একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণ
আমরা সবাই স্বাভাবিক ভাবেই উচ্ছ্বসিত ছিলাম যখন ৪ঠা জুনের সকাল থেকে ভোটের ফলাফল আসতে শুরু করে আর আমরা দেখি যে অন্যদের সঙ্গে অজৈবিক প্রাণীটাও কংগ্রেস প্রার্থী অজয় রায়ের থেকে পিছিয়ে ছিল বেশ কিছু সময়ের জন্য। এমনকি বেনারসের একজন কর্মঠ বিজেপি কর্মী উজ্জ্বল কুমার একটা ভিডিওতে দাবি করেছেন যে ওর মতো অবেহেলিত অনেক কর্মীদের কে তাঁর জন্যে ‘অতিরিক্ত ভোট’ যোগাড় করে দিতে হয়েছে যাতে তাঁকে জেতান যায়। এই দাবিটা সত্যি কি না আমরা জানি না তবে এইটুকু বলা যায় যে পুরোনো কর্মীদের একদল এটা জানতেন যে অজৈবিক প্রাণীর জেতাটাও এবার সহজ ছিল না। তবে আমরা এটা জানি যে হঠাৎ দুপুরের পর থেকে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটটা যেন অচল হয়ে গিয়েছিল এবং নতুন আপডেটগুলি আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল – আর ঠিক এই সময়ে আমরা খবর পেতে শুরু করি যে উত্তর প্রদেশ সহ অন্যান্য কয়েকটি জায়গাতে ‘ইন্ডিয়ার' শরিক দলের জিতে যাওয়া প্রার্থীদেরকে জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে. এই সব সত্ত্বেও আমরা উচ্ছ্বসিত ছিলাম কারণ এই নির্বাচনটি আসলে নির্বাচন নয় যুদ্ধ ছিল যেখানে শাসক দলের সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ করে সাধারণ মানুষের রায় শাসক দলের বিরুদ্ধে পরিষ্কার বেরিয়ে আসছিল।
আমরা স্বভাবিক ভাবেই আনন্দিত ছিলাম যদিও আমরা জানতাম যে পর্দার আড়ালে আর কত কি হয়েছে তা আমাদের এখনও জানা নেই যেমন :
১। ভোটের মোট সংখ্যা নির্বাচন কমিশন কেন প্রথম পর্বের ১১ দিন ও দ্বিতীয় পর্বের ৪ দিন পর অব্দি প্রকাশ করেনি এবং যখন করল, তখন দেখা গেল যে ভোটের দিনের তুলনায় ৫.৭ শতাংশ, অর্থাৎ ১ কোটি ৭ লক্ষ ভোট বেড়ে গিয়েছে। এটা কি করে হল? নির্বাচন কমিশন এই পুরো ব্যাপারটাকে অস্বীকার করলেও অনেক প্রশ্ন থেকেই গেছে কারণ ১১ দিনের ব্যবধানের কোন ব্যাখ্যা তাদের দিক থেকে দেওয়া হয়নি, যেখানে এটা জানা কথা যে এই কাজটা সঙ্গে সঙ্গে করা হয়. এই প্রশ্নগুলি একদম শুরু থেকে তোলা হয়েছিল এবং খবরে জানা গেছে যে পরে অ্যাসোশিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্ম বিভিন্ন রাজ্যস্তরে এই বাড়তি ভোটের হিসেব করেছেন। সমস্যাটি কেবল বাড়তি ভোট নিয়ে নয় কারণ ইতিমধ্যেই দ কুইন্ট হিসেব করে দেখিয়েছে যে ৩৬২ টি লোক সভা আসনজুড়ে নির্বাচন কমিশন ৫, ৫৪, ৫৯৮ ভোট বাতিল করেছে।
২। নির্বাচন কমিশন আদালতে যে হলফনামা দায়ের করেছে তাতে কেন এটা বলা হয়েছে যে ভোটের মোট সংখ্যা আর ফর্ম ১৭ সি প্রকাশ করার আইনত কোন বাধ্যবাধকতা নেই? প্রথমত আইনজীবীদের মতে এটা সঠিক কথা নয়। তবে আইনের প্রশ্ন আপাতত বাদ দিলেও এই তথ্যগুলি প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা তারা অস্বীকার করেন কি করে যাদের ওপরে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ ও ট্রান্সপারেন্ট রাখার দায়িত্ব আছে? শুধু তাই নয়, মনে রাখতে হবে যে আগের নির্বাচনগুলতে এটা করা হত এবং ২০১৯ এর নির্বাচনে শুধু এই পরিসংখ্যানগুলি প্রকাশই করা হয়নি বরঞ্চ ২০১৪র সঙ্গে তার তুলনাও করা হয়েছিল – একথা ওপরে প্রথম লিংকে দেওয়া সাংবাদিক পুনম আগরওয়ালের টুইটে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্ন ওঠে যে এই নির্বাচনে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হল না কেন?
৩। নির্বাচনের শেষ পর্বের পরিসংখ্যানগুলি কেন ৬ জুন পর্যন্ত – অর্থাৎ ফলাফল বেরনোর দুদিন পর অব্দি প্রকাশ করা হয়নি?
৪। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে ১৪০এর বেশী লোক সভা আসনে যত ভোট পড়েছে তাঁর থেকে বেশী গোনা হয়েছে।
পুনম আগরওয়াল এই বিষয়টা কে ২০১৯ এর নির্বাচনেও লক্ষ্য করেছিলেন। অনেকের মনে থাকতে পারে যে তখন ৩৭৩ টি আসনে এরকম অমিল দেখা গিয়েছিল এবং পুনম এই প্রশ্নটি তোলাতে, তার কোন ব্যাখ্যা না দিয়েই পরিসংখ্যানগুলি কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে তুলে দেওয়া হয়। আমরা অনেকেই তখনও সন্দেহ করেছিলাম যে কিছু একটা ভোটচুরির ব্যাপার তখনও ঘটেছিল। সুপ্রীম কোর্টের উকিল মেহমুদ প্রাচা ও প্রাক্তন আইএএস অফিসার এম জি দেবসাহায়াম, যারা ইভিএমের বিরুদ্ধে অনেকদিন ধরে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের এই মেশিনগুলোর সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু বলার আছে – সে বিষয়ে আমরা এখানে আর যাচ্ছিনা। এইটুকু বলে রাখাই যথেষ্ট যে ত্রিপুরাতে রিটার্নিং অফিসারদের কাছ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে সিপিএম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কে জানিয়েছিল যে বেশ কয়েকটা বুথে ১০০ শতাংশের বেশী ভোট পড়েছে – একটা আসনে ১০৫ শতাংশও পড়েছে। প্রাচার মতে ভোটের এই অমিল আসলে পুরো গল্পটা বলে না – ব্যাংক ডাকাতির পরে পালাতে গিয়ে যেমন একটু খুচরো টাকা এদিক ওদিক পড়ে যায়, এটাও অনেকটা সেই রকম একটা ব্যাপার।
(ইতিমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি যে মুম্বাই উত্তর পশ্চিমের আসনে আসলে একজন ধরা পড়েছে যার ফোনটা ইভিএমের সাথে যুক্ত হয়েছিল এবং এই ভদ্রলোক এনডিএ প্রার্থীর আত্মীয় হন। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে এই আসনে ‘ইন্ডিয়া’র প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন কিন্তু পরে তাকে ৪৮ ভোটে হারিয়ে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে এখন পুলিশে একটা এফআইআর ও করা হয়েছে.)
যাই হোক, এই সবের মধ্যেও আমাদের উচ্ছ্বাস কমে নি যদিও আমরা অনেকে মনে করি যে এই নির্বাচনে তারা ভোট চুরি করে ক্ষমতায়ে এসেছে।
উচ্ছ্বাসের পর
আনন্দ করার ও উল্লাসের পালা শেষ হল। তারপরে এল সরকার গঠনের ও মন্ত্রিত্ব বণ্টনের সময় এবং চন্দ্রবাবু নাইডু ও নীতিশ কুমারের করুণ অবস্থা আমরা লক্ষ্য করলাম। আমাদের মধ্যে অনেকে হয়ত নাইডু ও নীতিশ কে লেখা একটা চিঠিতেও সই করেছিলেন যেখানে এই দুজন কে গনতন্ত্রর পক্ষে, ‘ইন্ডিয়া’র পাশে এসে দাঁড়াবার আহবান করা হয়েছিল। আমরা যারা ওই চিঠিতে সই করেছিলাম তাদের উদ্দেশ্য এদের ওপর একটা গণতান্ত্রিক চাপ সৃষ্টি করা ছিল। কিন্তু পরে আমার মনে হয়েছে যে এরা যে ‘ইন্ডিয়া’র সাথে এসে দাঁড়াল না এটা ভালই হয়েছে কারণ এখানে এসে তারা (বিশেষ করে নীতিশ) বিজেপির দালাল হিসেবেই কাজ করত এবং ‘ইন্ডিয়া’ সরকার বানাতে পারলে তাকে উত্খাত করার চেষ্টাও করত।
‘ইন্ডিয়া’ জোটের দলগুলি বোধ হয় এখনও নাইডু আর নীতিশকে দলে টেনে আনার আশা ছাড়েননি যেটা আমার মতে একটা মারাত্মক সম্ভাবনা।
এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই নির্বাচনটা আসলে পার্টিগুলো লড়েনি। জুন ২০২৩ অব্দি তো তারা একজোট ও হতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তারা একসঙ্গে এলেন জনগণের চাপে, আর বিশেষ করে মোদী ও শাহ যখন ওদের ওপর আক্রমণ তীব্র করলেন তখন। তার পরেও তারা পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচন আলাদা আলাদা লড়লেন – একের অপরের বিরুদ্ধে। পাঁচ রাজ্যের বেশির ভাগে হেরে যাওয়ার পর এবং সংসদ থেকে এক সঙ্গে ১৪১ জন সভ্য সাসপেন্ড হয়ে যাবার পর তাদের মধ্যে চাড়টা একটু দেখা গেল। এখনও পশ্চিম বঙ্গ, কেরালা, দিল্লি ও পাঞ্জাবের মত রাজ্যগুলিতে ইন্ডিয়া জোটের সামনে অলঙ্ঘ্য সমস্যা আছে যেগুলি কাটিয়ে ওঠা সোজা নয়। কেরালায় দুই জোটই ইন্ডিয়ার অংশ আর পশ্চিমবঙ্গে, দিল্লিতে ও পাঞ্জাবে তৃনমূল কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টি বিরুদ্ধে আছে বিজেপি ছাড়া ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য দল। আমরা জানিনা এই দলগুল সময়ের দাবি বুঝে গণতন্ত্র বহাল করার লড়াই এর স্বার্থে তাদের ইতিহাসের উর্দ্ধে উঠতে পারবেন কি না? এই জটিল কাজটা তখনই সম্ভব হতে পারে যখন অন্তত কয়েকটা পার্টি এমন নতুন প্রজন্মের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতে সক্ষম হবে যারা পুরোনো ইতিহাসের বন্দী নন।
নাগরিক সমাজ ও অদলীয় সক্রিয়তা
এই নির্বাচনে মোদীর পরাজয়ের (কারণ ভোট চুরির ভিত্তিতে জেতা) জমি তৈরি করেছে গত পাঁচ বছরের বহু আন্দোলন – বিশেষ করে সিএএর বিরুদ্ধে আন্দোলন, কৃষকদের আন্দোলন ও অগ্নিবীর স্কীম বিরোধী বিক্ষোভ যেগুলির মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ মুখরিত হয়ে ওঠে. নির্বাচনের দিক থেকে দেখতে গেলে এই আন্দোলনগুলি একদিকে ভয়ের বাতাবরণ ভাঙতে সক্ষম হয়েছিল আর অন্যদিকে মোদীর ‘জাদু’র মুখোশ খুলে দিতে পেরেছিল. অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলি যা পারেনি এরা তা করতে পেরেছিল। এই নির্বাচনের জমি তৈরি করেছিল পশ্চিম বঙ্গে ‘নো ভোট টু বিজেপি’র মতো অদলীয় অভিযান অথবা কর্নাটকে ‘বহুত্ব কর্নাটক’ ও ‘এড্ডলু কর্নাটক’ এর মতো অভিযানগুলো. এই সমস্ত অভিযানের সঙ্গে যুক্ত শত শত মানুষ, যারা কোন দলের সভ্য ছিল না, রাতদিন এক করে মোদী শাসনের পরাজয়ের জন্য কাজ করেছে. এমনকি, নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় জবাবদিহি ও তার ট্রান্সপারেনশীর জন্য অভিযান ও হস্তক্ষেপ ও নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলিই চালিয়ে গিয়েছিল – দলগুলো এব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়নি. মণিপুরের ঘটনগুলিও অনেক লোক কে ঝাঁকিয়ে তুলেছিল যদিও এটা বলা মুশকিল যে ভারতের অন্যান্য অংশে এই জঘন্য ঘটনগুলির নির্বাচনী প্রভাব কতটা পড়েছে।
এই নির্বাচনের জমি তৈরি করেছে – বিশেষ করে উত্তর ভারতে, যেখানে লড়াই সব চেয়ে বেশি হিংস্র ছিল – অসংখ্য হিন্দি ইউটিউব চ্যানেলগুলো যারা গত কয়েক বছরে লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য খবরের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। এগুলোর মধ্যে অজিত অঞ্জুম, পুণ্য প্রসূন বাজপেয়ী, আর রাবিশ কুমারের মতো বড় চ্যানেল থেকে বেরিয়ে আসা সাংবাদিক ছাড়াও ন্যাশনাল দস্তক ওর বোলতা হিন্দুস্তান সহ অসংখ্য স্থানীয় চ্যানেলগুলো ছিল যথা বুলন্দ ভারত, চলচিত্র অভিযান, শুনো ইন্ডিয়া ইত্যাদি। এই দুইয়ের মাঝখানে অনেক এমন চ্যানেল ও আছে যাদের দর্শক ৫০-৬০ লক্ষেরও বেশি. এই নির্বাচনের জমি তৈরি করেছে নেহা সিং রাঠোর এর ধ্রুব রাঠীর মতো যুবরা যারা আলাদা আলাদা ভাবে বার্তাটা গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
এটা বলা বোধ হয় ভুল হবে না যে যে সময়ে সরকার ‘আপ’ কে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছিল এবং কংগ্রেসের ব্যাংক খাতাগুলি ফ্রীজ করে দিয়েছিল, ঠিক তখনই ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সব চেয়ে বড় সম্বল হয়ে উঠলেন হাজার হাজার এমন মানুষ যারা কোন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তারা এই দায়িত্ব নিজেদের ওপর নিয়ে নিলেন।
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা ও ন্যায় যাত্রা লোকেদের মধ্যে হতাশা ভেঙে তাদের কে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হতে সহায়তা করেছে। আসলে রাহুল গান্ধী রাজনৈতিক নেতার মতো ব্যবহার না করে গভীর ভাবে চিন্তান্বিত একজন নাগরিকের মতো আত্মপ্রকাশ করেন। যাত্রাগুলোতে আসা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের লোকেদের সঙ্গে তাদের কাজের জায়গাতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা – কখনো ক্ষেতে চাষীদের সঙ্গে, কখনো বা রেলওয়ে স্টেশনে কুলিদের সঙ্গে বা সবজি মণ্ডিতে কোন হকারের আবেদনে তাকে হাজির হতে দেখা গেছে. তিনি একমাত্র রাজনৈতিক নেতা যিনি বিগত দেড়-দুই বছরের মধ্যে নিজেকে নতুন ভাবে জন সমক্ষে প্রস্তুত করতে পেরেছেন – শাসক দলের সব রকম অপপ্রচার ও আক্রমণ কে ব্যর্থ করে দিয়ে।
এই নির্বাচনের কথা দলিত ও সব চেয়ে পশ্চাৎপদ জাতিগুলির ভূমিকার কথা না বলে শেষ করা যাবে না – বিশেষ করে তাদের নিজেদের জীবন সংগ্রামের ক্ষেত্রে সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা বুঝে সংবিধান বাঁচানোর তাগিদে তাদের সক্রিয়তা তাদেরকে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কাছে নিয়ে এসেছিল। এই কারণে দেখা গেল যে বহুজন সমাজ পার্টি অথবা প্রকাশ আম্বেডকারের বঞ্চিত বহুজন আগাঢির মতো দলগুলো দলিত-বহুজনদের বেশি ভোট পায়নি – কারণ শাসকদল কে হারানো বড় উদ্দেশ্য ছিল। এখানেও দলগুলির ভূমিকা ছাড়াও ইনফর্মাল প্রচারের একটা বড় ভূমিকা ছিল. এই পরিস্থিতি মাথায় রেখে হরীশ ওয়াঙখেড়ে দলিত রাজনীতির ভবিষ্যত নিয়ে এক নতুন দৃষ্টির প্রয়োজনের কথা বলেছেন। জাতীয় স্তরে দলিত দল ও সংহঠনগুলির একটা জোট গড়ে তলর কথা ওয়াঙখেড়ে প্রস্তাব করেন যেখানে ওঁর মতে বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের কর্মীদের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
ভবিষ্যতের চ্যালেন্জ
এটা মনে করা মারাত্মক ভুল হবে যে দলিত-বহুজন জাতিগুলোর ও গরীব মানুষের যে সমর্থন ‘ইন্ডিয়া’ পেয়েছে সেটা একটা স্থায়ী ব্যাপার। ভবিষ্যতে এই সমর্থন কে আরো অনেক মজবুত করার দরকার আছে। এই কাজটা পার্টিগুলির কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে আপনা আপনি হয়ে যাবে এমন মনে করার কোন কারণ নেই। সুতরাং নাগরিক সমাজের বা বিভিন্ন গণসংগঠনগুলোর যৌথ কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে বিশেষ করে দলিত বহুজন জনতার সাথে পরস্পর বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তোলার ও আরো শক্তিশালী করার দরকার আছে। এটাও মনে করা মারাত্মক ভুল হবে যে আমরা মোদীর বিজেপির বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ লক্ষ করেছি সেটা হিন্দুত্বের শক্তির কোন দীর্ঘস্থায়ী পতনের দিকে ইঙ্গিত করছে। সে এক দীর্ঘমেয়াদী লড়াই যার পথে অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটবে যার জন্য আমাদের মানসিক প্রস্তুতি থাকা দরকার। যথা হঠাৎ এমন সময়ে মোহন ভাগবতের মঞ্চে প্রবেশ। ওর যে বক্তৃতা নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে সেটা অল্প সময়ের মধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছে যে বিজেপির মধ্যে তার হারানো আধিপত্য আবার দখল করার জন্য আরএসএস এখন তত্পর। আরএসএস নেতারা জানেন যে মোদীর সূর্য অস্ত হওয়ার যেখানে ওদের জন্য একটা ভাল দিক রয়েছে তেমনই তারা বোঝেন যে মোদী গোষ্ঠীর পরাজয় হলে আরএসএসকেও ক্ষমতার বাহিরে যেতে হবে। ফলে মোদী-শাহ-র বদলে বিজেপির অন্য একটা চেহারা সামনে রেখে ওরা যদি বিরোধী জায়গাটাও দখল করে নিতে পারে তাহলে তাদের অনেক সুবিধে হবে। এটা পরিষ্কার বুঝে নেয়া দরকার যে ভাগবত যতই গণতন্ত্রে বা ঐক্যমত তৈরি করাতে ‘প্রতিপক্ষের’ ভূমিকার কথা বলুন না কেন, এটা আসলে কোন গণতন্ত্রপ্রেমী লোকের বক্তব্য নয়। তিনি মোদী-শাহ কে লক্ষ্য করে যে কথাগুলি বলছেন তাতে বিরোধীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা একটা বড় উদ্দেশ্য, কারণ ইতিমধ্যেই তিনি যোগী আদিত্যনাথের সাথে দেখা করে এমন একটা লোক কে সামনে আনার চেষ্টা করছেন যার বুলডোজার রাজনীতিতে গণতন্ত্রের প্রতি সামান্যতম কোন আস্থার চিহ্ন দেখা যায় না।
আমাদের দিকে সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই যে আমাদের জোটের – দলীয় ও অদলীয় দুইয়ের – ভীত খুবই নড়বড়ে। এটা স্বীকার করে এই নির্বাচনে এগিয়ে আসা নানান শক্তিগুলোকে এবং নানা লোকজন কে এক সুত্রে বেঁধে রাখার কাজটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়ে. এই কাজটা তো পার্টিগুলির করা উচিত কিন্তু হালের ইতিহাস দেখে মনে হয় না যে তারা এটা করতে ইচ্ছুক। এমন অবস্থায় এই দায়িত্বটা অদলীয় কর্মীদেরকেই বহন করতে হবে যাতে পার্টিগুলোর ওপরে বাইরে থেকে একটা চাপ থাকে।
এইখানেই বোধ হয় সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের মতো দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হতে পারে কারণ এই পার্টিটা ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত হলেও তার মধ্যে পরিস্থিতির দাবি বুঝে সবাইকে একজোট করার উদ্যোগ নিতে পারার ক্ষমতা দেখা গেছে – এমন দলগুলির কে নিয়েও যাদের সঙ্গে তাদের অতীতে তীব্র সংঘর্ষ হয়েছে যেমন আমরা বিহারে দেখতে পাই. এছাড়া আজকে অদলীয় অনেক কর্মীদের লিবারেশনের ওপর অনেক ভরসা বেড়েছে এবং অনেক জায়গায় একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এটাকে সম্বল করে এই কাজটা করা যেতে পারে।