জন্মেছিলাম নানাবাড়িতে। সেটা ভাগীরথী নদীর পশ্চিম পাড়ে রাঢ় বঙ্গের একটি গ্রামে। সেখানে আমি শুধু জন্মাই নি, আমার শৈশবও কেটেছিল। সেখানকার স্কুলে পড়েছিলাম ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। তাই বুঝি ৭১-এর মুক্তি যুদ্ধের বোমা বর্ষণের আওয়াজ আমার কানে না পৌঁছালেও আকাশে যুদ্ধ-বিমান উড়ে বেড়াতে দেখেছিলাম। যদিও তা নিয়ে আমার কোনও আতঙ্ক ছিল না তখন, বয়স তো সবে চার। ‘আতঙ্ক’ শব্দটির সঙ্গেই পরিচয় হয়নি। বরং ওসব নিয়ে প্রচণ্ড কৌতুহল ছিল। আর তা নিয়ে নিজের মতো করে বেড়ে উঠেছিলাম।
মনে পড়ে মুন্তাচাচার সাইকেলের কেরিয়ারে বসে ভাগীরথী পেরিয়ে যেদিন নিজের পৈতৃক-বাড়িতে এলাম, সেদিনের কথা। একেবারে নতুন জায়গা - নতুন পরিবেশ। চারপাশে গাছপালা! ঝোপজঙ্গল! বেশি দূর পর্যন্ত দৃষ্টি প্রসারিত হয় না। দম বন্ধ হয়ে আসে। আরও ভয়ের যেটা ছিল সেটা হল নানাবাড়িতে আমি যে ভাষার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম, এই বাড়িতে সেই ভাষায় কেউ কথা বলে না। আমার দাদু-দাদি, আব্বা-চাচা-ফুফুরা নিজেদের মধ্যে এমন এক ভাষায় কথা বলেন, আমি এক-আধটু বুঝতে পারলেও সেই ভাষায় কথা বলা আমার পক্ষে রীতিমতো শক্ত। তবু চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে দেখে আমার দাদী তো আমাকে বলেই ফেলেছিলেন, ‘বাঙাল কহেকা!’ আমার খুব রাগ হয়েছিল। কিন্তু রাগ দেখানোর সাহস পাইনি। অগত্যা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনে কখনও ওই ভাষা উচ্চারণ করব না। আমি আমার মায়ের ভাষাতেই কথা বলব। বলা যেতে পারে, সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম বিদ্রোহ।
আমার মাতৃকুল খাঁটি বাঙালি। পির-ফকির-দরবেশের বংশ। প্রখ্যাত লোক-গবেষক শক্তিনাথ ঝা মহাশয়ের লেখা থেকে জানতে পারি আমার মাতৃকুলের পূর্ব পুরুষেরা সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল। আর আমাদের পিতৃপুরুষেরা আসলে ছিল বিহার না উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা। কখন কিভাবে তারা এসেছিল এই লালগোলায়, তার ইতিহাস আমাদের জানা নেই।
যাইহোক, আমার আব্বা কিন্তু আমার সেই বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিলেন। ক্লাসের বই বাদেও তিনটে থান ইটের মতো বই হাতে দিয়ে বলেছিলেন, স্কুলের বই ছাড়াও এগুলি তোমায় পড়তে হবে। না পড়লে জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হবে না।
আব্বার আদেশ অমান্য করিনি। কিছু না বুঝেই পড়েছিলাম বইগুলি। বাংলা অনুবাদে। বইগুলি ছিল ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ আর ‘ইলিয়াড’-‘ওডিসি’। পরে আরও অনেক বই- ‘রামমোহন রচনাবলী’, ‘মধুসূদন রচনাবলী’, ‘বিবেকানন্দ রচনাবলী’, ‘বঙ্কিম রচনাবলী’, ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’, ‘সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী’, ‘বৈষ্ণব পদাবলী’- আরও কত কত বই! বাংলা ভাষার সব অমূল্য সম্পদ। এসব পড়ে জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছে কিনা জানি না, তবে আপন মাতৃভাষার প্রেমে এমনই মজে আছি যে, ঘুমে জাগরণে এই ভাষা ছাড়া আমি স্বপ্নও দেখতে পারি না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার জীবন দেবতা। তার গান আমাকে আপদে বিপদে রক্ষা করে। আমি গর্বের সঙ্গে বেঁচে থাকি।
যেমন গর্ব নিয়ে বেঁচে আছে আমার ছাত্র সহিদুল। তার পঞ্চম শ্রেণি। একদিন বাংলা পড়াচ্ছি। আল মাহমুদের কবিতা ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’। যার প্রথম দু’লাইন –
“ নারকোলের ওই লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠান্ডা ও গোলগাল। ”
এই কবিতাটির প্রথম আট লাইন বার কয়েক উচ্চারণ করে পড়িয়ে ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রীকে বললাম, জোরে উচ্চারণ করে অন্তত আরো তিনবার পড় তোমরা নিজে নিজে।
ওরা পড়তে শুরু করল। সেই ফাঁকে আমি কবি আল মাহমুদকে নিয়ে ভাবতে বসলাম। বাংলা ভাষায় এমন কবি ক’জন এসেছেন? তাঁর ‘সোনালি কাবিন’ আর ওই যে ভাষাদিবস নিয়ে লেখা সেই বিখ্যাত কবিতাটি -
“ ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত। ”
কোন ছেলেবেলায় পড়েছিলাম। আহা!
আমার এইসব ভাবনার মাঝে সহিদুল বলে উঠল, স্যার- তিনবার পড়া হয়ে গেল। আপনাকে শোনাব?
বললাম, শোনা।
সহিদুল পড়তে শুরু করল –
“ নারকোলের ওই লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের ‘ঠিকিন’ চাঁদ উঠেছে ঠান্ডা ও গোলগাল। ”
আমি ভুল শুনছি না তো! আমার খটকা লাগল। সহিদুলের পড়া থামিয়ে ওকে প্রথম থেকে আবার পড়তে বললাম। সহিদুল আবার পড়তে শুরু করল –
“ নারকোলের ওই লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের ‘ঠিকিন’ চাঁদ উঠেছে ঠান্ডা ও গোলগাল। ”
আবার আমার খটকা লাগল। আবার পড়তে বললাম। আবার পড়ল সে। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম ‘মতো’ শব্দটির জায়গায় সে বারবার ‘ঠিকিন’ শব্দটির প্রয়োগ করছে। এবং এটা করাটাই খুব স্বাভাবিক। আমার স্কুলটি যে অঞ্চলে সেখানকার মানুষেরা ওই ‘ঠিকিন’ শব্দটি ‘মতো’ শব্দটির জায়গায় পরম আদরে ব্যবহারে অভ্যস্ত। একেই বলে মায়ের ভাষা- মাতৃভাষা।
আমার সাহিত্যচর্চায় আমি কখনোই ভাষা নিয়ে তেমন কিছু ভাবিনি। ভাবতে হয়নি। আমার চারপাশে যারা আছে, যাদের আমি সবসময় দেখি-কথা বলি, এমনকি গাছপালা, পশুপক্ষী, ইটপাথর, ধুলাবালি- এরাই সব আমার সাহিত্যে চরিত্র হয়ে উঠে আসে। নিজের নিজের ভাষায় কথা বলে। মনের ভাব প্রকাশ করে। একে অপরের সান্নিধ্য লাভ করে। এটাই তো স্বাভাবিক।
যেমন আমাদের পড়শি ঠোটকাট্টি ফুফু। আসল নাম কী ছিল, সেটা সে নিজেও ভুলে গিয়েছিল। তাঁর ঠোট কাটা ছিল বলে লোকে তাঁকে ঠোটকাট্টি বলে ডাকত। মেয়ে সজ্জ্বাকে নিয়ে সে পনেরোদিন-বিশদিন কোথায় হাওয়া হয়ে যেতেন। যখন ফিরে আসতেন, আমরা জিজ্ঞেস করতাম, কোথায় গিয়েছিলে ফুফু? ফুফু বলতেন, শিরোদ্যাশ গেলছিনু বাপ।
এই ‘শিরোদ্যাশ’ কোথায় আমি জানতাম না। পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপে, ভারতবর্ষের ম্যাপে তন্ন তন্ন করে খুঁজে পাইনি। অনেক পরে জেনেছিলাম ‘শিরোদ্যাশ’ মানে হল ‘শির’ অর্থাৎ মাথার দিকে যে দেশ। অর্থাৎ মালদা-দিনাজপুর। ঠোটকাট্টি ফুফু মেয়ে সজ্জ্বাকে সঙ্গে করে ভিক্ষা করতে যেতেন সেইসব দেশে। সংগ্রহ করে নিয়ে আসতেন জীবন ধারণের রসদ।
আমিও সহিদুলের ঠিকিন নিজের ভাষা ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। আর ঠোটকাট্টি ফুফুর ঠিকিন ভাষার রসদ সংগ্রহ করি তাঁদের অনাবিল সাধারণ জীবন ধারণ থেকেই। এর জন্য আমার দাদীর ঠিকিন কেউ আমায় বলতেই পারেন, বাঙাল কাহেকা! আপত্তি করব না।