পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

শ্রমজীবী ক্যানটিন

  • 28 November, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1166 view(s)
  • লিখেছেন : রাজেন দাস
কনক বোসবাড়ির কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে রওনা দেয় দত্তপুকুর শ্রমজীবী ক্যান্টিনে। আগে বোসবাড়ির রান্না, বাসনমাজা, কাপড়কাচা, ঘরের মেঝে মোছা, উঠোন ঝাঁট দেওয়া সব কাজই করতো। কি এক রোগ এলো পোড়া দেশে। ওরা সব কাজ বন্ধ করে দিল। অনেক কাকুতি মিনতি করে আধা মাইনেতে বাইরের বাগান আর উঠোন ঝাঁট দেওয়ার কাজটুকু বজায় রেখেছে। তার স্বামী পরেশ পল্ল্যে বোম্বে গিয়েছিল সোনার কাজ করতে। সেখানেও করোনা দেখা দেওয়ায় মালিক কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। বলে দিয়েছে যে যার দেশে ফিরে যেতে। তাদেরই বা দোষ কি। বাজার বন্ধ, দুবাইয়ের খদ্দেররা আর আসছে না। বসিয়ে বসিয়ে কতদিন তাদের খাওয়াবে।

পরেশরা চেষ্টা করলো ট্রেনে ফিরে আসতে। রেল কোম্পানি ট্রেনও দিয়েছিল। কিন্তু বাংলার গরমেন্ট রাজি নয় ঐ ট্রেনকে হাওড়া স্টেশনে আসতে দিতে। বলে দিল, "করোনা এক্সপ্রেস"কে ঢুকতে দেবে না বাংলায়। বাধ্য হয়ে তারা ঠিক করলো, দল বেঁধে হেঁটে বাড়ি ফিরবে। কখনও রেললাইন ধরে, কখনও বড় রাস্তা ধরে। সারি সারি মানুষ তাদের বৌ-বাচ্ছা নিয়ে হাঁটছে। কনক তারিণীখুড়োর চায়ের দোকানের টিভিতে দেখেছে সেই সব পরিযায়ী শ্রমিকদের হেঁটে বাড়ি ফিরতে। কখনও পরেশকে টিভিতে দেখা যায়নি। কেউ বলেও নি পরেশকে দেখেছে। তবু কনক জানে সে আসছে। কার না কার ফোন থেকে তারিণীখুড়োর দোকানের ফোনে জানিয়েছে সে আসছে। মাঝে মাঝে খবর আসে, কিছু ঘুমন্ত মানুষ ট্রেনে কাটা পড়েছে। বড় রাস্তার ধারে ঝুপড়িতে পরিবার নিয়ে ঘুমাচ্ছিল কিছু শ্রমিক। চলন্ত ট্রাক তাদের পিসে দিয়ে চলে গেছে। কি মর্মান্তিক দৃশ্য! বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে। ছোটে তারিণীখুড়োর দোকানে, যদি কোন খবর থাকে, জানতে। জিজ্ঞাসা করতে বুক কাঁপে। কাজ নেই বাবা জিজ্ঞাসা করে। খবর থাকলে নিশ্চয় পেত। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে ঘরে ফিরে আসে। বাচ্ছাদের জন্য রুটি-তরকারি করে রেখে বিছানায় একটু গড়িয়ে নিয়ে দুটো নাগাদ বেরিয়ে পড়ে ক্যানটিনের উদ্দেশ্যে। অনেকটা পথ। কমলাদিদের সাবেকি দুর্গামন্দিরের লাগোয়া মায়ের যে বিশাল একটা ভোগ তৈরির ঘর ছিল সেটাকেই শ্রমজীবী ক্যানটিন করা হয়েছে। যত সহজে বলা হ'ল তত সহজে করা যায়নি। অনেকগুলো শরিক। সকলকে রাজি করানো চাড্ডিখানি কথা নয়। তাছাড়া এখন যারা ক্ষমতায়, তারাও কলকাঠি কম নাড়েনি। তবু গজেনদা আর কমলাদি হাল ছাড়েনি। শেষপর্যন্ত সবাইকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে এখানে ক্যানটিন চালু করতে পেরেছিল।

কনক দেখলো, তারিণীখুড়োর চায়ের দোকান খুলে গেছে। তোলা উনুনে ঘুঁটে গুলকয়লা সাজিয়ে আঁচ দিচ্ছে। ধোঁয়ায় ঘিরে ধরেছে তারিণীখুড়োকে। কনক তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। খুড়ো
কিন্তু ঠিক চিনেছে। হাঁক দেয়,
---"কনক না? হনহনিয়ে চললি কোথায়?
---"ক্যানটিনে গো খুড়ো।" কনক সাড়া দেয়।
---"ভ্যাকসিন নিয়েছিস?"
---"না গো খুড়ো। সে অনেক হ্যাপা। ভোরবেলা গিয়ে লাইন
দিতে হবে। টিকে নিয়ে ফিরতে তিনটে বেজে যাবে। লোকের বাড়ি কাজ করে পেট চালাই। একটা দিন নষ্ট করলে বাবুদের চলবে কেমন করে?"
---"পরেশকে ভোরবেলা লাইন দিতে পাঠিয়ে দিবি। তুই বেলায় গেলেই হবে।" কনক এগিয়ে এসে খুড়োকে রাগিয়ে দিতে বলে, "খুড়ো, দুয়ারে না কি সরকার এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের ব'লো না গো, দুয়ারে এসে টিকেটা দিয়ে যেতে। তাতে আমাদের যেমন সুবিধে হবে, বাবুদেরও সুবিধে হবে।"
তারিণীখুড়ো খ্যাকখ্যাক করে তেড়ে আসে। বলে, "এই এক তোদের দোষ। খেতে পেলে শুতে চাস। যা, ভাগ।"
কনক আর দাঁড়ায় না। এগিয়ে যায় হাসতে হাসতে।
যাওয়ার সময় একটা হাউসিং কমপ্লেকসের পাশ দিয়ে যেতে হয়। পথের পাশে প্রচুর এঁটো খাবার পড়ে থাকতে দেখে সে বোঝে, গত রাতে এখানে পার্টিফাটি হয়েছিল বোধ হয়। দুটো নেড়ি কুত্তা আর একটা আধপাগলা মানুষ সেই এঁটো খাবার ভাগাভাগি করে খাচ্ছে। অনেক বোতল পড়ে থাকতে দেখে বোঝে, শুধু খানা নয়, পিনাও চলেছে হরদম। কনক আশ্চর্য হয় এই ভেবে, কাজের অভাবে মানুষ যখন একমুঠো অন্নের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে, সেখানে এরা খাবারের এত অপচয় কেন করে? আকাশে তাকায়, দেখে দুটো চিল তখনও ঘুরপাক খাচ্ছে। তারাও ঐ খাবারে ভাগ বসাতে একটু পরেই নামবে।
একটু এগুতেই বড় রাস্তা। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে বসে আছে সেই ছেলেগুলো। কনককে দেখেই বলে উঠলো, "চললো, শূণ্য পাওয়া দলের ক্যানটিনে বেগার দিতে।" কথাটা কানে আসতেই কনক থমকে দাঁড়ায়। সূর্যের গোধূলি রঙ তার মুখে এসে পড়েছে। বাদুড়ের দল সন্ধ্যার আগে আস্তানায় ফিরে যাচ্ছে। শুধু এই ছেলেগুলোর ঘরে ফেরার তাড়া নেই। মনে পড়ে যায় কমলাদির কথা। কিভাবে ঠাণ্ডা মাথায় কাজটা শেষ করতে হয়, কমলাদিকে দেখে সে কিছুটা শিখেছে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে এগিয়ে যায় ক্যানটিনের দিকে। ছেলেগুলো হো হো করে হেসে ওঠে। ওদের ক্যাপটেন গোছের একটা ছেলে অন্য একজনের পিঠ চাপড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, "চ'। এবার ক্লাবে যাই।" ওরা উঠে ঢুকে যায় ক্লাবের মধ্যে।
এই ক্লাবগুলো ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে সরকারি অনুদানে। কিছু ছেলের করে খাওয়ার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ক্লাবগুলো। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত চলে ক্যারাম খেলা। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত শুরু হলে চলে জুয়ার ঠেক। বোর্ড পিছু কমিশন কেটে নেয় ক্লাব। তার হিসেব রাখে ক্লবের মাতব্বরদের বিশ্বস্ত একটি ছেলে। ছয়কে নয় আর নয়কে ছয় করতে সে ওস্তাদ। আর একটি ছেলে মদ আর চাটের যোগান দেয়। বেশ ঝাল ঝাল মুরগির মাংসের ছাঁট দিয়ে চাট বানিয়ে আনে বাড়ি থেকে। তার লাভের অংশ থেকে কিছুটা ক্লাবকে দিতে হয়। এরপর আছে বছরে একবার দুর্গাপূজার অনুদান। সব মিলিয়ে মোটা টাকার একটা তহবিল গড়ে ওঠে। সেই টাকায় বছরে একটা ফিস্ট। পাড়ার সব্বাইকে নেমন্তন্ন করা হয় সেদিন। বিয়ে বাড়ির মত ভোজ। কোন উপহারের দেবার বালাই নেই। এছাড়া পাড়ার কারোর ছেলে বা মেয়ের বিয়ে লাগলে বাজারের চেয়ে অর্ধেক ভাড়ায় ক্লাবের বাড়িটা সেই পরিবারকে দেওয়া হয়। কৃতার্থ হয়ে যায় তারা। গর্ব করে তা বলে বেড়ায় অন্য পাড়ার লোকদের। সবাই খুশি। দূর দূর থেকে লোকে গাড়ি চালিয়ে খেলতে আসে এখানে। যে ছেলেটি চাটের ব্যবসা করত, ইদানিং বনছিল না বোধ হয় ক্লাবের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে। তাই কায়দা করে পুলিশ রেড করিয়ে ধরিয়ে দেওয়া হ'লো তাকে। সে জায়গায় এল মাতব্বরের অতি ঘনিষ্ঠ একটি ছেলে। ক্লাবের তহবিল মোটা হতে থাকে। সেই টাকা আরামে নাড়াচাড়া করতে পারে মাতব্বর। বিভিন্ন ব্যবসায় কাজে লাগাতে পারে। বলার কেউ নেই। সারাবছর জুয়ার ঠেক চালিয়ে যে আয় হয়, সেই টাকা, দুর্গাপুজোর জন্য পাওয়া সরকারি অনুদান ও জনসাধারণের দেওয়া চাঁদা সব মিলিয়ে বেশ জাঁক করে পুজো হয়। লক্ষাধিক টাকার থিম পুজো। ভিড় উপচে পড়ে প্যাণ্ডেলে। থানার অন্তর্গত যতগুলো বারোয়ারী পুজো হয় পরিদর্শনে বার হন সরকারি উদ্যোগে গঠিত বিচারক মণ্ডলী। বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করা হয় পুজোগুলোকে। পুজোকমিটিগুলোও মাইকে বারবার সগর্বে ঘোষণা করতে থাকে নিজেদের কৃতিত্বের কথা। সারাবছরের বে-আইনী কার্যকলাপের উপর সরকারি শিলমোহর মেরে দেওয়া হয় এইভাবে। হতচ্ছাড়াগুলো এইভাবে মেতে থাকুক সারাবছর এটাই বোধহয় প্রশাসন চায়। তবু মায়েদের সদা আতঙ্কে আধাজাগরণে রাত কাটে। মাতাল জুয়াড়িদের হঠাৎ হঠাৎ চিৎকারে খান খান হয়ে যায় মাঝরাতের নিস্তব্ধতা। নোংরা খিস্তি খেউড়ে কান পাতা দায় হয়। ঘুমন্ত বাচ্ছা ধড়মড়িয়ে উঠে মাকে জাপ্টে ধরে বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞাসা করে,"কী হয়েছে,মা? কারা অমন করে চেঁচাচ্ছে? আমার ভয় করছে।" মা কোলের বাচ্ছাকে জড়িয়ে ধরে পিঠে আলতো করে চাপড় মারতে বলে, "ও কিছু নয় বাবা। ভয় কিসের? আমি তো রয়েছি। আমি গান গাইছি। তুই ঘুমা।" মা গান ধরে,
"ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে,
সব ধান লুটে নিয়ে গেলো
খাজনা দেব কিসে?"
গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে বাচ্ছাটা। মাও তার পাশে শুয়ে প'ড়ে ভাবে, সাময়িক সুখের জন্য তাদের কর্তারা কী ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ রেখে যাচ্ছে বাচ্ছাগুলোর জন্যে। নাঃ। কাল সকালেই কথাটা পাড়তে হবে। বেশি দিন এটা চলতে দেওয়া যায়না।
কনকের বাড়ির সামনের রাস্তার উলটো দিকে একটা মুদিরদোকান আছে। রাতে বন্ধ থাকে দোকান। কিন্তু তার সামনের রোয়াকে বসে কোন হেরে যাওয়া মাতাল জুয়াড়ি গিন্নির ভয়ে ঘরে ফেরে না। সারা রাত ধরে তার খিস্তি, বিলাপ শুনতে হয় তাকে। পরের দিন সকালে লোকে দেখে, কয়েকটা চালকহীন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে পাড়ার মুখের গুমটির পাশের মাঠে। জুয়াড়িরা টাকার অভাবে গাড়ি বন্ধক রেখে চলে গেছে। সকালে টাকা এনে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। এটাও মাতব্বরের আর একটা ব্যবসা। টাকার কুমীর হচ্ছে ওরা। মরছে হতভাগাগুলো। নেশায়, অনিদ্রায় মনের দিক থেকে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছে ক্রমশ।
কনক যখন ক্যানটিনে পৌঁছালো, তাকে দেখে গজেনদা বলে,"এই তো কনক এসে গেছে। আজ আর তোমাকে আনাজ কুটতে হবে না। এখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চলে যাও। ভ্যাকসিনটা নিয়ে এসো দেখি। আসার সময় দেখে এসেছি, একদম ভীড় নেই। আধার কার্ড সঙ্গে আছে তো?"
---"হ্যাঁ।"
---"বেশ। তবে চলে যাও।" কনক দাঁড়ায় না। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হাঁটা দেয়।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গেটে যে ছেলেটি থাকে, তার হাতে আধার কার্ডটা দিয়ে কনক বললো, "নাম লিখুন। ভ্যাকসিন নেবো। ফাস্ট ডোজ।"
নাম আর ফোন নাম্বার লিখতে গিয়েও কি ভেবে থেমে যায়। পকেট থেকে একটা লিস্ট বার ক্করে কনকের নামটা আছে দেখে বলে,"আপনাকে ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে না"
---"কেন?" কনক শুধায়।
ছেলেটি বলে ওপরতলার হুকুম। কনক বলে ওঠে,"নিকুচি করেছে
ওপরতলার হুকুমের। কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে টিভিতে রেডিওতে "ভ্যাকসিন নিন ভ্যাকসিন নিন" করে। আর উনি ওপরতলার হুকুম দেখাচ্ছেন। বলতে বলতে তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায় ডাক্তারদিদিমণির কাছে। বলে, "দিদি, আমার টিকা হবে নাই কেনে?"
ডাক্তারদিদি কি আর বলবে। "আমাদের হাতপা বাঁধা রে কনক। আমরা তোমাকে টিকা দিতে পারবো না।" মাথা হেঁট করে শুধু এই কথাগুলো বলে। কনক আর দাঁড়ায় না। ফিরে আসে ক্যানটিনে।
কনককে দেখে কমলাদি বলে, "কি গো? এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?"
---"ওরা আমাদের টিকা দেবেনা গো কমলাদি। ফিরায়ে দিল।" কমলা দত্ত হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালো। পাঁচটা এখনও বাজে নি। এস.ডি ও সাহেব এখনও চেম্বার ছেড়ে যান নি। কি ভেবেছে ওরা? যা খুশি তাই করবে! নিজের স্কুটারটাতে স্টার্ট দিয়ে কনককে বলল, "পিছনে উঠে বোসো।" বলে গেল, "গজেনদাকে বলে দিও আমরা এস.ডি.ও র সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।"
এস.ডি ও সাহেব নতুন এসেছেন। বয়সে তরুন। ঘুরে ঘুরে নিজের এলাকার সব খবর নিচ্ছেন। গজেনবাবু ও কমলা দত্ত যে অনেক পরিশ্রম করে প্রায় একবছরের উপর শ্রমজীবী ক্যানটিন চালাচ্ছেন সম্পূর্ণ বেসরকারি চেষ্টায়। এই প্রচেষ্টা মুগ্ধ করেছে তাজে। যখন শুনিলেন, কমলা দত্ত দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছেন। বিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিতে বললেন।
---"আসতে পারি?" কমলা দত্ত কনককে সঙ্গে নিয়ে দরজা ঠেলে দাঁড়ায়।
---"আসুন, ম্যাডান। কোন সমস্যা?"
কমলা বলেন, "ছোট্ট একটা সমস্যা। কিন্তু পলিসির দিক থেকে গুরুতর। নইলে আপনাকে বিরক্ত করতে আসতাম না।"
---"বলুন, সমস্যাটি কি?"
আগে জানতে চাই, এমন কোন নির্দেশ আপনার অফিস থেকে লিখিতভাবে দিয়েছেন কি যেখানে বলা আছে শ্রমজীবী ক্যানটিনে যারা শ্রম দেন তাঁদের ভ্যকসিন দেওয়া হবে না।".তরুন অফিসারটি এবার হেসে ফেলেন। বলুন তো, কোন বে-আইনী নির্দেশ লিখিত আকারে কেউ দিতে পারে?
---"স্বাস্থ্যভবন থেকে?" কমলা আরও নিশ্চিত হবার জন্য বলে।
---"এলে আমি জানবো না?" অফিসার প্রশ্ন করেন।
কমলা এবার উত্তরে বলে, আপনার অজান্তে কেউ এমন নির্দেশ
দেন নি তো?"
এবার বিস্মিত হন অফিসার। বলেন, কী বলছেন আপনি?"
কমলা কনককে দেখিয়ে বলে, ইনি আমাদের শ্রমজীবী ক্যানটিনে কাজ করেন। এনার স্বামী বোম্বে থেকে কাজ খুইয়ে দত্তপুকুরে ফিরে এসেছেন। কনক আর তার স্বামী ক্যানটিনে দুবেলা কাজকর্ম করে দেয়। বিনিময়ে ওর পরিবার দুবেলা খেতে পায়। ইনি গতকাল হেলথসেনটারে গিয়েছিলেন টিকা নিতে। ওনাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় শ্রমজীবী ক্যানটিনে কাজ করেন ব'লে। বলা হয় ওপরতলার হুকুম আছে এঁদের টিকা না দিতে।"
---"তাই?" এস ডি.ও সাহেব ফোন করেন হেলথসেন্টারের ভারপ্রাপ্ত ডাক্তার ডঃ মিত্রকে। ওপার থেকে সাড়া পেতেই উনি বললেন, "আমি এস.ডি.ও বলছি। নমস্কার। আচ্ছা ডঃ মিত্র, আপনার কাছে কি এমন কোন অর্ডার আছে যাতে বলা আছে শ্রমজীবী ক্যানটিনে কাজ করলে টিকা তাকে দেওয়া যাবে না?"
---"না স্য্যার। তেমন কোন অর্ডার নেই।"
---"ভ্যাকসিন নিতে কি কি ডকুমেন্ট লাগে?"
---"স্যার, এক আধার কার্ড দুই টেলিফোন নাম্বার।
---"আধারকার্ডে পেশা লেখা থাকে না। টেলিফোনও কিছু জানায় না। কি করে বুঝলেন মহিলা শ্রমজীবী ক্যানটিনে কাজ করেন?"
---"এম.এল.এ. মিস্টার শাপুই একটা লিস্ট দিয়ে নিষেধ করেছিলেন কোনমতেই যেন এঁদের ভ্যাকসিন দেওয়া না হয়।"
---"লিস্টের নিচে বা উপরে ঐ নির্দেশ এম.এল.এ সাহেবকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন?"
---"না স্যার।" ডঃ মিত্র নার্ভাস হয়ে পড়ে।
---"কাগজটা তো স্রেফ একটা নামের তালিকা। নির্দেশের কথা বেমালুম উনি অস্বীকার করবেন। তখন? ওরা কোর্টে গেলে চাকরিটা বাঁচাতে পারবেন তো?"
---"তা হলে কি হবে স্যার?" ডঃ মিত্রের গলায় আস্থার অভাব।
তরুন অফিসার ভরসা দিয়ে বলেন, "আপাতত লিস্টটা নিজের কাছে রাখুন। কাল আমি হেলথসেন্টারে যাবো। ওটা নিয়ে আসবো।"
পরদিন হৈ হৈ পড়ে যায় গোটা দত্তপুকুরে। এস.ডি.ও.সাহেব নিজে এসে এম.এল.এ.সাহেবের দেওয়া লিস্টটা নিয়ে গেছেন শুনে খোদ এম.এল.এ. সাহেব সদলবলে হাজির। হুমকি দিয়ে গেছে, দেখে নেবে মহকুমা শাসককে। বাছাধনকে নর্থ বেঙ্গলে বদলি করিয়ে তবে ক্ষান্ত হবে সে। তবে তার নাম মদন শাপুই।
পরের দিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে টিকে নিয়ে গেছে কনক
উপস্থিত সবাই কনককে দেখছে। কেউ কেউ চিনিয়ে দিচ্ছে কনককে। শতখানেক লোক এসেছে রাতের খাবার খেতে। কনক কোমরে আঁচল জড়িয়ে পরিবেশন করছে। কপালের ঘামে লেপটে গেছে সামনের কয়েকটা চুল। পরেশও আছে। সেও বালতিতে এঁটো পাতা গুড়িয়ে তুলছে ডাস্টবিনে ফেলে আসবে বলে। রাতে বেশি কিছু হয় না। খিচুড়ি আর একটা পাঁচমিশালি সব্জির লাবড়া।
প্রথম পংক্তির খাওয়া হয়ে গেছে। দ্বিতীয় পংক্তি প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় মদন শাপুই তার দলবল নিয়ে জিপ থেকে সদর্পে নামলো। সঙ্গে আছে গোটা কুড়ি ছেলে। প্রত্যেকের হাতে হকি স্টিক নয়তো লোহার রড। মদন হুকুম করে, "উলটে দে ওদের হাঁড়ি। ভেঙ্গে দে উনুন। চুলোয় যাক শ্রমজীবী ক্যানটিন।" ছেলেরা তৎপর হয়ে ওঠে তাণ্ডব চালাতে। ক্যানটিনে খাওয়া সেরে বাড়ি যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায় বেকার শ্রমিকরা। কেউ হাতে তুলে নেয় উনুন থেকে জ্বলন্ত চেলা কাঠ, কেউ ডাবু ভর্তি গরম খিচুড়ি, কেউ বা জড়ো করা বাঁশ জ্বালানি কাঠ। একটা যুদ্ধং দেহি অবস্থা।
এমন সময় দূর থেকে রাস্তার ধারের গাছে গাছে হেডলাইটের আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসছে একটা গাড়ি। মাথায় জ্বলছে সাইরেনের শব্দের সঙ্গে নীল বাতি। মদন হাত দেখিয়ে ছেলেদের থামায়। কাছে আসতে নাম্বার দেখে চিনতে পারে এস.ডি.ও সাহেবের গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে মদন শাপুইকে দেখে বলে ওঠেন, "কি ব্যাপার এম.এল.এ.সাহেব? এত রাতে?"
মদন শাপুই হেসে বলে, "দেখতে এলাম গজেন বাবুদের শ্রমজীবী ক্যানটিন কেমন চলছে? আমার বিধানসভার মধ্যে এটা পড়ে কি না।"
---"বাঃ। খুব ভালো। দেখুন গজেনবাবুদের কোন উপকারে আসতে পারেন কিনা। এই যে ছোকরারা, রাত হয়েছে বাড়ি যাও তোমরা। এদের নিশ্চিন্তে খেতে দাও।" এস.ডি.ও.সাহেব প্রায় ধমকের সুরে বলেন। মদন শাপুইয়ের ইসারায় তারা একে একে কেটে পড়ে। মদনকে অগত্যা চলে যেতে হয়।
গজেন ও কমলা এগিয়ে আসে অভ্যর্থনা জানাতে। গজেন বলে, "ওঃ। আপনি ঠিক সময়ে না এলে কি যে হ'তো। অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার।"
---"না না। এটা আমার ডিউটি। হেলথসেন্টারে গিয়ে যখন শুনলাম, মদন শাপুই খুব তড়পে গেছে, তখনই মনে হ'লো আজ এখানে একটা হামলা না করে ছাড়বে না শাপুই মশাই। তাছাড়া ওবেলা নেমন্তন্ন করে এসে ছিলেন। ভাবলাম, যাই দেখে আসি একবার। রথ দেখা কলা বেচা দুইই হ'বে। গজেনবাবু, কমলাদেবী একটু সাবধানে থাকবেন। চলি।" এস.ডি.ও.সাহেব চলে গেলেন।
বাকিরা যারা অর্ধেক খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়েছিল গজেনদা তাদের আবার বসিয়ে দিল খেতে। কমলা তখন মিত্তিরখুড়োদের জন্য খাবার বাঁধাছাদা করে নিচ্ছে, তার সঙ্গে নিজের দুটো বাচ্ছার খাবারও। কমলাদি তখন টেলিফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। কথা শেষে একটি ছেলেকে ডেকে বললো, "এই যে ভাই, পল্টু। তোমার বাড়ি যেতে তো ডঃ বিজন বসুর বাড়ি পড়ে?"
---"হ্যাঁ। কেন দিদিমণি?" পল্টু বলে।
---"ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে ওনার ডোনেশানটা এনে দেবে। কথাবার্তা বলা আছে। উনি তোমার জন্য অপেক্ষা করেছেন। এই রসিদটা নিয়ে একবার যাবে?"
পল্টু দেখে, বন্ধু বেলটে তখন সাইকেলে উঠবো উঠবো করছে। বলে ওঠে, "এই বেলটে,তোর সাইকেলটা একবার দে তো।" কমলাদির কাছ থেকে রসিদটা নিয়ে সাইকেলটা নিয়ে চলে গেল। একটু পরেই টাকাটা এনে দেয় কমলাদির হাতে। বলে,
---"কমলাদি এবার চলি?"
---"এসো। সাবধানে যেও।"
কনকের বাঁধাছাঁদা শেষ। বলে, "কমলাদি আসছি গো।"
---"একটু দাঁড়িয়ে যাও। তোমার একটা জিনিষ এসেছে আমাদের কাছে।"
একটা পার্সেল তুলে দেয় কনকের হাতে। "একেবারে বাড়ি গিয়ে খুলো।"
---"কি আছে গো এতে?" কনক জিজ্ঞাসা করে।
কমলাদি হেসে বলে, "আমি কি করে বলবো, বলো। বাড়ি গিয়ে খুলে দেখো। কাল এসে বোলো। তখন শুনবো।"
---"নিশ্চয়ই বলবো। আসি।" কনক বিদায় নেয়।
কনক হাতে প্যাকেটটা নিয়ে হাঁটতে থাকে। পরেশকে বলে, "হ্যাঁগো, এতে কি আছে বলো তো? কে পাঠালো এই প্যাকেট?"
পরেশ বলে ওঠে, "দ্যাখ, কোনো বড়লোকের খেয়াল। পা চালিয়ে চল। বাচ্ছাগুলো কী করছে কে জানে!" কনক বকুনি খেয়ে জোরে পা চালিয়ে স্বামীর পাশে পাশে হাঁটতে থাকে।
কমলাদির কাছে যখনই জেনেছে, তার বুড়ো বাবামার নিত্য খাবার পৌঁছে দিচ্ছে, জামাকাপড় কেচে দিচ্ছে,চান করাচ্ছে আর কেউ নয় সেই কনকমাসি যে রোজ ভুলে যাওয়া টিফিন বাক্সটা ছুটে এসে বাসে ওঠার আগে পৌঁছে দিত, তখনই তার মনটা শৈশবে ফিরে যেত। একটা মিষ্টি হাসি তার ঠোঁটে খেলে যেতো তখন। প্রবাসে থাকলেও দুর্গাপূজা আসছে টের পায়। তখনই কনকমাসির জন্য কিছু একটা করতে মন চাইছিল। কমলাদির সঙ্গে কথা বলে উপহারটা পাঠায়। ভাবতে ভাবতে পথ চলার জন্য কনকের গতি ধীর হয়ে আসে। পরেশ তাড়া লাগায়। বলে, "একটু জোরে পা চালা না। বাচ্ছা দুটো ঘরে কি করছে কে জানে!"
কনক জোরে পা চালিয়ে পরেশের পাশে পাশে হাঁটতে থাকে।
---"এই প্যাকেটটাতে কি আছে বলো তো? কেই বা পাঠালো?"
---"কি জানি। বড় লোকের খেয়াল। দ্যাখ, পুজোয় বকসিস পাঠিয়েছে বোধ হয়।"
কনকরা বাড়ি পৌঁছে দেখে বাচ্ছারা জেগে আছে। পড়াশোনা করছে। কনক দুটো সানকি এনে ক্যানটিন থেকে আনা খাবার দুজনকে ভাগ করে দেয়। তারাও হাত ধুয়ে খেতে বসে যায়।
---"ঐ প্যাকেটে কি আছে মা?" ছোটটি বলে ওঠে।
---"খেয়ে নে আগে। তারপর দেখাবো।" ওদের খাওয়া দাওয়া শেষ হোলো। বাচ্ছাদুটো কনকের দুপাশে এসে বসে। বলে,
---"দেখাও না মা কি আছে প্যাকেটে।" কনকদের কৌতুহল আর বাধ মানে না। পরেশকে বলে,"খুলে দেখোনা কি আছে।"
পরেশ প্যাকেটটা খুলে অবাক হয়ে যায়। মহিলার জন্য শায়া, শাড়ি,ব্লাউজ, পুরুষের জন্য ধুতি পাঞ্জাবি আর বাচ্ছাদের জন্য দু সেট জামা-কাপড়। মিনু এত খরচ করেছে তাদের জন্য!
মিনুকে তারা ছোট্ট বেলায় দেখেছে বেনী দুলিয়ে স্কুলবাসে স্কুল যেতে। সে রোজ টিফিন বাক্সটা ব্যাগে ভরতে ভুলে যেত, আর কনক ছুটে বাসের দরজায় গিয়ে তার হাতে বাক্সটা দিয়ে দিত। সেই অতটুকু মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে আজ। কনকমাসিকে তবু সে ভোলে নি।
নতুন জামাকাপড় পেয়ে আনন্দ ধরে না বাচ্ছাদের।
তাদের এত শ্রম বিফলে যায়নি। মা দুর্গা মুখ তুলে চেয়েছেন। অদৃশ্য দেবীর উদ্দেশ্যে দু-হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করে কনক। উঠানের শিউলি গাছে সবে ফুল ফুটতে শুরু করেছে। একটা মৃদু সুবাস ভেসে আসছে, সে টের পায়।
পরেশ থাকতে পারে নি। গজেনদাকে একদিন জিজ্ঞাসাই করে ফেললো, "এত মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছো তোমরা, তবু ভোটের বাক্সে তোমরা শূণ্য কেন গো?"
---"তোরা ভোট দিস নি ব'লে।"
---"কি বলছো গো? মোরা ভোট দিই নাই তোদের?"
গজেন হেসে ফেলে। বলে, "তোরা দিয়েছিস বটে, কিন্তু তোদের মত অনেকে ভোট দেয়নি আমাদের।" কেন তারা ভোট দেয়নি গজেনদাদের, তার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। কি ক'রে ঢুকবে তার মাথায়। কাজ নেই মানুষের হাতে। তবু মানুষ ভোর থেকে লাইন দিচ্ছে ভোর থেকে। কখনও স্বাস্থ্যশ্রী কার্ড, কখনও
লক্ষ্মী ভাণ্ডারের জন্য নাম নথীভুক্ত করার জন্য। চিকিৎসার খরচ মিলবে স্বাস্থ্যশ্রী কার্ডে, গৃহবধুদের একাউণ্টে পাঁচশো করে টাকা ঢুকবে প্রতিমাসে এই আশায়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। মানুষ তো খড়কুটো ধরে বাঁচতে চাইবে। ভোট তো ওরা পাবেই। গজেনদাদের আর কতটুকু ক্ষমতা!
---"জানো পরেশ, মানুষ যদি কাজ পেত, তাহলে তাদের মা-বৌদের পাঁচশো টাকার জন্য এমন করে লাইনে দাঁড়াতে হ'তো না।" গজেনদা বলে চলে, "নগদ পাওয়ার লোভ কেই বা ছাড়তে পারে,বল?"
পূজো এসে গেল। বিধি মেনে পুজো হবে বলা হচ্ছে বটে। কিন্তু মানবে ক'জন? মানুষের ঢল নামলে প্রশাসন কতটা সক্রিয় হতে পারবে, সন্দেহ আছে। কমলাদি বলে দিয়েছে, ভিড় এড়িয়ে চলতে। সকালে দাওয়ায় বসে পরিবারের সবাই দাওয়ায় বসে মুড়ি বাতাসা দিয়ে
টিফিন করছে। এমন সময় একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায় তাদের ঘরের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসে একটি মেয়ে।
---"কনকদি?"
---"হ্যাঁ।"
---"আমার বাবা-মার কাছে এত প্রশংসা শুনেছি যে চিনতে এতটুকু কষ্ট হয়নি।" তারপর মুচকি হেসে বলে, "আমি কে ব'লো তো?"
---"তুমি, দিল্লির মিনুদিদিমণি না?" কনক বলে ওঠে।
---"ঠিক ধরেছো।" এগিয়ে এসে কনেকের হাত ধরে। ব্যাগ থেকে একটা টিফিন বাক্স বা'র করে। বলে, "এটা চিনতে পারছ।"
---"চিনবো না আবার?" কনকের মুখে লাজুক হাসি। মিনু বলে ওঠে,"এইটা ছুটে গিয়ে আমার হাতে দিয়ে আসবে না?"
দু-জনে অতীতের কথা মনে পড়তেই খিলখিল করে হেসে উঠে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। পরেশ দেখে, দুজনেরই চোখ ছলছল করছে, গলাটাও কেমন আবেগে বুজে আসছে।
0 Comments

Post Comment