পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কেন্দ্রে – রাজ্যে একই দলের সরকার হলে কি সত্যিই সবাই উপকৃত হবেন ?

  • 12 March, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1893 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন সেনগুপ্ত
ডবল ইঞ্জিন সরকার হলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? ত্রিপুরাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ২০১৮ সালে বলেছিলেন যে বিজেপি যদি একবার ক্ষমতায় আসে তাহলে তাঁরা সপ্তম পে কমিশন চালু করবেন, কিন্তু তার পর থেকে আর অমিত শাহ ত্রিপুরা যেতে পারেননি। উল্টে সরকারী চাকরীই লাটে উঠছে ত্রিপুরাতে। তাহলে যারা আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখে গ্যাসের দাম হাজার টাকা দিচ্ছেন তাঁরা কি করে আবার সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখছেন? যাহা চকচক করে তাহাই কিন্তু সোনা নয়- এটি একটি প্রাচীন প্রবাদ।

ইদানীং রাস্তাঘাটে একটা আলোচনা শোনা যাচ্ছে যে দীর্ঘদিন কেন্দ্র- রাজ্যের দ্বন্দ্ব দেখা হয়েছে, এবার রাজ্যে এবং কেন্দ্রে একই দলের সরকার হলে ভালো হয়। দীর্ঘ ৩৪ বছর বাম শাসনে যা সমস্যা ছিল, তৃনমূলের ১০ বছরেও একই রকম অসুবিধা চলছে এবার যদি কেন্দ্রে এবং রাজ্যে একই সরকার থাকে, তাহলে উন্নয়ন বা বিকাশ কে ঠেকায়? ঠিক যেমন ২০১৪ সালে হাওয়া উঠেছিল, ‘অনেক হয়েছে অত্যাচার, এবার কেন্দ্রে মোদী সরকার’ কিংবা ‘ অনেক হয়েছে, কৃষকদের ওপর অত্যাচার, বা অনেক হয়েছে মহিলাদের ওপর অত্যাচার, এবার আসবে মোদী সরকার’। এই প্রচারে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, অনেকেই ভেবেছিলেন যে সত্যি সত্যিই একটা শক্তিশালী সরকার আসতে চলেছে কেন্দ্রে। আসলে গোটা প্রচারটাই করা হয়েছিল দোদুল্যমান ভোটারদের প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে। সেই সময়ে যদি খেয়াল করা যায় বিজেপির কিন্তু সাংগঠনিক ক্ষমতা এমন কিছু ছিল না, এখনো যে তা আছে তা জোর দিয়ে বলা যায় নয়, কিন্তু শুধুমাত্র প্রচার এবং কিছু তথ্য সংশ্লেষণ করে তাঁরা বুঝতে পেরেছিল যে সাধারণ মানুষ অত রাজনীতি বোঝে না, তাঁরা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চান, তাঁরা সেই জায়গা থেকেই বিভ্রান্ত হয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। তাঁরা কিন্তু সত্যিই গুজরাট মডেলের প্রচারে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁরা কিন্তু সত্যিই ভেবেছিলেন, যেহেতু গুজরাটে বিজেপির সরকার আছে, কেন্দ্রেও বিজেপি সরকার আসলে হয়তো গুজরাটের মডেলের মতো সারা দেশের উন্নয়ন হবে। কিন্তু সত্যিটা কি ছিল ? গুজরাট মডেল কি সত্যিই অনুকরণ যোগ্য? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে প্রাক্তন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি যখন গুজরাটে গেছিলেন, ২০১৯ সালে, সেই রাজ্যের দরিদ্র মানুষ যাতে আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমের চোখে না পড়ে, উঁচু প্রাচীর তোলা হয়েছিল কেন? কি লুকোনোর জন্য?

এবার তাহলে একটু দেখে নেওয়া জরুরী- গুজরাট মডেলের কতটা সত্যতা আছে? নাকি এর বেশীরভাগটাই প্রচারের ঢক্কানিনাদ ? লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের অধ্যাপক মৈত্রিশ ঘটক লিখেছিলেন যে প্রদীপের নীচেই যে অন্ধকার থাকে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল- গুজরাট। বৃদ্ধির সংখ্যার সুচক যতই বেশী করে দেখানো হোক না কেন, দারিদ্র অসাম্য বা মানব সম্পদ উন্নয়ন সুচকে গুজরাট কিন্তু দেশের মধ্যে বেশ নীচের দিকে। মধ্যবিত্তের বা উচ্চবিত্তের উন্নতি হলেও দরিদ্র মানুষের কাছে কিন্তু এই উন্নয়ন চুইয়ে চুইয়ে পৌঁছয়নি। ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশের মধ্যে দারিদ্র সীমার নীচের সুচকে গুজরাটের স্থান ১৩ তম। অন্যান্য সুচকের দিকে তাকালেও মোটামুটি দৃশ্যটা প্রায় একই রকম। শিশু মৃত্যুর হারে গুজরাটের স্থান সপ্তদশ। লিঙ্গ অনুপাত যদি দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে, তাতেও গুজরাটের স্থান একবিংশতম। অর্থাৎ পুরুষের তুলনায় মহিলার সংখ্যা নিম্নগামী। সমস্ত এই ধরনের সূচককে এক জায়গায় করলে গুজরাটের স্থান দশম। নরেন্দ্র মোদী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সেই সময়ের হিসেব নিয়েই কিন্তু এই সুচক তৈরী হয়েছে,এবং এগুলো সবই সরকারী তথ্য। তাহলে কিসের এতো প্রচার? কিসের এতো বলা ক্ষমতায় এলে গুজরাট মডেল করে দেওয়া হবে? তাহলে উন্নয়ন কি সমাজের কিছু মানুষের জন্য, বাকি মানুষেরা কি তা থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবেন? আরও বেশ কিছু অসরকারী প্রতিস্থানের তথ্য অনুযায়ী দক্ষিণ ভারতের তামিলনাডু, কর্ণাটক এবং কেরালাও বিভিন্ন সুচকে গুজরাটের থেকে এগিয়েই আছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কথাও যদি ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা এবং তামিলনাডুও গুজরাটের চেয়ে এগিয়ে, তাহলে কেন বলা হবে গুজরাট মডেল, কেন অন্য কোনও রাজ্যের উদাহরণ দেওয়া হবে না?

২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী গুজরাটে প্রায় ৪৯ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। ৬ লক্ষ গুজরাটি যুবক বেকার, তার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও উপযুক্ত চাকরি পায়নি, এবং বেকারত্বের নিরিখে এই সংখ্যাটা ৬.৮ শতাংশ এবং তা দেশের গড়ের চেয়ে বেশী। নোটবন্দী এবং জিএসটির পর প্রায় ৬০ হাজার ছোট কারখানা বন্ধ হয়েছে এবং বহু ছোট ছোট ব্যবসায়ী দেনায় ডুবে আছেন। করোনার লকডাউনে এই সংখ্যা বেড়েছে ছাড়া কমেনি। আসলে গুজরাট মডেলের মধ্যে যেটা আছে, তা হল, কিছু নির্দিষ্ট পছন্দমতো মানুষের উন্নয়ন। তাঁদের তৈরি করা শিল্পনীতিতে কিন্তু বেকার যুবকের চাকরি হয়না। হলেও তা এতোটাই অল্প সংখ্যক মানুষের হয়, তাতে খুব বেশী লাভ সাধারণ মানুষের হয় কি? কিন্তু এই কথাগুলো কখনোই প্রথম সারির দৈনিক কিংবা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে দেখানো হয়না বা প্রচারে আসে না। ফলে মানুষকে ভুল বোঝানো যায় এবং মানুষ সেই প্রচারে মুগ্ধ হয়ে ভাবতে শুরু করেন কেন্দ্রে এবং রাজ্যে একই দলের সরকার আসলে হয়তো উন্নয়ন হবে।

এবার আসা যাক অন্য আর একটি রাজ্যের দিকে, যে রাজ্যের কথা ইদানীং বারবার উঠে আসছে। উত্তরপ্রদেশ, যা নাকি রাম রাজ্য, সেই রাজ্যে কি চলছে ? বেশ কিছু সর্বভারতীয় বৈদ্যুতিন মাধ্যম দেখানোর চেষ্টা করেছে যে সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নাকি দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী, এবং সেই রাজ্যে নাকি এতো মানুষ আনন্দে আছেন তাঁরা সকলে যোগী আদিত্যনাথকে আগামী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই এতো বড় করে যে প্রচার করা হচ্ছে তার মধ্যে সত্যতা কতটুকু?

একদিকে হাথরাসের মতো, উন্নাওয়ের মতো ঘটনা ঘটবে আর অন্যদিকে বিভিন্ন প্রথম সারির দৈনিকে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন থাকবে, উত্তর প্রদেশ নাকি দ্রুততার সঙ্গে উত্তম প্রদেশ হতে চলেছে। একদিকে বিচার ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করে দাগী অপরাধীদের গুলি করে মারা হবে, আর অন্যদিকে বলা হবে অপরাধ কমে গেছে। একদিকে নিজের ভাবমুর্তি উজ্জ্বল করতে নিজের ওপর থাকা সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে আর অন্যদিকে অযোধ্যায় লক্ষ লক্ষ প্রদীপ জ্বালিয়ে দীপাবলি পালন করে, এবং তা ফলাও করে প্রচার করে দেখানো হবে, মানুষ কত ভালো আছেন। প্রথম সারির একটি দৈনিকে এক পাতা বিজ্ঞাপনের খরচ কত? কিংবা সেই খরচের উদ্দেশ্য কি ? মুর্তির থেকে ভাবমুর্তি উজ্জ্বল করে দেখানোটাই কি তবে উদ্দেশ্য? আগে একবার দেখানো হয়েছিল গুজরাট মডেল, এখন দেখানো হচ্ছে উত্তরপ্রদেশ মডেল। কিন্তু কখনোই কি আলোর নীচেই যে অন্ধকার আছে তা দেখানো হচ্ছে? নাকি এর মধ্যে দিয়ে গুজরাট মডেলের যে আসল সত্যি তা লুকিয়ে অন্য কিছু সামনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। গুজরাট মডেল মানেই কিন্তু এখনো মানুষ বোঝেন গুজরাট দাঙ্গা, যাতে প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ, যাতে ধর্ষিতা হয়েছেন প্রচুর মহিলা। উত্তরপ্রদেশ মানে কিন্তু রাতের অন্ধকারে দলিত মহিলার দেহ পুড়িয়ে দেওয়াও থাকে। কেন্দ্রে ও রজ্যে একই দলের সরকার দেখতে চাইলে কিন্তু এই দৃশ্যও দেখতে হবে। একটা কথা বলে লেখাটা শেষ করা যাক নগর পুড়লে কিন্তু দেবালয়ও বাদ থাকবে না, যারা ভাবছেন শুধু নিজের এবং আশেপাশের কিছু মানুষের বাড়ি, গাড়ি থাকাটাই উন্নয়নের সুচক, তাঁরা আবারও সেই ভুলের ফাঁদেই পা দিচ্ছেন। উন্নয়ন মানে সমগ্র মানুষের উন্নয়ন, মানব জাতির উন্নয়ন। ঝাঁ চকচকে শপিং মল তৈরী করাটাই কিন্তু উন্নয়নের মাপকাঠি নয়। ওই শপিং মলের নীচেই হয়তো আছে কোনও বন্ধ কারখানার শ্রমিকের পরিবারের কান্না। উন্নয়ন মানে কিন্তু শুধু কিছু উড়ালপুল নয়, উন্নয়ন মানে কোনও দরিদ্র মানুষের বুকের ওপর দিয়ে কোনও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দামী গাড়ি চলে যাওয়া নয়। উন্নয়ন মানে আরও অনেক কিছু। উন্নয়ন মানে জেলা সদরে কিছু মাল্টিপ্লেক্স নয়, উন্নয়ন মানে চা বাগানের শ্রমিকটির মজুরির ও উন্নয়ন।পরিবেশ, নদী সব বাঁচিয়ে শেষতম মানুষটির জীবনযাত্রার মানেরও উন্নয়ন। তাই কেন্দ্র-রাজ্যে একই সরকারের নামে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো না দুর্বল করে, শক্তিশালী রাজ্যের দাবিই হোক – একুশের ডাক, জনগণের দাবি।

0 Comments

Post Comment