈধ বিদেশী নাগরিক চিহ্নিতকরণের মামলায় অপরাধ না করা সত্ত্বেও বহু মানুষ বন্দীশিবিরে জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন, মামলা লড়ার আইনি সাহায়তা পাচ্ছেন না বলে। সাধারণ জেলের মধ্যেই একটা অংশে ওই বন্দীশিবির তৈরি হয়েছে। অনেক কয়েদীকে বছরের পর বছর বন্দী থাকতে হচ্ছে। এঁদের না দেওয়া হয় কোনও কাজকর্ম, না বিনোদনের সামান্যতম সুযোগ। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করারও কোনও সুযোগ নেই তাঁদের।

অন্যান্য জেলের কয়েদীদের অন্তত হাঁটাহাঁটি করার বা খোলা আকাশের নীচে সময় কাটানোর সুযোগ থাকে। কিন্তু বিদেশী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে যাঁদের, তাঁদের সেই সুযোগও নেই। দিনের বেলাতেও তাঁদের ব্যারাকের মধ্যে কাটাতে হয়। কারণ অন্য কয়েদী অর্থাৎ ভারতীয় নাগরিকদের সঙ্গে মেলামেশা করার অধিকার দেওয়া হয় না তাঁদের। ওই সব জেলে ঢুকে তিনি দেখেছেন, স্বামী স্ত্রী আর ছয় বছরের অধিক বয়সী শিশুদের পরিবারের থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। অনেকেই আছেন, যারা নিজের জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে অনেক বছর দেখা করতে পারেন নি। নিজের স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আইনি অনুমতি না থাকলেও জেলের অফিসাররা মাঝে মাঝে দয়া করে নিজেদের মোবাইল ফোন থেকে আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। আত্মীয় স্বজনের অসুখবিসুখ বা মৃত্যু হলেও প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার অনুমতি পান না এঁরা। যুক্তিটা হল, প্যারোলে কিছুদিনের জন্য মুক্তি পাওয়ার অধিকার একমাত্র সাজাপ্রাপ্ত ভারতীয় বন্দীদেরই রয়েছে।

মানবাধিকার কমিশনের কাছে হর্ষ মন্দারের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শটা ছিল, সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বন্দীশিবিরের বাসিন্দাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। জেলের ভেতরে কোনও সুযোগ সুবিধা না দিয়ে সাধারণ কয়েদীদের সঙ্গে এঁদের বন্দী করে রাখা বা আইনি সহায়তা না দিয়ে আটক রাখা, পরিবার পরিজনের সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়া আর সর্বোপরি সম্মানের সঙ্গে জীবনধারণের অধিকার কেড়ে নেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। আন্তর্জাতিক আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে যে, বিদেশীদের জেলে বন্দী করে রাখা যায় না। তাঁদের সঙ্গে অপরাধীর মতো ব্যবহার করা যায় না। মানবিক আর আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের কোনোভাবেই তাঁদের পরিবারের থেকে আলাদা করে রাখা যায় না। কোনও দেশে অবৈধভাবে কেউ বসবাস করলে তাঁদের মুক্ত শিবিরে নজরবন্দী করে রাখা যেতে পারে। জেলে কখনই আটক করে রাখা যায় না। আর এইসব মানুষদের অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলে বন্দী করে রাখা ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নিয়মাবলীর সরাসরি লঙ্ঘন।


0 Comments

Post Comment