সরকার কি আদতে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের প্রতিটি পদক্ষেপকে নজরে রাখতে চাইছে? আধারের সঙ্গে থাকা বায়োমেট্রিক্স সহ বিশাল তথ্য ভাণ্ডার কি ধীরে ধীরে আইনত নজরদারির কাজে ব্যবহৃত হবে? অদূর ভবিষ্যতে আমরা কি এমন কোনও দেশ দেখতে চলেছি; যেখানে সর্বত্র মনে করিয়ে দেওয়া হবে-"BIG BROTHER IS WATCHING YOU"?
আমেরিকান লেখক ফিলিপ কে ডিক বলেছিলেন,"এমন একটা সময় আসবে যখন আর বলা যাবে না যে কেউ আমার ফোনের মাধ্যমে আমার ওপর নজরদারি করছে। ধীরে ধীরে আমার ফোনই আমার ওপর নজরদারি করবে।" আরোগ্য সেতু নামক অ্যাপটি নিয়ে যে বিতর্ক নতুন ভাবে দানা বেঁধেছে তা এই উক্তিকেই আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।
করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া উদ্যোগ আরোগ্য সেতু অ্যাপ। এই অ্যাপ মোবাইলে ডাউনলোড করে রাখতে হবে। জিপিএস এবং ব্লু টুথ ব্যবহার করে এই অ্যাপ জানান দেবে ব্যবহারকারীর করোনা হওয়ার সম্ভবনা কতটুকু। শুনতে মন্দ না লাগলেও নানা মানবাধিকার সংগঠন এবং ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন সহ অনেক সংস্থাই আপত্তি তুলেছে এই অ্যাপ নিয়ে। আপত্তির মূল কারণ অবশ্যই সর্বক্ষণের নজরদারি। আক্ষরিক অর্থেই ব্যবহারকারীর প্রতিটি পদক্ষেপ এই অ্যাপের নজরদারিতে থাকবে। বিরোধী দলগুলিও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে এই অ্যাপ নিয়ে। তেসরা মে আরোগ্য সেতু নিয়ে রাহুল গান্ধীর করা ট্যুইটের পর বিতর্ক আরও বাড়ে। আরোগ্য সেতু অ্যাপ নিয়ে বিতর্কে একটি বিষয়ের দিকে অনেকেই নির্দেশ করছেন। অনেক অ্যাপের কাছেই ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য এবং লোকেশন সংক্রান্ত তথ্য থাকে। আরোগ্য সেতু কি অতিরিক্ত কিছু করবে? আরোগ্য সেতু নিয়ে মূল আপত্তির অনেকগুলি কারণ রয়েছে।
প্রথমত, কারও ফোনে এই অ্যাপ থাকলে তার পুরো গতিবিধি নিখুঁত ভাবে বোঝা যাবে। গতিবিধি অন্য অনেক অ্যাপও বুঝতে পারে। কিন্তু এই অ্যাপ কারও ফোনে থাকলে ব্লুটুথ এবং জিপিএস অন রাখতে হয়। ফলে ব্যবহারকারীর সমস্ত গতিবিধি ওই অ্যাপের তথ্যভাণ্ডারে থেকে যায়। সেই তথ্যভাণ্ডারে কাদের যাতায়াত থাকবে সেই বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য এখনও অমিল। বেশ কিছু আরটিআই দায়ের হলেও এখনও উত্তর আসেনি। ব্লু টুথ অন থাকা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। ব্লু টুথ অন করা থাকলে অনেক সময় মোবাইল হ্যাক হওয়ার সম্ভবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, নিজস্ব সুরক্ষার খাতিরে সবসময়ই মোবাইলের লোকেশন সার্ভিস অফ করে রাখা দরকার। এই কথা শুধু আরোগ্য সেতু অ্যাপ বিরোধীরাই বলছে না, স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বলছে। হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। সাইবার দোস্ত নামে একটি ভেরিফায়েড ট্যুইটার হ্যান্ডেল রয়েছে। সাইবার সেফটি এবং সাইবার সিকিওরিটি অ্যাওয়ারনেসের জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে এই ট্যুইটার হ্যান্ডেল বানানো হয়েছে। এই ট্যুইটার হ্যান্ডেল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক দ্বারাই পরিচালিত হয়। ৩০ এপ্রিল তাদেরই করা একটি ট্যুইটে বলা হচ্ছে, যে সমস্ত অ্যাপ লোকেশন সার্ভিস ব্যবহার করতে চায়; সেগুলিকে অফ করে রাখতে। ইনস্টল করার সময়ে লোকেশন সার্ভিস ব্যবহার করার পারমিশন দিতেও নিষেধ করা হচ্ছে। এদিকে আরোগ্য সেতু অ্যাপে সর্বক্ষণ লোকেশন সার্ভিস অন করে রাখতে হয়।
তৃতীয়ত, ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষা বলছে ভারতের মাত্র চব্বিশ শতাংশ মানুষের কাছে স্মার্টফোন আছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে এই পরিসংখ্যানের একটা অংশ "টেক স্যাভি" নন। গত পয়লা মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে যে প্রেস বিবৃতি এসেছে; তা জানাচ্ছে কনটেনমেন্ট জোনে আরোগ্য সেতু অ্যাপের একশো শতাংশ কভারেজ বাধ্যতামূলক। সমস্ত সরকারি এবং বেসরকারি কর্মীদের বাধ্যতামূলক ভাবে আরোগ্য সেতু ডাউনলোড করতে হবে। এগুলো লকডাউন মেজারস। না মানলে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৫ এর ৫১ থেকে ৬০ নম্বর ধারা মতে জেল এবং জরিমানা হতে পারে। সঙ্গে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১৮৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী শাস্তি হতে পারে। লক্ষণীয় বিষয় হল; সরকার "একশ শতাংশ" শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছে। কনটেনমেন্ট জোনে বসবাসকারী প্রত্যেকের কাছে স্মার্টফোন থাকবে এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। এমন বহু মানুষ; যাঁরা কনটেনমেন্ট জোনে থাকেন, তাঁদের কাছে স্মার্টফোন নেই। এরকম অনেক সরকারি এবং বেসরকারি কর্মচারী আছেন যাঁদের স্মার্টফোন নেই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই স্মার্টফোন না থাকার কারণে তাঁরা আরোগ্য সেতু ডাউনলোড করতে পারবেন না। আইনমতে সরকার যদি এই কারণকে লকডাউন মেজারস ভঙ্গের "রিজনেবল" মেজারস না মনে করে, তাহলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
চতুর্থত, সরকারি, বেসরকারি কর্মচারী এবং কন্টেনমেন্ট জোনে থাকা মানুষ, যাঁদের স্মার্টফোন আছে; হিসেবমতো তাঁরা এখন আরোগ্য সেতু অ্যাপ নিজের ফোনে ইনস্টল করতে বাধ্য। শুনতে অস্বস্তি লাগলেও এটা কার্যত গায়ের জোরেই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৫ অনুযায়ী সরকারের হাতে প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে এই প্রশ্ন ওঠা উচিৎ যে- সরকার দেশের কোনও নাগরিককে তার মোবাইলে কোনও অ্যাপ ডাউনলোড করতে বাধ্য করতে পারে কি? এটা কি গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার তীব্র পরিপন্থী নয়?
পঞ্চমত, আরোগ্য সেতু অ্যাপে ই-পাস দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এই ই-পাস দেখিয়ে করোনা আবহে বাইরে যাওয়া যাবে। এমন ইঙ্গিতও মিলেছে যে লকডাউন পরবর্তী সময়ে আরোগ্য সেতু অ্যাপ ছাড়া দিল্লী মেট্রোতে চড়া যাবে না। বিমানবন্দরেও এই অ্যাপ প্রয়োজন হতে পারে। তাহলে যাঁদের কাছে স্মার্টফোন নেই তাঁদের কী হবে?
ষষ্ঠত, ভারতে যে সংখ্যক স্মার্টফোন রয়েছে, তা মোট জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম। বহু মানুষের কাছে একাধিক স্মার্টফোন রয়েছে। ফলে জনসংখ্যার ভিত্তিতে শতাংশের হার আরও কম। এতো অল্প সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই অ্যাপের ব্যবহার বাড়িয়ে ঠিক কী উপায়ে করোনার মোকাবিলা হবে? যাঁদের স্মার্টফোন নেই; তাঁদের থেকে কি করোনা ছড়াতে পারে না?
সপ্তমত, যে তথ্য আরোগ্য সেতু অ্যাপের তথ্যভাণ্ডারে রইল; সেই তথ্য কোভিড-১৯ কে প্রতিহত করা ছাড়া অন্য কোনও কাজে ব্যবহৃত হবে না তো? ন্যাশনাল ইনফরমেটিক্স সেন্টার ছাড়াও কাদের হাতে ক্ষমতা থাকবে এই তথ্য জানার? সুরক্ষা সংস্থা, পুলিশ সহ অন্যান্য বাহিনীর হাতে ক্ষমতা থাকবে এই তথ্য ব্যবহার করার? ভারতে তথ্য সুরক্ষার উপযুক্ত আইন নেই। ফলে এই সংশয় অমূলক নয়।
অষ্টমত, এই অ্যাপ; ব্যবহারকারীর কাছাকাছি কতজন করোনা রুগী আছেন তা জানান দেয়। এই দেশে চোর সন্দেহে বা গরুর মাংস বহন করার সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। ঠিক কোন ভরসায় এটা বিশ্বাস করা সম্ভব যে কাছাকাছি কোনও মানুষের করোনা হয়েছে এই সন্দেহে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে না? আমাদের দেশে এখন সবকিছুকেই ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলা হয়। করোনা ছড়ানোয় তবলিঘি জামাতদের নিয়ে গোটা দেশে যে পরিমাণে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে; তাতে এই সন্দেহ কি খুব অমূলক?
নবমত, বাস্তবিক এ কথা সত্যি যে আমাদের অনেক তথ্য অনেক ওয়েবসাইট, অ্যাপে থাকে। সেইসব তথ্য গোপনে কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয় বা নজরদারির কাজে ব্যবহৃত হয় বলেও কানাঘুষো শোনা যায়। কিন্তু সবটাই "শোনা" কথা। আইনত এভাবে কারও ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে তার ওপর নজরদারি করা যায় না। করোনার ভয় দেখিয়ে আরোগ্য সেতু এই নজরদারির বিষয়টিকেই কার্যত আইনি রূপ দিচ্ছে না কি?
এর মাঝেই মিডিয়া মারফৎ শোনা যায় যে সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক ভাবে আরোগ্য সেতু ডাউনলোড করতে হবে। বেসরকারি কর্মীদের এবং কন্টেনমেন্ট জোনে অবস্থিত প্রত্যেককে আরোগ্য সেতু ডাউনলোড করতে হবে। আরও শোনা যায় যে লকডাউন পরবর্তী সময়ে নতুন ভাবে তৈরি হওয়া সমস্ত স্মার্টফোনে আরোগ্য সেতু ইন-বিল্ট থাকবে। এই সবকিছু নিয়েই একাধিক আরটিআই ফাইল করা হয়। মিনিস্ট্রি অফ পার্সোনেল অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের কাছে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের আরোগ্য সেতু ডাউনলোড করতে বাধ্য করার আইনি ভিত্তি চাওয়া হয়। তারা কোনও আইনি ভিত্তি দেখাতে পারেনি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে পয়লা মে জারি করা নোটিফিকেশনের ভিত্তিতে আরটিআই করে জানতে চাওয়া হয় যে দেশের কোনও নাগরিককে কোনও বিশেষ অ্যাপ ডাউনলোড করতে বাধ্য করার অধিকার সরকারের আছে কিনা। থাকলে তার আইনি ভিত্তি কী? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক কোনও আইনি ভিত্তি দিতে পারেনি। অর্থাৎ দেশের কোনও নাগরিককে কোনও বিশেষ অ্যাপ ডাউনলোড করতে নির্দেশ দেওয়ার অধিকার সরকারের নেই। এই নিয়ে হইচই শুরু হওয়ার পরে অবশ্য সরকার আরোগ্য সেতু নিয়ে তাদের নির্দেশিকার ভাষা পরিবর্তন করে। "100% coverage" এর বদলে "may", "should" এর মত শব্দ ব্যবহার করা হয়।
আরোগ্য সেতুর তথ্য সুরক্ষা নিয়ে যখন এদিক ওদিক থেকে আওয়াজ উঠতে শুরু করে; তখন সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয় যে এই অ্যাপকে ওপেন সোর্স করে দেওয়া হবে। এই ওপেন সোর্সের অর্থ হল অ্যাপটির যে সোর্স কোড; সেটি পাবলিক ডোমেনে অ্যাভেলেবেল করে দেওয়া। অর্থাৎ, যদি কোনও ডেভেলপার চায়; তাহলে এই কোড ব্যবহার করে সে একইরকম একটি অ্যাপ বানিয়ে ফেলতে পারবে। কিন্তু এই অ্যাপ ওপেন সোর্স হওয়ার পরে অনেক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়াররাই বলতে শুরু করেন যে যে অ্যাপের কোড দেওয়া হয়েছে আর যে অ্যাপ মোবাইলে ব্যবহৃত হচ্ছে; তা এক নয়।
কোনও মানুষ কোথায় গিয়েছেন, কার "কাছাকাছি" এসেছেন; জিপিএস, ব্লু টুথ ব্যবহার করে তা খুঁজে বের করে এই অ্যাপ। এই অ্যাপের জন্য গোপনীয়তার মত মৌলিক অধিকারের কী ভয়াবহ লঙ্ঘন হচ্ছে সেটা সহজেই অনুমেয়। সরকার কি আদতে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের প্রতিটি পদক্ষেপকে নজরে রাখতে চাইছে? আধারের সঙ্গে থাকা বায়োমেট্রিক্স সহ বিশাল তথ্য ভাণ্ডার কি ধীরে ধীরে আইনত নজরদারির কাজে ব্যবহৃত হবে? অদূর ভবিষ্যতে আমরা কি এমন কোনও দেশ দেখতে চলেছি; যেখানে সর্বত্র মনে করিয়ে দেওয়া হবে-"BIG BROTHER IS WATCHING YOU"?