চারিধারে আকাশ ঢেকে ফেলা দালান কোঠার মাঝে টিকে আছে এক টুকরো সবুজ।একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে সেই সবুজের ফাঁকে একটি জীর্ণ ঘর দেখা যাবে।সন্ধ্যার অন্ধকারে এলে হয়তো মোমের আলোও চোখে পড়বে।বিকেলে বা শেষ দুপুরে সেখানে হয়তো কিছু সমস্যাগ্রস্ত আগন্তুক বা মাজারের খিদমত করা এক বৃদ্ধকেও দেখা যেতে পারে।মাজার আর পাশের এই কবরস্থান।দক্ষিণ কলকাতার এই অঞ্চলের অতীতের মুসলিম বসতির শেষ চিহ্ন।
খাদেম রফিক শেখ ঝিমোচ্ছেন।সন্ধ্যার কিছু পড়েই মাজারের দরজা লাগিয়ে চলে যাবেন তিনি।কবরস্থানের অনেকটা অংশই বেদখল হয়ে গেছে।মাজারটা ছিল বলে আশেপাশের বসত বাড়িগুলো সেই অবধি এসেই থেমে গেছে।যে টুকু টিকে ছিল তার চার ধারের সীমানা দেওয়া তারের বেড়াও প্রায় উধাও হয়ে গেছে।তাতেও চিন্তিত নন রফিক শেখ।এখানে নেওয়ারই বাকি আছে? আশেপাশের কিছু কাঁটা লতার ঝোপঝাড়, আর এই পাথরের কবরওয়ালা ঘর।এর ওপরের চাদর আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু মোমবাতি ধুপকাঠি।এগুলো বেচে এক মুঠো বিড়িও জুটবে না।তাই ভাবনা ওনেই রফিক শেখের।আগের খাদেম মারা যাওয়াতে বয়সের ভারে কায়িক পরিশ্রম থেকে অবসর নেওয়া মুটে মজুর রফিক নিজের কাঁধে মাজার খিদমতের ভার তুলে নিয়েছিলেন।সে জন্য সকাল সকাল এখানে চলে আসায় বাড়িতে বসে গঞ্জনা শুনতে হয় না যেটা তাঁর বয়সী অনেককেই শুনতে হয়।মাজার জিয়ারত করতে এসে কেউ যদি কিছু দিয়ে যায় তবে সেটা তাঁর উপরি পাওনা।তিনি নিজে থেকে কিছু চান না।সন্ধ্যা নামার কিছু পরে ঝাড় পোঁচ করে চলে গেলে মাজারের বন্ধ দরজার ফাঁক ফোকর গলে টিমটিম করে কখনো সখনো মোমবাতির আলো আসতে থাকে।সেখানেই আজ দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক।আকাশে চাঁদ উঠে জায়গাটায় খুব অন্ধকার নেই, তবুও কেউ তাকে লক্ষ্য করবে সেই সম্ভাবনা খুব কম।চারিদিকের উঁচু বাড়িতে যাঁরা থাকেন তাঁদের কারোরই ঠেকা পড়েনি এই পরিত্যক্ত কবরস্থানে কি হচ্ছে উঁকি দেওয়ার।সেখান থেকে কোন শব্দ এলেও সেটা কুকুরের হুটোপুটির মতই শোনাবে।মোবাইলের আলোয় জেব থেকে কিছু কাগজ বার করে দেখে নিল সেই যুবক।
বছর কয়েকের পুরনো খবরের কাগজ খুঁজলে হয়তো ভেতরের পাতার এক কোণে একটা খবর চোখে পড়বে।যার শিরোনাম ছিল "শিশু পুত্রসহ নিখোঁজ গৃহবধু"।এক দুবার হয়তো এই খবর সংবাদপত্রে স্থান পেয়েছিল তারপর আর নয়।
ছোট্ট শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে যুবকের মনে পড়ে গেল মায়ের শেষ জীবনের শয্যাশায়ী অবস্থায় বলে যাওয়া বিক্ষিপ্ত কথা গুলো। "দরজার পাশের কবর ", "দুইহাত...দুই হাত নিচে" এই কথাগুলো অনেকবারই শুনেছে তখন।হঠাৎ একবার সেই একবারই শোনা গেছিল জায়গার নাম।সেই জায়গা যেখানে কেটেছে তার ছোটবেলা।ঘরের বাইরে যাই থাক, ঘরের ভেতরে ছিল বাবা মায়ের অশান্তির বিষময় পরিবেশ।তারপর একদিন বলা ভালো এক রাতে মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে পড়া।তারপর কেটে গেছে এই কবছর।
যুবক চলেছে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আলোকিত রাস্তা ধরে।দুই হাতের অনেক বেশিই খুঁড়তে হয়েছিল।খুঁড়ে যা পাওয়া গেছিল তা নিয়ে এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি সে।একবার মনে হয় বেচেই দেবে গয়নাগুলো, আবার মনে হয় কি দরকার, থাকুক না সেগুলো স্মৃতিচিহ্ন হয়ে।শুধু মায়ের স্মৃতিই নয়, তার ছেলেবেলার জায়গার।