পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মননের আঁতুড়ঘরে এয়ার স্ট্রাইক

  • 14 May, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 392 view(s)
  • লিখেছেন : শুভমন
অপপ্রচারের এই অন্ধকার সময়ে হামেশাই আঘাত হানা হয় দায়িত্বশীল সংবাদ সংস্থার উপরে। পাশাপাশি বাড়তে থাকে মোসাহেব মিডিয়ার রমরমা। কিন্তু মানুষকে যুদ্ধোন্মাদনায় যদি প্ররোচিত করা যায়, তবে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবেই তাকে অ্যান্টি ভেনম দেওয়াও সম্ভবপর। সেক্ষেত্রে সুচিন্তক নাগরিকের উপর আরও বেশি করে দায়িত্ব বর্তায় গড্ডলিকায় গা না ভাসিয়ে সুবিবেচকের দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজকে দিশা দেখানোর।

আইপিএলে আত্মরতি অনুভবী একটা জাতির অনেকেরই হয়তো খেয়াল নেই যে তাবৎ বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে নাইট ওয়াচম্যান হিসেবে সর্বোচ্চ স্কোর তথা ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানোর তকমাটি জেসন গিলেসপির। তা সত্ত্বেও পরের টেস্টের প্রথম এগারোয় জায়গা জোটেনি অসি পেসারটির। কারণ দলে তার জায়গা ছিল বোলার হিসেবে, ব্যাটসম্যান তথা ব্যাটার রূপে নয়। আর সে টেস্টে তার বোলিং মোটেও আশানুরূপ ছিল না। কাজেই রাত পাহারার দ্বিশত রান গিলেসপির ওভারঅল পারফর্মেন্সকে মান্যতা দিতে পারে না। যেমন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক পরবর্তী সাংবাদিক সম্মেলনে সোফিয়া খুরেশির আনয়নও সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে কোনো নারীর, এমনকি ধর্মীয় সংখ্যালঘু নারীর ব্যক্তিগত সাফল্য ও সমান অধিকারের দৃষ্টান্ত স্বরূপ যথোপযুক্ত হলেও, যুদ্ধের যৌক্তিকতাকে তা মান্যতা দিতে পারে না। কিন্তু জহ্লাদের উল্লাসভূমিতে যুক্তির ধার ধারে আর কে? ততক্ষণে আপামর ভারতবাসী যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছে সমাজমাধ্যমের দেয়ালচিত্রে।

কবির পোষাক পরিহিত কবিতা প্রয়াসী, স্বগোষ্ঠী সমাদৃত বর্ষীয়ান সাহিত্যিক, নয় ছত্র কলম পিষে ছয়টি পুরস্কার বগলদাবাকৃত সাহিত্য নয়-ছয়কারী গল্পকার, মোসাহেবমণ্ডিত শিল্পী, সুযোগসন্ধানী রাজনীতিজীবী, অধ্যাপক থেকে আধিকারিক, চিকিৎসক থেকে চিত্রপরিচালক সকলেই কে বা আগে প্রাণ করিবে গো দান তারই লাগি কাড়াকাড়ি। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাঙালির শঙ্খ ঘোষ আর বেঁচে নেই। তবে এই মেধাসন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্ত যতটা মধ্যবিত্তীয় ও নগরকেন্দ্রিক, তীব্রতায় সে ততটা গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের নয়। এটুকু পড়েই স্বভাবতই রে রে করে উঠেছে পাঠক মহোদয়। কী বলছেন কী মশাই! সন্ত্রাসবাদকে সমূলে উৎপাটন করার এমন উদ্যোগে উৎসাহী হব না? তবে কিসের আর দেশপ্রেম? পাকিস্তানকে রগড়ে দিতে না পারলে কিসের বিজয়োল্লাস? হিজ মাস্টার্স ভয়েস, থুড়ি হিজ মাস্টারস্ট্রোকটা তো দেখুন। একেবারে সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘরে গিয়ে এয়ার স্ট্রাইক। এয়ার স্ট্রাইক হয়েছে ঠিকই। তবে তা আমাদের চিন্তার আঁতুড়ঘরে। আর যুদ্ধ উন্মাদনায় মোহান্ধ আমরা ভুলতে বসেছি মানব সভ্যতার ইতিহাসে যুদ্ধ কোনো দিন সন্ত্রাসবাদকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি, বরং তা জন্ম দিয়েছে নতুনতর সন্ত্রাসবাদেরই। সন্ত্রাসীরা নয়, বিশ্বের প্রতিটি যুদ্ধেরই শিকার হয়েছে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ সাধারণ মানুষ। বাদ পড়েনি নারী, বৃদ্ধ, শিশুরাও। প্রত্যক্ষ ধ্বংসলীলার পাশাপাশি পরোক্ষ ক্ষতির খতিয়ানটিও সেখানে বরাবরই অপরিমেয়। পহেলগাঁওয়ে প্রাণ গিয়েছিল ২৬ জন নিরপরাধ পর্যটকের। তার প্রত্যাঘাতে ইতিমধ্যেই নিহত ও আহতের সংখ্যাটা ছাপিয়ে গেছে ছাব্বিশকে। নিরপরাধ মানুষ মরেছে দুই পারেই। আচ্ছা, দেশের মধ্যে কোনো মানুষের যদি ঘাতকের হাতে মৃত্যু হয়, মৃতের পরিবারবর্গ কি প্রতিশোধস্পৃহায় আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে? ফিরে সেই ঘাতককে খুন করার অধিকার জন্মায় কি? বুদ্ধ, গান্ধীর সন্তান সন্ততিরা কী বলেন এ বিষয়ে?

যুদ্ধের প্রথম সারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হন সৈনিকেরা। কিন্তু যুদ্ধের সিদ্ধান্ত তাঁদের হাতে নয়। রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে তাঁরা নিছক আজ্ঞাবহ। যুদ্ধে দু পক্ষেই প্রাণহানি অঙ্গহানি হয় অসংখ্য। আর ততোধিক হয় সম্পদহানি। এ সময়ে কালোবাজারির কথা তো সর্বজনবিদিত। আর এই এত এত অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, এত গোলাগুলি, বোমাবর্ষণ, বিস্ফোরণ, ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ, বিমান ধ্বংস - এ সবের সম্মিলিত আয়োজনখানি নীলগ্রহের পরিবেশে কতখানি দূষণ ছড়ায়? যুদ্ধবিমানগুলির নিরন্তর চরকিপাক কতখানি পোড়ায় জীবাশ্ম জ্বালানি? কতখানি কার্বন মনোক্সাইড নির্গত হয় কাঁটাতার না মানা পাখির আকাশে? সে সব সন্ত্রাস নয়?

 

জেনেভা অ্যাকাডেমির ⊃1; রিপোর্ট অনুযায়ী এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ঘটমান ছোটো বড় সশস্ত্র সংঘর্ষের সংখ্যাটি ১১০-এরও বেশি। এত যুদ্ধ হয় কেন? যুদ্ধ কেন হয়? যুদ্ধের নিয়ন্ত্রক কারা? কারাই বা লাভবান হয় এর মাধ্যমে? ইতিহাস বলছে, যুদ্ধের প্রধান কারণ পুঁজি। যুদ্ধের নিয়ন্ত্রক শক্তিও পুঁজিই। পৃথিবীর যেকোনো যুদ্ধেই লাভবান হয় অস্ত্র ব্যবসায়ী, সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিপতি ও বিজয়ী পক্ষের রাষ্ট্রনায়কেরা। আর যুদ্ধ চাই, যুদ্ধ চাই বলে পরিত্রাহী চেঁচিয়ে যায় যে আমোদগেঁড়ে প্রজাবর্গ, যুদ্ধে অবশ্যম্ভাবীরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারাই। সে বিজয়ী বিজিত যে পক্ষেরই হোক না কেন। এই প্রজাদের গলায় পাড়া দিয়েই যুদ্ধের ব্যয়ভার আদায় করে রাষ্ট্র। কিন্তু করে এমন সুনিপুণ কৌশলে যাতে সচারাচর প্রতিবাদ ওঠে না সর্বসাধারণের থেকে।

গত এক শতাব্দীতে নীল গ্রহে যত যুদ্ধ আয়োজিত হয়েছে প্রায় সবকটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের তরফে যুদ্ধকালীন অপপ্রচার চালানো হয়েছে প্রজাদের সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে। কারণ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকেরা সব দেশে সমস্ত কালেই সংখ্যালঘু। আর সংখ্যাগুরু প্রজা সাধারণের সমর্থন ছাড়া রাষ্ট্রের পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তি জার্মানির বিরুদ্ধে পশ্চিম আফ্রিকান উপনিবেশে ব্রিটিশরা স্থানীয়দের দলে টানতে পোস্টার ক্যাম্পেনিং-এর মাধ্যমে যে অপপ্রচার ⊃2; চালিয়েছিল, তা আজ ইতিহাসের ছাত্রদের পাঠ্যসূচির অংশ। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও যুদ্ধকালীন অপপ্রচার একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। আর এই মগজ ধোলাইয়ের ধরণে একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্যণীয়। যে মানুষ সাধারণ অবস্থায় যুদ্ধবিরোধী, এমনকি যুদ্ধ শুরুর সময়ও যে তথাকথিত শান্তিকামী, এমন বহু মানুষও প্রচারের হুজুগে মেতে একসময় যুদ্ধকামীতে পরিণত হয়। অর্থাৎ তার শান্তিচেতনা ধ্রুব নয়। তা নিয়ে দরকষাকষি করা চলে।

অপপ্রচারের এই অন্ধকার সময়ে হামেশাই আঘাত হানা হয় দায়িত্বশীল সংবাদ সংস্থার উপরে। পাশাপাশি বাড়তে থাকে মোসাহেব মিডিয়ার রমরমা। কিন্তু মানুষকে যুদ্ধোন্মাদনায় যদি প্ররোচিত করা যায়, তবে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবেই তাকে অ্যান্টি ভেনম দেওয়াও সম্ভবপর। সেক্ষেত্রে সুচিন্তক নাগরিকের উপর আরও বেশি করে দায়িত্ব বর্তায় গড্ডলিকায় গা না ভাসিয়ে সুবিবেচকের দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজকে দিশা দেখানোর।

সিজফায়ারকে স্বাগত। তবে মনে রাখা জরুরি যে যুদ্ধান্ত বলে কোনো শব্দের বাস্তবিক কোনো প্রয়োগ নেই। বদলে যা আছে তা নেহাতই যুদ্ধবিরতি মাত্র। কাজেই এই অন্ধকার সময় আসলে সতর্ক থাকার সময়, রাত পাহারার সময়। যুদ্ধের জিগির তোলা প্ররোচনার ড্রোন আক্রমণ মানুষের মনভূমির মাটি ছোঁয়ার আগেই যুক্তিবুদ্ধিবোধের ত্রিমুখী মিসাইল যেন তাকে উড়িয়ে দেয়, গুঁড়িয়ে দেয় মাঝ আকাশে শিক্ষা সম্বলিত প্রত্যাঘাতে।

 

_________________________

 

 তথ্যসূত্র  :

 

1. Academy of international humanitarian law and human rights

2. The National Archives, War time propaganda, how did British try to keep the support of West African peoples. Second World War 1939 - 1945.

0 Comments

Post Comment