পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

জোসেফ কে ও অবিরাম ভয়ের গল্প

  • 29 May, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 2212 view(s)
  • লিখেছেন : দেবতোষ দাশ
আমি ভয় পাই। ভীষণ ভয়। বস্তুত বাইরে বেরোতেই এখন ভয় হয়, পাছে কখন কোন ঝামেলা বা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি। ভিজে বেড়ালের মতো সুখী গৃহকোণ থেকে বেরোই, কাম-কাজ সেরে ফের মাথা নীচু করে ঢুকে যাই বাড়ির নিরাপদ কোটরে। আগে হীনম্মন্যতায় ভুগতাম, নিজেকে শিরদাঁড়াহীন ভাবার আক্ষেপে মুষড়ে থাকতাম, এখন আর থাকি না। খোঁজটোজ নিয়ে দেখলাম, আমার মতো গোলা লোক মোটেই একা নয়, শচীন থেকে সৌরভ, বিরাট কোহলি থেকে স্মৃতি মান্ধানা, পিভি সিন্ধু থেকে থেকে এমএস ধোনি, আমাদের জাতীয় 'বীর'গণ সবাই আমার মতো, কেন্নোবৎ। শিরদাঁড়াহীন। প্রতিপত্তির সামনে ভয়ে গুটিয়ে যাওয়া পাবলিক।

কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি, উত্তর প্রদেশের বাহুবলী বিজেপি এমপি, সিরিয়াল সেক্সুয়্যাল হ্যারাসার ব্রিজভূষণ শরণ সিং-এর হাতে দিনের-পর-দিন যৌনলাঞ্ছনার শিকার হতে-হতে, ফাইট ব্যাক করা ভারতীয় কুস্তিগিরদের আন্দোলনের পাশে, এই ন্যাশানাল হিরোরা কেউই দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছেন না! মাঠে যাঁদের 'মাচিসমো' দেখে আমি শিহরিত হই, কেঁদে ফেলি উত্তেজনা ও আবেগে, মাঠের বাইরে তাঁদেরই ম্যাদামারা ভেজা বারুদ হিসেবে দেখতে এখন আমিও ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি! আমি জানি, সংগঠিত এই মাফিয়া বাহিনির বিরুদ্ধে কথা বললে প্রতিবাদীর লাইফ হেল করে দেওয়া হবে। ইডি, সিবিআই, ইউএপিএ নামক অক্টোপাস দিয়ে পেঁচিয়ে ফেলা হবে সাধের জীবন। যাঁরা রাজ্যপাট নিয়ে বসে আছেন, যাঁদের হারানোর আছে অনেক কিছু, তাঁরা তাই সহজে প্রতিবাদ করতে পারেন না। এমন ভয়াবহ অবিচার, অপরাধীকে আড়াল ও তাঁদের সহ-খেলোয়াড়দের ওপর পাল্টা-অত্যাচার দেখেও কেন তাঁরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ছেন না, তার কারণ জানি বলেই এখন আর শিরদাঁড়াহীনতায় অত হীনমন্যতায় ভুগি না। চোখের সামনেই তো প্রতিবাদী অ্যাক্টিভিস্টদের উদাহরণ জ্বলজ্বল করছে, গারদের ভিতরে দীর্ঘদিন পড়ে আছেন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী গৌতম নওলাখা, কবি ভারাভারা রাও, সাবেক ছাত্রনেতা উমর খালিদসহ অসংখ্য প্রতিবাদী। দীর্ঘ তিন বছর জেল খেটেছেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী সুধা ভরদ্বাজ এবং সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান। খ্রিস্টান সাধু ও আদিবাসী আন্দোলনের কর্মী স্ট্যান স্বামী পচে মরলেন গারদের অন্ধকারে।  

গত বছর খবরের কাগজে পড়েছিলাম, কেউ বিরোধিতা করলেই বীরভূমের বেতাজ বাদশা অনুব্রত মণ্ডল 'গাঁজা কেস' দিতেন। মানে আপনাকে ফাঁসাবার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে, আপনি মাদক পাচার করছেন, এমন গপ্পো ফেঁদে, সটান গারদে। প্রাক্তন পুলিশকর্তারা অনেকেই বলেছেন, এ নাকি এমন মামলা, যাকে খুশি ফাঁসিয়ে দেওয়া সম্ভব। জায়গা মতো প্রয়োগ করলে কার্যত শেষ করে দেওয়া যায় নিশানায় থাকা ব্যক্তির ভবিষ্যৎ।

তৃতীয় বিশ্বের দেশে মামলার খরচ, দীর্ঘসূত্রিতা ইত্যাদি সামলে, লড়াই করে মামলার কবল থেকে একসময় মুক্তি পেলেও, সে-মুক্তিকে কি ‘ন্যায় বিচার’ বলা যায়? তার ওপর, আদালতের বিচারের পাশাপাশি চলবে গণমাধ্যমের বিচারও, যাকে আমরা এখন মিডিয়া ট্রায়াল বলি। সংবাদ তো বহুদিন আগেই ‘মূলত কাব্য’ থেকে ‘পণ্য’ হয়েছে, নিজেদের টিআরপি ( অধুনা রিচ বা ভিউজ) বাড়াতে অধিকাংশ মিডিয়া এখন সেই ‘পণ্য’কে এমন বে-পরোয়া নির্বিচারের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, গ্রাহকের চোখে খবর এখন আর সত্য ও সুন্দর নয়, সস্তা ও সন্দেহজনক। কিন্তু ততক্ষণে এই মিডিয়া ট্রায়ালের পাকে পড়ে অচিরেই সে-ই ‘শিকার’ বা ‘নিশানা’ বলি হয়ে গিয়েছেন, তার মুণ্ডু ও ধড় দ্বিখণ্ডিত, যুপকাষ্ঠ রক্তলাঞ্ছিত। অপরাধী ও নিরপরাধ, মুহূর্তে একই দণ্ডে দণ্ডিত, তাহলে খামোকা ‘অ-ন্যায়ের’ বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চাপ নিয়ে লাভ কী?

এক সকাল বেলা, ব্যাঙ্ক চাকুরে জোসেফ কে হঠাৎ গ্রেফতার হয়ে যাবে, তাকে হেফাজতে নিতে আসবে দু’জন অজানা লোক, আর কী আশ্চর্য জোসেফ কে’র অপরাধও অজানা! কাফকার ট্রায়াল প্রকাশের পর প্রায় একশ বছর বয়স হতে চলল সভ্যতার, অথচ আমরা এখনও, এই ২০২৩-এও সেই শ্বাসরোধী এক ট্রায়াল-যাপন করে চলেছি। ইম্পার্সোনাল এক অন্ধ অথিরিটি যেন আমাদের ঘিরে ফেলেছে। ক্ষমতা তো নিজে অদৃশ্য, আলোর মতো, তাকে দেখা যায় না, তার প্রয়োগ দেখা যায়। ক্ষমতার অদৃশ্য অক্টোপাস তার জগতে একটা ‘কনসেপ্ট’ তৈরি করে, কাফকায়েস্ক সেই জগতে আমাদের বাস।

কোনও অজানা কোতোয়াল অজানা অপরাধের খতিয়ান নিয়ে আমাদের সকাল-সকাল ধরতে আসছে না, কিন্তু সেই অদৃশ্য অথরিটির এমনই অদৃশ্য প্রতাপ, আমরা নিজেরাই নিজেদের অপরাধী ভেবে ফেলছি! প্রতিনিয়ত ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার অগর্লহীন ভয় স্তব্ধ করে রাখে আমাকে। নিজেই নিজের ওপর সেন্সরশিপ প্রয়োগ করে নিশ্চুপ থাকি। সোশ্যাল মিডিয়াতেও ভয়ে-ভয়ে নির্বিষ দু’কথা প্রকাশ্যে লিখি। রাতে বাড়ি ফিরে বন্ধুদের প্রাইভেট গ্রুপে মিম শেয়ার করে নিজের গৃহপালিত প্রতিবাদী সত্তার পরিচয় রাখি, এটুকুই আমার ক্যাথারসিস। এক অদৃশ্য ‘গাঁজা কেস’ আমার দিকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে, ঘাড়ের কাছে সেই ক্লোজ সার্কিট সর্বেক্ষণ দৃষ্টি নিয়েই আমার বাঁচা-মরা।

এখন প্রশ্ন একটাই, এই মুখ বুজে থেকেও আমি বাঁচব তো? যারা তীব্র অনাচার ও অবিচারের প্রতিবাদ না-করে বেঁচে যেতে চাইছেন, পাঁচ-পাব্লিক পাঁচু থেকে সেলেব পঞ্চানন সব্বাই, সত্যিই তারা বাঁচবে তো!

‘জোসেফ কে’ শেষ দিনেও জানতে পারেনি তার অপরাধ কী! কুকুরের মতো তাকে মরতে হয়েছিল!

 

0 Comments

Post Comment