হঠাৎ করেই হয়তো কিছু ঘটনা ঘটে যায়। যেমন কারুর নামের আগে বাটপার বা বাটপারিয়া শব্দটার হুট কোরে যোগ হয়ে যাওয়া। তবে এখানে ঘটনার লাট্টুটা হয়তো একটু অন্যভাবেই ঘুরছে, নামের আগে নয় পরে চলে আসছে সেই শব্দটা। বাটপারিয়া শব্দটা। গন্ডেরিরাম বাটপারিয়াকে নিশ্চয় এতক্ষণে সবারই মনে পড়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছো রাজশেখর বসু বা পরশুরামের সেই অমর, অক্ষয় সৃষ্টি শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেডের এক পিস রত্ন হলেন এই বাটপারিয়া। গণ্ডেরিরাম বাটপারিয়া। শেয়ার বাজারের দূরন্ত খেলা থেকে ধর্মের মস্ত মস্ত ব্যবসা- এই দু-খেলারই এক কথায় এক দূরন্ত, লাজবাব স্ট্রাইকারেরই নাম হল , এই গন্ডার থুড়ি গন্ডেরিরাম বাটপারিয়া।
আর আজ আদনি মেগা দুর্ণীতির মহা সমারোহে আমার দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গোটা শরীর থেকেই যখন গ্যালন গ্যালন পুঁজ, রক্ত আর ভেদ বমি উঠে আসছে । সে সময় হয়তো পরশুরামের ছোট গল্পের আলো থেকে মহাভারত আমাদের এই ধরনের আদনি মেগা স্ক্যাপ টাইপের বিষয় গুলোকে বোঝার ক্ষেত্রে এক মার্গ দর্শকেরই কাজ করতে পারে।
মহাভারত, গন্ডেরিরাম এবং আদানি কান্ড--
আসলে আদানি কান্ড নিয়ে বলতে গিয়ে সাংবাদিক রবিশ কুমারই হয়তো সবচেয়ে সঠিক কথাটাই বলে দিয়েছেন। আদানিদের দাবি বা হোয়াটসএ্যাপ ইউনিভার্সিটির প্রচার অনুযায়ী এই শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়া যদি আন্তর্জাতিক এক চক্রান্ত হয়। ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যদি এই ঘটনা একটা যুদ্ধ বা ডিকলারেশন অফ ওয়ার হয়ে থাকে। তাহলে এ বিষয় নিয়ে দেশের সরকার চুপ করে রয়েছে কেন ?
রবিশ দাবি করছেন আদানিদের কথা সত্যি হলে দেশের স্বরাষ্ট্র থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী চুপ করে রয়েছেন কেন ? ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, অথচ তা নিয়ে দেশের সরকার চুপ করে রয়েছে । এমন কথা শুনলে তো কত্তা ঘোড়ারও হাসি পেতে পারে।
অথচ বিজেপি শাসনে এমনটাই হয়েছে। শেয়ারের দাম ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো ভারতে হয়তো কোনও নতুন ব্যাপার নয়। এর আগে হর্ষদ মেহেতার সময় থেকেই বা তথাকথিত উদার অর্থনীতির ভারতের বুকে ল্যান্ড করার পর থেকেই এ ঘটনা ঘটছে। কিন্তু যেটা নতুন ব্যাপার সেটা হল হর্ষদ মেহেতা কখনও বলেন নি যে, তার কোম্পানির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ আসলে গোটা দেশের বিরুদ্ধেই একটা যুদ্ধ। কেননা যে রাজনীতি আদানি কেলেংকারীকে গোটা দেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক শক্তির একটা যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে জনগণকে ভাবতে শেখায়- সে রাজনীতির তখনও (হর্ষদ মেহতার আমলের কথা বলছি) হয়তো শৈশব আবস্থাটাই কাটেনি।
তবে আজ সে টগবগে টাট্টু ঘোড়া। ফলে আনেক দিন আগে ফ্যাসিস্ট মুসলিনি ফ্যাসিবাদ=কর্পোরেট রাষ্ট্রের যে পরিকল্পনা করেছিলেন তার এক দুরন্ত হাতে গরম উদাহরণ হতে পারে এই আচ্ছে দিনের মোদির ভারত। তাই আমরা অবাক বিস্ময়ে হয়তো দেখি যে, এলআইসি এবং সরকারি ব্যাংক গুলো বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দামে আদানিদের শেয়ার কিনেছে। অর্থাৎ বাজার অর্থনীতির যে মহান গ্র্যান্ড তর্ক -যুক্তি- গপ্পো- বাজারই স্থির করবে সব কিছু। এই ন্যারেটিভেকে সম্পূর্ণ কাঁচাকলা উপহার দিয়েই আদানিদের শেয়ার বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দামে কিনে নিজেদের দেউলে হবার রাস্তা নিজেরাই বেছে নিচ্ছে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা। আর এই ঘটনাকেই আমরা হয়তো বলতেই পারি যে - এহি হ্যায় দ্যা গ্রেট ইন্ডিয়ান রবারি অথবা আচ্ছে দিনের আর্থনীতি । যেখানে আদানিদের জন্য ১২ মাস জুড়ে থাকবে পৌষ মাস। আর আদানি বা বৃহৎ কর্পোরেটদের অর্থ জোগাতে গিয়ে ব্যাংক, এলআইসি সহ জনগণের হবে সার্বিক সর্বনাশ।
যাই হোক এখন একটা প্রশ্ন আসতেই পারে- আদৌ কী বাজার অর্থনীতি বাজারের ধ্রুপদি যুক্তি মেনে চলে ? এর উত্তর হল গ্যাসের অটো কি উইদআউট গ্যাস রাস্তায় দৌড়তে পারে ? না পারে না। তেমনি মার্কেট ইকনমিও চূড়ান্ত ভাবেই রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষণ ছারা হয়তো এক পাও এগতেই পারে না। ফলে অনেক দিন আগে কার্ল মার্কস যে কথাটা বলেছিলেন রাষ্ট্র অদতেই হল শ্রেণী রাষ্ট্র। সে আসলে হল ডমিনেটিং শ্রেণী দ্বারা অন্যান্য শ্রেণী গুলিকে নিপীড়ন করার এক লাজবাব যন্ত্র। আর উদার অর্থনীতির পটভূমিকায় রাষ্ট্রের এই শিফটিংটা দূরন্ত ভাবেই ধরা পরে যায়। সে হয়ে উঠতে থাকে চূড়ান্তই এক কর্পোরেট রাষ্ট্র। তাই আমরা দেখি স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮০র দশক পর্যন্ত কর্পোরেটদের যে পরিমাণে সম্পদ বাড়ে, ১৯৯০ সালের পর থেকে সে বৃদ্ধি রকেটের গতিতেই হয়তো এগোতেই থাকে। অক্সফার্মের রিপোর্টে আমরা বিপন্ন বিস্ময়ের স্বীকার হয়েই দেখি যে, ভারতের সবচেয়ে সম্পন্ন পুঁজিপতিদের হাতেই দেশের মোট সম্পদের ৬৫শতাংশ আরাম সে কুক্ষিগত হয়ে যায়। একজন দিনমজুরের আয়ের সঙ্গে একজন সিইওর আয়ের পার্থক্য এতটাই বেড়ে যায় যে, সেই দিন মজুরকে সিইওর আয়ের কাছাকাছি পৌঁছতে হলেও ৯১০ বছর সময় লেগে যাবে। আর এই চূড়ান্ত বৈষম্য উদার অর্থনীতির হাত ধরে ক্যানসারের মতই গ্রো করতে থাকে ১৯৯০ সালের পরবর্তী থেকে- আবার অর্থনীতিতে কিছু নতুন কিন্তু ইতিবাচক উপাদানও হয়তো সংযোজিত হয়, এই টাইম ফ্রেম জুড়ে।
আর এই বৈষম্যের আর্থনীতির রাজসূয় যোগ্যের মেগা প্রসাদ খেয়েই বিশ্ব অর্থনীতির পাদ- প্রদীপের আলোয় ক্রমশ উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে থাকেন আদানিরা। ২০১৪য় যে আদানি গোষ্ঠীর মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪৫ বিলিয়ান ডলার, সেটাই মোদি শাসনের দু-দুফায় এতটাই হৈ হৈ রই রই করে বাড়ল যে আদানিদের নাম চলে এল পৃথিবীর সেরা তিন ধনীর তালিকায়।
ব্যাপারটা অনেকটা যেন পরশুরামের শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেডের সেই অমর, অক্ষয় ঘটনাটার মতই অনেকটা হয়ে দাঁড়ালো। ওই গল্পে যেমন আমরা দেখি গন্ডেরিরাম বাটপারিয়ার সঙ্গে মোলাকাত হওয়ার আগে যে লোক গুলো হাজারে খেলতো- শেয়ার বাজার আর গন্ডেরি ভাইএর হাত যশের সৌজন্যে তারাই এবার লাখে খেলা শুরু করে দিল। আদানি গোষ্ঠীর মত তাদেরও প্রফিটের মার্জিনের সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে বিরাট এক পোলভল্ট মানে চূড়ান্ত বৃদ্ধিই ঘটে গেল।
সাধে কী সুকুমার রায় বলেছেন ১৩কে ঠিক সময় ধরতে পারলে তবেই ১৩ না হলেই সাড়ে ১৩। আর তেরকে যে পুঁজিবাদের এই অখন্ড মায়ার জগতে বিজেপির মত কোনও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান পিছনে থাকলে যে নো টেনশান মুডেই ধরে ফেলে বিরাট সম্পদই সংগ্রহ করা যায়- তার এক জীবন্ত নমুনাই হলেন আদানি সহ ভারতের নানা শিল্পপতিরা।
তবে শুধু আদানিরাই নয় ভারতীয় সমাজ জীবনে সংখ্যাতত্বের এই পাওয়ার প্লে বা গিলি-গিলি-গে যে চিরকালই এক বিশেষ ভূমিকা রেখে এসেছে- তা বোধহয় মহাভারত আমাদের সামনে খুব সুন্দর ভাবেই উপস্থিত করে। পান্ডবদের পাশা খেলায় হারানোর মূল মেরুদন্ড ছিলেন শকুনি। সেই শকুনির পাশা তো আসলে সংখ্যারই ম্যানুপুলেশানই ঘটিয়েছিল। তিনি পাশা খেলায় যে সংখ্যা চাইছে তাই পড়ছে এবং পান্ডবরা হারছে। আর্থাৎ যে কোনও প্রকৃত খেলার ভিতর যে তীব্র অনিশ্চয়াতাটা থাকে তাকেই মুছে দিয়েছিল শুকুনির পাশা। আর্থাৎ সংখ্যাতত্বের ম্যানুপুলেশান।
আর আদানিদের ক্ষেত্রেও তো সেই গ্রেট সংখ্যার খেলাই হয়তো ভেল্কি দেখিয়েছে। ওদের শেয়ারের দাম যা কোনও ভাবেই হওয়ার নয়। সেটাই হয়েছে বলে অভিযোগ। সুতরাং গেম ইজ সুপার ম্যানুপুলেশান।
পুঁজিবাদ, সংখ্যা ও প্রতিরোধ ---- আসলে বর্তমান পুঁজিবাদের এক অন্যতম দিকই হল বা লাইফ লাইনই হল ডেটা ইকনমিক্স। সেই কবেই মহমতী লেনিন তাঁর সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন কী ভাবে পণ্য উৎপাদন নির্ভর পুঁজিবাদ সরছিল মূলতই পরিষেবা নির্ভরতার দিকে- সেই শিফট আজ হয়তো মেইন কোর্স হয়ে উঠেছে। যাই হোক এই আজকের ডেটা নির্ভর পুঁজিবাদকে আর একটা খেলাও হয়তো এখন দারুণ ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করছে দ্যাট ইজ অ্যালগোরিদম। এ নিয়ে প্রখ্যাত তাত্বিক হাতারি সুবিস্তারে আলোচনা করেছেন। সে আলোচনায় না ঢুকেই সহজ ভাষায় বলবো অ্যালগরিদমের সৌজন্যেই আজ হয়তো তীব্র দক্ষিণপন্থার ভাষাই জণসাধারণের কাছে প্রায় নির্বিকল্প ন্যারেটিভই হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে। ব্যাপারটাকে আরও সহজ করে বললে এটাই দাঁড়ায় যে, ধরুন আপনি বিজ্ঞান আন্দোলন নিয়ে কিছু বললেন বা লিখলেন বা শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে কিছু বললেন- আজকের এই সোশ্যাল মিডিয়া বা তামাম মিডিয়ার বিস্ফোরণের এই যুগে বেশির সময়ই হয়তো সে খবর পৌঁছোবে হয়তো মুষ্টিমেয় লোকেরই কাছে। উল্টো দিকে কেউ বলে মুসলমানরা ঠিক ততটা ভারতীয় নয়। তাহলে সে কথা কোটি কোটি লোকের কাছে হয়তো প্রতি মিনিটেই পৌঁছে যাবে নানা ভাবে। ফলে আস্তে আস্তে হয়তো একটা ন্যারেটিভ বহু লোকের গভীরেই গড়ে উঠবে যে, ওরা হয়তো সত্যিই ভারতীয় নয়। কেন তারা অভারতীয় তারও যেমন কোনও যুক্তি এই ন্যারেটিভ দেবে না। তেমনি আমার দেশের একটা বৃহৎ জণগোষ্ঠীকে ভারতীয় নয় বলার ভেতর দিয়ে আদতে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদেরও কী লাভ হবে ? এ প্রশ্নের উত্তরও তারা এরিয়ে যাবে। ফলে কোনও ধরণেরই সাইন্টিফিক টেম্পার নয় শুধুই একটা রিদিম থাকবে- যা হবে বিভৎষ ভাবেই গরিব বিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক।
আর মনেহয় এই রিদমই আদানি কেলেংকারির যুগে বিজেপির রাজনীতির আসল মৌলিক জায়গা। ফলে আদানি (ক্রনি ক্যাপিটালিজম সাম্প্রদায়িকতা এলগোরিদম)= সংঘ পরিবারের রাজনীতি। এখানে শ্রমিক, কৃষক নিপীড়ত মানুষের কোনও স্পেস হয়তো সে ভাবে নেই। আর এই অন্ধকারময় রাজনীতির আজ যখন গোটা ভারত জুড়ে হৈ হৈ করে দৌড়চ্ছে। সে সময়ই হয়তো নিজের সন্তানকে হারানো বিলকিস বানুর লড়াই, কৃষক আন্দোলন, এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের নানা প্রাণবন্ত মুখ আমার দেশের হয়তো এক অন্য ছবিই আঁকছে।
কেন চেয়ে আছো গো মা মুখপানে? এই প্রশ্নের উত্তরে আজকের ভারতের জল, জমি, জঙ্গল সহ প্রতিটা ইতিবাচক লড়াই হয়তো আমাদের বলছে- রাত তীব্র গভীর মানে সামনেই সূর্যোদয় অপেক্ষা করছে। গোটা পৃথিবী সহ ভারতে কেনও দিন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি গুলোর রাজত্ব স্থাপিত হয় নি। আজও হবে না। ফ্যাসিবাদের আচ্ছেদিনও থাকবে না।
https://twitter.com/satishacharya/status/1627319002862338048?s=20