প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২-৬ গোলে হারতে হয়েছিল ইরানকে। কিন্তু ম্যাচ শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীতের সময় তাদের দেশের মেয়েদের সামাজিক স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতীয় সঙ্গীতে নীরব থেকে অভিনব মানবিক প্রতিবাদ জানিয়ে ফুটবল বিশ্ব সহ মানবতাবাদী মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছিল ইরানের ফুটবলাররা। কিন্তু তারা যদি বিশ্বকাপের মঞ্চে ভালো কিছু করে দেখাতে না পারে তাহলে নিঃসন্দেহে নিজেদের দেশের সরকারের রোষের শিকার যে তাদের কিছু মাত্রায় হতে হবে তা ইরানের খেলোয়াড়রাও ভালোই জানেন। পাশাপাশি পরবর্তী ম্যাচগুলোতে কাতারের মাটিতে এশিয় দলগুলি সৌদি আরব, জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়া উজ্জীবিত পারফরম্যান্স করে আর্জেন্টিনা আর জার্মানিকে হারিয়ে অঘটন ঘটিয়েছে যথাক্রমে সৌদি আরব আর জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচ অমীমাংসিত রেখেছে উরুগুয়ের বিরুদ্ধে। এর থেকেও নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন আরেক এশিয় দেশ ইরানের খেলোয়াড়রা। তাই ২৫ নভেম্বর দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে অসাধারণ ফুটবল খেললেন ইরানিয়রা। গ্যারেথ বেলের মত তারকা সমৃদ্ধ ওয়েলসকে তারা পরাজিত করলেন ২-০ গোলে। ইরান এই নিয়ে ষষ্ঠবার বিশ্বকাপ ফুটবলের মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তবে ওয়েলস ম্যাচের আগে তারা জিতেছিল মাত্র দুটি ম্যাচে। ১৯৯৮-এর ফ্রান্স বিশ্বকাপে তারা হারিয়েছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে আর ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে তারা পরাজিত করেছিল মরক্কোকে। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের আরেক দেশ ওয়েলস যারা ১৯৫৮ সালের সুইডেন বিশ্বকাপের পর এই প্রথম আবার বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপে নিজেদের তৃতীয় জয় ছিনিয়ে নিল ইরান। ওয়েলস প্রথম ম্যাচ ড্র করেছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় ম্যাচে ইরানের বিরুদ্ধে সিংহভাগ বল নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলে রাখলেও খেলায় প্রতি-আক্রমণের ঝাঁঝ ছিল ইরানিদেরই বেশী। তবে প্রথমার্ধের শুরুতেই একটা সহজ সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল ওয়েলস যার লাভ তারা নিতে পারেনি। সারা ম্যাচে ওয়েলসের দশটা গোলমুখী শটের জবাবে ইরানের বিপক্ষ গোলমুখী শটের সংখ্যা একুশ। এর থেকেই বোঝা যায় আক্রমণাত্মক নীতি পরিগ্রহ করেছিল ইরান। জয়ের জন্য মরিয়া ছিল তারা। দ্বিতীয়ার্ধের ৫১ মিনিটে ইরানের পরপর দুটি গোলমুখো শট দুটি আলাদা আলাদা পোস্টে লেগে ফিরে এলে ইরান প্রায় নিশ্চিত গোল থেকে ভাগ্যের দ্বারা বঞ্চিত হয়। ৮৪ মিনিটে পেনাল্টি বক্সের বাইরে এসে ওয়েলসের গোলরক্ষক হেনসে ইরানি ফরোয়ার্ডকে ভয়ঙ্কর ফাউল করে লাল কার্ড দেখে ম্যাচের বাইরে চলে গেলে বাকি সময় একজন খেলোয়াড় বেশী থাকার এডভানটেজ পায় ইরান। সেই সময় তাদের আক্রমণের ঝাঁঝ আরও বাড়ে। খেলার নির্ধারিত ৯০ মিনিট অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও যখন স্কোরবোর্ড গোলশূন্য ছিল তখন সবাই যখন ধরেই নিয়েছে ম্যাচ অমীমাংসিতভাবে শেষ হতে চলেছে তখনই অতিরিক্ত সময়ের আট মিনিট অতিক্রান্ত হওয়ার পর ওয়েলসের বক্সের বাইরে থেকে দুর্দান্ত শটে গোল করে যান ইরানের রৌজবে চেশমি। পুরো ওয়েলস দল মরিয়া হয়ে গোলশোধ করতে ইরানের অর্ধে উঠে গেলে ঝটিতি সংঘবদ্ধ প্রতি-আক্রমণে রামিন রাজেইয়ান দ্বিতীয় গোল করে ওয়েলসের পরাজয় সুনিশ্চিত করে যান। গ্রুপে তাদের শেষ ম্যাচে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই জয় নিঃসন্দেহে ইরানের খেলোয়াড়দের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস যোগাবে। তাছাড়া ১৯৯৮ আলের ফ্রান্স বিশ্বকাপে এই আমেরিকা যুক্তিরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই কিন্তু ইরান বিশ্বকাপের মূলপর্বে তাদের প্রথম জয় পেয়েছিল। তাই দ্বিতীয় ম্যাচে কার্যকর জয় পেয়ে ইরান যেমন গ্রুপের পয়েন্ট টেবিলে আপাতত দ্বিতীয় স্থানে উঠে এল, তেমনি নিজেদের পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার আশা জিইয়ে রাখল। সেটা হলে ইরানিয় তথা এশিয় ফুটবলের ইতিহাসে সেটাও একটা নতুন নজির সৃষ্টি করবে কারণ ইতিপূর্বে ইরান বিশ্বকাপের মূলপর্বে কোনওদিন প্রথম রাউন্ডের বাধা টপকাতে পারেনি।
ইরান জয়ে ফিরলেও আয়োজক কাতার কিন্তু তাদের উপুর্যপুরি দ্বিতীয় ম্যাচেও পরাজিত হল। তারা হারল সেনেগালের কাছে ১-৩ গোলের ব্যবধানে। যদিও আল থুমামা স্টেডিয়ামে এই ম্যাচে কাতার পেল বিশ্বকাপের মূলপর্বে তাদের প্রথম গোল। ০-২ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকার পর ম্যাচের ৭৮ মিনিটে মহম্মদ মুনতারি কাতারের ফুটবল ইতিহাসে বিশ্বকাপে গোল করা তাদের প্রথম খেলোয়াড় হলেন। মুনতারির পাশাপাশি গোলের পর স্টেডিয়াম জুড়ে কাতার সমর্থকদের উৎসাহ ছিল দেখার মত। প্রথমার্ধে সেনেগালের দিয়া এগিয়ে দিয়েছিলেন দলকে। দ্বিতীয়ার্ধে সেই ব্যবধান বাড়ান দিয়েধিউ, আর কাতারের মুনতারির হেড করে গোল করে ব্যবধান কমানোর মিনিট ছয়েকের মধ্যে সংঘবদ্ধ আক্রমণ থেকে গোল করে সেনেগালের জয় সুনিশ্চিত করেন দিয়েং। গ্রুপ-এ-এর প্রথম ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের কাছে ০-২ গোলে হারের পর দ্বিতীয় ম্যাচে কাতারের বিরুদ্ধে জয়ে ফিরে পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার আশা কিছুটা হলেও টিকিয়ে রাখল সেনেগাল। অন্যদিকে পরপর দুটি ম্যাচে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই তাদের বিদায় কার্যত সুনিশ্চিত করে ফেলল ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ কাতার।