পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

যে আমেরিকার মধ্যে আছে আরেক আমেরিকা

  • 24 February, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1840 view(s)
  • লিখেছেন : পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
মার্কিনপন্থী ভারতীয় ও বাঙালিরা মঙ্গলগ্রহ বা নাসা নিয়ে যতই নাসাগ্র ফোলান না কেন, তাঁদের উচ্চনাসা আরো অনেকগুলো দরকারি বিষয়কে সুকৌশলে এড়িয়ে যান। মঙ্গলগ্রহে যাবার অতি অবিশ্বাস্য অঙ্কের অর্ধেক ব্যয় করলে আমেরিকার মানুষের পেট ভরে খাওয়া জুটতো, মাথার ওপরে ছাদ জুটতো, আর স্বাস্থ্যসঙ্কট, শিক্ষাসঙ্কট, পরিবেশ ও জলবায়ুসঙ্কট থেকে মুক্ত হওয়া যেতো।

আমেরিকার পার্সিভিয়ারেন্স নামক মঙ্গলগ্রহের মহাকাশযান, এবং ৫০০০০০ (পাঁচ লক্ষ) কোভিড মৃত্যু -- একই সময়ে।

টেক্সাসে তুষারঝড়ে এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের এই মুহূর্তে জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, রাস্তায় দাঁড়িয়ে সরকারি সাহায্য নিচ্ছে, খাবার নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ।

একশোর ওপর মার্কিনি মৃত। না শুধু "কালুয়া"রা নয়। "স্প্যানিশ"রা নয়। বেশির ভাগই সাদা চামড়ার আমেরিকান।
____________

মার্কিনপন্থী ভারতীয় ও বাঙালিরা "আমেরিকার মঙ্গলগ্রহ বিজয়ে" উৎফুল্ল, উল্লসিত। আহা, ঠিক যেন মেসির গোল। নাকি, বিরাটের ছক্কা।

ঠিক যেমন সেই আমাদের ছাত্রজীবনে নীল আর্মস্ট্রংয়ের চাঁদের মাটিতে অবতরণ নিয়ে আমরা উল্লসিত হয়েছিলাম। যার অনেকটাই মিডিয়া-ফেনায়িত। কারণ, নীল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে নামার অনেক আগেই সোভিয়েট ইউনিয়ন চাঁদের মাটিতে মানুষকে না নামিয়েও সমস্ত পরীক্ষানিরীক্ষা করে ফেলেছিলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন রাশিয়াকে পৃথিবীর চোখে টেক্কা দেওয়ার জরুরি তাগিদেই অ্যাপোলো মিশন করে। আমেরিকার মানুষকেও বোঝানো দরকার ছিল আমরা রাশিয়ার থেকেও উন্নত দেশ।

যাই হোক, আজ রাশিয়ার ভরাডুবি হয়েছে, এবং স্তালিনবাদী কমিউনিজমের চরম পতন হয়েছে। রাশিয়াতে এখন নতুন স্বৈরতন্ত্র, এবং বিরোধী নেতা জেলে বন্দী। আমেরিকায় কোনো বিরোধী নেতা জেলে বন্দী নেই। সুতরাং, আমেরিকা এখন রাশিয়ার থেকে অনেক উন্নত দেশ, একথা স্বীকার করতে বাধা নেই।

কিন্তু মার্কিনপন্থী ভারতীয় ও বাঙালিরা মঙ্গলগ্রহ বা নাসা নিয়ে যতই নাসাগ্র ফোলান না কেন, তাঁদের উচ্চনাসা আরো অনেকগুলো দরকারি বিষয়কে সুকৌশলে এড়িয়ে যান। কারণ, তাঁদের পছন্দের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিস্টেম সেসব কথাকে হয় মিথ্যে, আর নয়তো "সে আর কী করা যাবে, সারা পৃথিবীতেই একই রকম" -- বলে দায়মুক্ত হয়ে থাকেন। তাঁদের পছন্দের মিডিয়া ও নেতা নেত্রীরা কখনোই সেসব কথাকে পাত্তা দেননা।

শিক্ষিত মানুষের ডিনার টেবিলে এসব আলোচনা কখনো স্থান পায়না। তাঁদের শৈশব থেকে আমেরিকার স্বপ্নে লালিতপালিত ছেলেমেয়েরা যাতে এসব কথা কখনো জানতে না পারে, বাবা মা অভিভাবক শিক্ষক শিক্ষিকা এবং মিডিয়া টিভি খবরের কাগজ বলিউড টলিউড ও ঢালিউড সযত্নে সেসব কথা "জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই" -- এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে জীবন থেকে বর্জন করেন। কারণ জানতে পারলে নিজেদেরও বিবেকদংশন, আর ছেলেমেয়েরাও হাজার প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করবে।

কী দরকার? "জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।"

এক বছরেরও কম সময়ে আমেরিকায় ৫০০০০০ (পাঁচ লক্ষ) মানুষ করোনাভাইরাসে মৃত। হাজার হাজার মানুষ রেফ্রিজারেটর ট্রাকে নিথর শুয়ে আছে, কারণ গণকবর দেওয়ার জায়গা নেই। আমেরিকার জেলগুলোতে সারা পৃথিবীর সমস্ত বন্দীর এক চতুর্থাংশ বন্দী আছে -- যার এক বিরাট সংখ্যক বিনা বিচারে। দাসের মতো খাটছে তারা, পাথর ভাঙছে, অমানুষিক পরিশ্রম করানো হচ্ছে তাদের দিয়ে প্রায় বিনা পয়সায়।

আমেরিকায় প্রতি ছজন শিশুর মধ্যে একজন অর্থাৎ ১৬% দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকে। আমেরিকায় সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হোমলেস, গৃহহীন। আমেরিকায় ড্রাগ-এ্যাডিক্ট বা মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

আমেরিকায় সারা দেশে যতগুলো পেট্রোল পাম্প আছে, তার চেয়ে বেশি বন্দুক ও গোলাবারুদের দোকান আছে। আমেরিকায় শিশুদের ইস্কুলে ঢুকে গুলি চালিয়ে শিশু মেরে ফেলা হয়েছে নির্বিচারে। এখন সে খবরকে চাপা দেওয়া হয়েছে, এবং কিছু লোক গুজব ছড়াচ্ছে, পুরো ব্যাপারটাই নাকি সাজানো। মৃত শিশুর বাবা-মাকে মৃত্যুভয় দেখানো হচ্ছে।

আমেরিকায় পুলিশি বর্বরতা সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

আমেরিকায় সারা পৃথিবীর "উন্নত" বা ধনী দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অশিক্ষিত -- প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন কখনো কলেজে যায়নি।

আমেরিকায় কোনো হাই স্পীড ট্রেন নেই, এবং গণ পরিবহন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। আমেরিকার ৯০% শহরে ও গ্রামে কোনো বাস ট্রাম ট্রেন নেই, বা থাকলেও নামমাত্র আছে। আমেরিকা "উন্নত" বা ধনী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধর্মান্ধ ও মুসলিম ও ইমিগ্রেন্ট-বিদ্বেষী।

আমেরিকার মিডিয়াতে আমাদের দেশের সম্পর্কে কখনোই কোনো ইতিবাচক আলোচনা করেনা। আমার পঁয়ত্রিশ বছরের আমেরিকা জীবনে আমি ভারত বা বাংলাদেশ নিয়ে কখনো কোনো কথা তেমন শুনিনি। হ্যাঁ, সন্ত্রাসী ঘটনা বা ঘূর্ণিঝড় বা ভূমিকম্পের কারণে কত লোক মারা গেছে এবং দুর্দশায় আছে, তা শুনেছি, চব্বিশ ঘন্টা দেখেছি সিএনএন বা নিউ ইয়র্ক টাইমসে।

যাই হোক। কয়েকজন বাঙালি ও ভারতীয় ছাত্রছাত্রীর লেখালেখির কারণে এই কথাগুলো লিখে ফেলতে বাধ্য হলাম। মঙ্গলগ্রহে যাবার আগে সেই অতি অবিশ্বাস্য অঙ্কের অর্ধেক ব্যয় করলে আমেরিকার মানুষের পেট ভরে খাওয়া জুটতো, মাথার ওপরে ছাদ জুটতো, আর স্বাস্থ্যসঙ্কট, শিক্ষাসঙ্কট, পরিবেশ ও জলবায়ুসঙ্কট থেকে মুক্ত হওয়া যেতো।

চাঁদের মাটিতে পা দেওয়ার মতোই মঙ্গলগ্রহে রোভার অবতরণ একটি আন্তর্জাতিক পলিটিক্যাল স্টান্ট। আমরা যতই রাত জেগে তা দেখিনা কেন, আমেরিকার মধ্যেই অন্ততঃ অর্ধেক মানুষ এ বিষয়ে কোনো খবরই রাখেন না। রাখার শিক্ষা, ইচ্ছা ও সময় কোনোটাই তাঁদের নেই।

এদেশে এখনো, এই সেদিনই আমেরিকার সম্পূর্ণ ভোটারসংখ্যার প্রায় অর্ধেক -- প্রায় ১৬ কোটি পুরুষ ও নারী -- ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, এবং তাঁদের মধ্যে এক বিশাল সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করেন, বিজ্ঞান ও আধুনিক চিকিৎসা নয়, গবেষণা ও প্রযুক্তি নয়, গির্জায় গিয়ে রবিবার যীশুর কাছে প্রার্থনা করলেই সমস্ত রোগের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে।

তাঁরা মনে করেন, এই ৫০০০০০ (পাঁচ লক্ষ) মৃত্যুসংখ্যা একটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। তাঁরা ভ্যাকসিনে বিশ্বাস করেন না। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, কোভিড একটি চীনা ষড়যন্ত্র, এবং ইমিগ্রেন্ট, ব্ল্যাক ও মুসলমানরা এই মহামারী ছড়ানোর জন্যে দায়ী।

কে জানে, ওই মার্কিনপন্থী ভারতীয় ও বাঙালিরাও তাই বিশ্বাস করেন কিনা।

ও হ্যাঁ, টেক্সাসের কথাটা একটু গুগল সার্চ করে নিন। টিভিতে দেখাবে না। কাগজেও বেরোবে না তেমন। ওখানে প্রলয় হয়ে গেছে। টেক্সাসে তুষারঝড়। অনেকটা আমগাছে কাঁঠালের মতোই। যা হতে পারেনা, তাই এখন হচ্ছে জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে। এবং অর্থনীতির সম্পূর্ণ লাগামছাড়া বেসরকারিকরণের কারণে।

অবশ্য ওই মার্কিনপন্থী ভারতীয় ও বাঙালিরা সেকথাও হেসে উড়িয়ে দেবেন।

0 Comments

Post Comment