পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আদানির শিল্পসাম্রাজ্য এক মাফিয়াতন্ত্র

  • 13 February, 2023
  • 1 Comment(s)
  • 1266 view(s)
  • লিখেছেন : অমিত দাশগুপ্ত
মনে রাখা দরকার আজ অবধি বোফর্সের দুর্নীতির কিনারা হয়নি, কিন্তু সেই শ্লোগান, “গলি গলি মে শোর হায় রাজীব গান্ধি চোর হায়” তাতে ভুল প্রমাণিত হয়নি। আজও তেমনি আদানি মোদি আঁতাত ও আদানির দুর্নীতির বিরুদ্ধে ওঠা শ্লোগান কোনোভাবেই ভুল বলে গণ্য হবে না কারণ আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার মূল্যে যে কারচুপি হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট সামনে নিয়ে এসেছে তা সমস্ত আইন, হিসাবশাস্ত্র ও শেয়ার বাজারের মাপকাঠিতে সর্বৈব সঠিক।

সপ্তাহ দুই হল আদানি’র শেয়ার মূল্যে কারচুপি নিয়ে দেশ উত্তাল। শেয়ার বাজারে শর্ট সেলিং-এ বিশেষজ্ঞ আমেরিকার পুঁচকে একটি কোম্পানি হিন্ডেনবার্গ বিশ্বের তৃতীয় ও এশিয়ার সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি গৌতম আদানির ঘুম কেড়ে নিয়েছে।   উল্লেখযোগ্য, দাম কমে যাবে এই অনুমানের ভিত্তিতে উচু দাম থাকা শেয়ার বা বন্ডকে সেই উঁচু দামে বিক্রি করে দিয়ে দাম কমলে কিনে সেই বিক্রয়কে মিটিয়ে দিয়ে মুনাফা করতে চায় যারা তাদের শর্ট সেলার বলে ও ওই পদ্ধতিকে শর্ট সেলিং বলে। শেয়ার সমেত বিভিন্ন ফাটকা বাজারে শর্ট সেলিং একটি বিধিসম্মত পদ্ধতি। শর্ট সেলিংএর বিপরীত হচ্ছে লং বাইয়িং। শেয়ার বাজারের যে কারবারি মনে করে যে একটি শেয়ারের দাম ভবিষ্যতে পড়ে যাবে তিনি শেয়ারটির শর্ট সেলিং করেন, অপরদিকে যিনি মনে করেন শেয়ারটির দাম বাড়বে তিনি লং বাইয়িং-এ লিপ্ত হন। ফলে শেয়ার বাজারে শর্ট সেলিং থাকলেই লং বাইয়িং থাকবে।

তবে হিন্ডেনবার্গের মত পেশাদার শর্ট সেলার অনেক ভেবেচিন্তে গবেষণা করে কোনো কোম্পানির আর্থিক লেনদেন, শেয়ারের কেনাবেচার ধরণ ধারণ, শেয়ারের দামের গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি দেখে শুনে যদি বুঝতে পারে যে কোম্পানির শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে ও সেই দামস্ফীতির পিছনে যোগসাজশ রয়েছে তবেই ওই শেয়ারের শর্ট সেলিংএর ঝুঁকি নেয়। শর্ট সেল করার পরে তারা সেই কোম্পানির ওই সমস্ত যোগসাজশ এবং কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়ানো সংক্রান্ত গবেষণা ও বিশ্লেষণলব্ধ তথ্য প্রকাশ করে যাতে বাজারে ওই শেয়ারের দামের বেলুন চুপসে যায়। ফলে শেয়ারের দাম কমে যায় ও হিন্ডেনবার্গ লাভ করতে সক্ষম হয়।

এতটা পড়ে মনেই হতে পারে যে, হিন্ডেনবার্গের তো আদানির শেয়ারের দাম কমানোর পিছনে স্বার্থ রয়েছে, ফলে তারা ইচ্ছে করে চক্রান্ত করে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যাতে শেয়ারে বিনিয়োগকারিরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে সচেষ্ট হয় ও শেয়ারের দাম পড়ে যায়। তেমনটা যদি এতই সহজ হত তাহলে যেকোনো ব্যক্তি কারবারি শেয়ারের শর্ট সেল করে একটি রিপোর্ট বানিয়ে বাজারে ছাড়ত ও মুনাফা করত এবং তা সমস্ত কোম্পানির শেয়ারের ক্ষেত্রেই করা যেত। কিন্তু তেমনটা হয় না, এবং হিন্ডেনবার্গও সমস্ত কোম্পানির শেয়ারে শর্ট সেল করে না। এই কাজটিতে হিন্ডেনবার্গ দক্ষতা অর্জন করেছে। তারা যদি অনুরূপ রিপোর্ট প্রকাশ করে তাহলে তার শক্ত ভিত, কারণ ও যুক্তি থাকে। বিনিয়োগকারি এবং শেয়ার বা বন্ডের বাজারের কারবারিরা তাতে বিশ্বাস করে। উপরন্তু, যদি কেবল ফাটকা মুনাফা করার জন্য হিন্ডেনবার্গ বা অন্য কেউ কোনো কোম্পানির বিষয়ে ওইরকম গুজব ছড়ায়, কোনো ভিত্তি  ছাড়াই তাহলে আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে মালিকগোষ্ঠী সেই গুজব রটনাকারিকে অসীম ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। তাই হিন্ডেনবার্গ ভুয়ো খবর ও গুজব রটিয়েছে এমনটা প্রায় অসম্ভব। 

ওয়াকিবহাল মানুষজন এখন সকলেই জেনে গেছেন যে, আদানি গোষ্ঠীর দখলে ৭টি শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি রয়েছে ও আরো ৫৭৮টি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি তাদের দখলে রয়েছে। কোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ শেয়ার মালিকগোষ্ঠী নিজেদের হাতে রাখতে পারে। এর থেকে বেশি রাখা বেআইনি। অন্তত ২৫ শতাংশ শেয়ার মালিকগোষ্ঠী বহির্ভুত অন্য বিনিয়োগকারিদের কাছে রাখার নিয়মটির মূল কারণ হল যাতে মালিক নিজেদের ইচ্ছে মত শেয়ারের দাম বাড়াতে কমাতে না পারে। কিন্তু মরিশাস, সাইপ্রাসের মত করহীন দেশসমূহে নিজের পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠজন কর্তৃক শেল কোম্পানি (শেল অর্থাৎ খোলস আছে কিন্তু আদতে কোম্পানিটি কোনো ব্যবসাযই প্রায় করে না) খুলে তাদের মাধ্যমে আদানিগোষ্ঠী নিজেদের কোম্পানির শেয়ার নিজেরাই কিনেছে ও ৭৫ শতাংশের অনেক বেশি শেয়ার নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছে। অর্থাৎ নিজেদের অর্থ আদানিগোষ্ঠী নিজেদের শেয়ার কিনতেই ব্যবহার করেছে ঘুরপথে ওইসব শেল কোম্পানির মাধ্যমে। তারপরে ওইসব শেয়ার নিজেদের মধ্যে কেনাবেচা করে শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। ফলে নিজের বৈভব ও সম্পত্তিকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে দেখিয়ে অতি অল্প সময়ে বিশ্বের তৃতীয় ধনী হযে উঠেছে। এই কৃত্রিম বিত্তের প্রভাবে দেশজোড়া তো বটেই বিশ্বজোড়া  প্রভাবও বিস্তার করেছে। হাসিল করেছে অস্ট্রেলিয়ার কয়লাখনির মালিকানা, বাংলাদেশে বিদ্যুত যোগানের বরাত, শ্রীলঙ্কায় বন্দরের বরাত। অপরদিকে এদেশেও ৬টি বিমাবন্দর, ৮টি বন্দর ও ৪টি টার্মিনাল, বিভিন্ন কয়লাখনির লিজ, জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎখনন, জ্বালনি গ্যাস সরবরাহ, ভোজ্য তেল, চাল-আটার ব্যবসা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পরিকাঠামো নির্মাণ প্রভৃতি বহুধরণের ব্যবসায়ের অধিকার সরকারের কাছ থেকে আদায় করেছে। এছাড়া ৩০টির মত দেশে বানিজ্য বিস্তার করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্য সরকার তাদের রাজ্যে বিনিয়োগের জন্য আদানিকে চাইছে।  এই যে আদানি আবাহন এর মূলে রয়েছে আদানির বিপুল বৈভব, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার আগে যার পরিমাণ ছিল ১০লক্ষ কোটি টাকার বেশি।

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে আদানির নীট সম্পদের পরিমাণ সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। কেবল শেয়ারের দাম কমার জন্যই এই পতন। ওই রিপোর্ট অন্যান্য বহু বিষয়ের পাশাপাশি আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের দামের সঙ্গে মুনাফার অনুপাতের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছিল। দেখা গিয়েছে, আদানি গোষ্ঠীর মুনাফার অনুপাতে শেয়ারের দাম অনুরূপ শিল্পগুলির গড়ের তুলনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩৫-৪০ গুণ বেশি। ফলে সামগ্রিক ভাবে আদানির শেয়ারের গড়ে ৮৫ শতাংশ পতনের সম্ভাবনা আছে, বা আদানিগোষ্ঠীর শেয়ার স্বাভাবিকের তুলনায় গড়ে ৭ গুণ বেশি দামি। এই যে অতিরিক্ত দাম তার মূল কারণ আগে উল্লেখ করা নিজেদের শেয়ার নিজেরাই কুক্ষিগত রেখে নিজেদের মধ্যে কেনাবেচা করে দাম বাড়িয়ে তোলা। এই কাজটিকে বলা হয় রাউন্ড ট্রিপিং, যা বেআইনি।

এই শেয়ারের দামকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে দেখানোর মাধ্যমে নিজেদের প্রতিপত্তি বাড়ানোর কথা আগেই বলেছি। এছাড়াও আরেকটি কাজ করা হয়। ওই ফাপানো শেয়ারের দামের ভিত্তিতে বর্ধিত সম্পদকে ব্যবহার করে ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য সূত্র থেকে ঋণ নেওয়া হয়। ঋণের জন্য যে সম্পদ বন্ধক রাখা হয় তার দাম বেশি দেখালে বেশি ঋণ পাওয়া যায়। বাজারে আদানি গোষ্ঠীর মোট দেনার পরিমাণ ২.২ লক্ষ কোটি টাকা। তার মধ্যে ২৭ হাজার কোটি টাকা ভারতীয় ব্যাঙ্কের কাছে ও ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশি ব্যাঙ্কের কাছে। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশের আগে আদানির সম্পদ ছিল ১০ লক্ষ কোটি টাকার মত। যদি ওই রিপোর্ট অনুযায়ী শেয়ারের দামে ৮৫ শতাংশ পতন ঘটে তাহলে ওই সম্পদ ১.৫ লক্ষ কোটি টাকায় নেমে আসবে। ফলে ব্যাঙ্কের কাছে নেওয়া ঋণ, যা সম্পদের মাত্র ৬.৩ শতাংশ ছিল, তা সম্পদের ৪২ শতাংশে পরিণত হবে। দ্বিতীয়ত, সামগ্রিক ঋণ সম্পদের দেড় গুণ হবে। অর্থাৎ ব্যাঙ্ক ও অন্যন্য ঋণদাতাদের ঝুঁকি যতটা দেখানো হয়েছিল তার তুলনায় ৭ গুণ বেড়ে যাবে। তৃতীয়ত, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট কোম্পানি কর্তৃক প্রকাশিত মুনাফার ভিত্তিতেই ওই শেয়ারের দামের সঙ্গে মুনাফার অনুপাতের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছে। কিন্তু তারা আদানির হিসাবের বিষয়েও ইঙ্গিত করেছে। যে অডিটর আদানির মূল কোম্পানির অডিট করেছে তারা এতটাই ছোট যে আদানিগোষ্ঠী দ্বারা প্রস্তুত লাভক্ষতির হিসেবকে অগ্রাহ্য করা তাদের পক্ষে মুশকিল। অপরদিকে বড় যেসব অডিট সংস্থা আদানিগোষ্ঠীর কিছু কোম্পানির অডিট করেছে তারা ওই সব হিসেবকে সম্পূর্ণ সঠিক বলে মনে করেনি। সুতরাং মুনাফা দেখানোর ক্ষেত্রেও কোনো কারচুপি থাকতেই পারে। প্রসঙ্গক্রমে  ২০০৮ সালে প্রকাশ পাওয়া সত্যম কেলেঙ্কারির কথা উল্লেখ্য। যেখানে মুনাফা অতিরিক্ত দেখিয়ে ও তাকে যাথার্থ দিতে অস্তিত্বহীন ফিক্সড ডিপোজিট দেখিয়ে ৭ হাজার কোটি টাকার কারচুপি করা হয়েছিল। ফলে ওই অতিরিক্ত মুনাফার ভিত্তিতে শেয়ারের দাম বাড়ানো হযেছিল এবং সেই অতিরিক্ত দামে শেয়ার বিক্রি করে সত্যম কম্পুটারের মালিক বি আর রাজু মুনাফা করেছিল।

এমনটা হতেই পারে যে, আদানিগোষ্ঠী  যে ব্যবসায়িক অনুমানের ভিত্তিতে ব্যাঙ্ক বা অন্যান্যদের কাছে থেকে ঋণ করেছে তা মুনাফা প্রদানকারী বা সেই অনুমান তৈরির ক্ষেত্রে কারচুপি করা হয়নি (যদিও এমন কারচুপির কারবারিরা তেমনটা করেননি এমনটা ভাবা কঠিন)। ফলে ওইসব ব্যবসায় লাভ করল এবং আদানিগোষ্টি ঋণখেলাপি হল না। কিন্তু তা সত্বেও দুর্নীতিটা লঘু হয়ে যায় না। কারণ, বর্ধিত শেয়ার দামের ভিত্তিতেই যে আর্থিক পেশী প্রদর্শিত হয়েছে তা আদানিদের বিভিন্ন বরাত পেতে বা বিমানবন্দর, বন্দর, কয়লা খনি পেতে অগাধ সাহায্য করেছে। ওই ভুয়ো আর্থিক শক্তিই ব্যাঙ্কগুলিকে দেখিয়ে ঋণ পেয়েছে আদানি ও সেই ঋণ ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন পরিকাঠামোগত সম্পদ কুক্ষিগত করতে। ফলে ঋণ ফেরত দেওয়া বা না দেওয়া নিরপেক্ষভাবেই আদানিগোষ্ঠী  বিপুল দুর্নীতি করেছে বলেই হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট থেকে মনে হচ্ছে। অপরদিকে এলআইসি নিজেদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকে যাথার্থ প্রদানে তৎপর হয়ে বলতে শুরু করেছে যে তারা যে দামে আদানির শেয়ার কিনেছিল তার থেকে, শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ার পরেও, বর্তমান মূল্য বেশি। কিন্তু এটা বলছে না যে যদি হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট অনুযায়ী পতন ৮৫ শতাংশ হয় তাহলে তা আদানির শেয়ারের ক্রয়মূল্যের অর্ধেকে নেমে আসবে। এমনকি, আদানি এন্টারপ্রাইজ যে এফপিওর মাধ্যমে বাজার থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা তুলেছিল তাতেও এলআইসি বিনিযোগ করেছিল যদিও সেই সময়ে বাজারে ওই শেয়ারের দাম এফপিও-র দামের থেকে অনেক কম ছিল।  স্বভাবতই প্রশ্ন করতে হয় যে, এলআইসি কেন আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হবে যে, ওটি এলআইসি’র নিজস্ব সিদ্ধান্ত কিন্তু আন্দাজ করা যায় কীভাবে মোদিজি ও আদানির ঘনিষ্টতা এলআইসিকে অনুরূপ বিপুল বিনিয়োগে বাধ্য করেছে।

২০ হাজার কোটি টাকার এফপিও বাজার থেকে তোলার পরেও আদানি তা ফেরত দেবে বলে ঘোষণা করেছে। তার পরে পরেই আদানি গোষ্ঠী শেয়ার বন্ধক দিয়ে নেওয়া ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ সময়ের আগেই ফেরত দিয়ে দিয়েছে । তাছাড়া বিদেশি ব্যাঙ্কের কাছে প্রদেয় ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণও সময়ের আগেই ফেরত দেবার কথা ঘোষণা করেছে। এসবই নাকি বিনিয়োগকারিদের আস্থা ফেরানোর জন্য করা হচ্ছে। এফপিও’র মাধ্যমে তোলা ২০ হাজার কোটি টাকা মূলত: ঋণ শোধ করার জন্যই ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। তাহলে তা ফেরত দেওয়ার পরেও প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা শোধ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে কোন যাদুবলে? তাহলে কি ঋণ শোধের জন্য ওই ২০ হাজার কোটি টাকার ব্যবহার করার কথা কোনো অর্থই বহন করে না। এই হেয়ালিটির উত্তর অন্য কোনো গবেষক দেবেন হয়তো।

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট এছাড়াও এক গভীর রহস্যময় কেলেঙ্কারির দুনিয়ার সঙ্গে দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর যোগসূত্রের দিকে ইঙ্গিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে গৌতম আদানির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সুবিদিত। অপরদিকে আদানি পরিবারের ব্যবসায়িক কারচুপি ও দুনম্বরীর ইতিহাস যথেষ্টই প্রকট। আদানি এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, গৌতম আদানির ভাই রাজেশ আদানি পূর্বে দু’বার হিরের ব্যবসায়ে দুনম্বরির জন্য গ্রেফতার হয়েছে। ডিরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ওই হিরে ব্যবসায়ে কারচুপিতে অন্যতম অভিযুক্ত, আদানির ভগ্নিপতি সমীর ভোরা অস্ট্রেলিয়ায় আদানির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর। গৌতম আদানির দাদা বিনোদ আদানি মরিশাস, সাইপ্রাসের শেল কোম্পানিগুলির অন্যতম সংগঠক। তার সঙ্গে চিনের নাগরিক অনুরূপ এক ধোঁয়াটে ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বিনোদ আদানির মেয়ের শ্বশুর হচ্ছে হিরে ব্যবসায়ে কারচুপি করে ব্যাঙ্কের টাকা তছরূপকারি দেশ থেকে পলাতক যতীন মেহতা। বিনোদ আদানির সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে এদেশের বৃহত্তম শেয়ার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত কেতন পারেখের দেশ থেকে পলাতক হিসেব রক্ষক ধর্মেন্দ্র দোশির। সব মিলিয়ে আদানির শিল্প সাম্রাজ্যকে এক মাফিয়াতন্ত্র বলেই মনে হয়। সেই মাফিয়াতন্ত্রের সঙ্গে কি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কোনো যোগাযোগই নেই?

এমনটা হতেই পারে যে, আদানিগোষ্ঠী র শেয়ারের মূল্যের পতন থেমে গেল। এমনটা হতেই পারে যে, আদানিগোষ্ঠী  তাদের ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ করল। এমনিতেই সরকারি বদান্যতায় পরিকাঠামো শিল্পে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির সুযোগ আদানি পেতে চলেছে, অন্যান্য সুবিধে দানের মধ্য দিয়ে আদানিকে সহায়তা মোদিজি করতেই পারেন। ফলে এই সঙ্কট থেকে আদানি পরিত্রাণ পেতে পারে। কিন্তু তাসত্বেও এমনটা বলা যাবে না যে শেয়ারের দামে কারচুপিতে আদানি নিষ্কলুস। মনে রাখা দরকার আজ অবধি বোফর্সের দুর্নীতির কিনারা হয়নি, কিন্তু সেই শ্লোগান, “গলি গলি মে শোর হায় রাজীব গান্ধি চোর হায়” তাতে ভুল প্রমাণিত হয়নি। আজও তেমনি আদানি মোদি আঁতাত ও আদানির দুর্নীতির বিরুদ্ধে ওঠা শ্লোগান কোনোভাবেই ভুল বলে গণ্য হবে না কারণ আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার মূল্যে যে কারচুপি হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট সামনে নিয়ে এসেছে তা সমস্ত আইন, হিসাবশাস্ত্র ও শেয়ার বাজারের মাপকাঠিতে সর্বৈব সঠিক।

1 Comments

দেবব্রত শ্যাম রায়

13 February, 2023

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন। আদানির আর্থিক কেলেঙ্কারির এত সহজবোধ্য লেখা বাংলাভাষায় আগে চোখে পড়েনি। তা সত্ত্বেও একটি ব্যাপারে খটকা রইল, যা নিতান্তই আমার অজ্ঞতাজনিত। হিন্ডেনবার্গ কীভাবে বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করে তারপর শেয়ারের দাম কম দামে কিনে মুনাফা করে, এই বিষয়টি ঠিক বুঝতে পারলাম না। যতদূর জানি, দাম কম থাকলে শেয়ার কিনে শেয়ারের দাম বাড়লে তা বেচে মুনাফা করা যায়। এক্ষেত্রে, ক্রমটা উলটে গেল কেন? আবারও বলছি, হয়তো এ প্রশ্ন নিতান্তই আমার অজ্ঞতাজনিত, খুব সাধারণ কোনও জিনিস হয়তো ধরতে পারছি না। আরেকবার ব্যাখ্যা করে দিলে বাধিত হবে। লেখক ও সহমনকে ধন্যবাদ এমন একটি জরুরি প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য।

Post Comment