পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কেচ্ছা

  • 16 April, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1427 view(s)
  • লিখেছেন : শতাব্দী দাশ
হাওয়া যেদিকে থেকে বয়, সেদিকে পিঠ করে গেটের মাঝ বরাবর লোহার খুঁটি ধরে দাঁড়ায় ঝিল্লি। সক্কালবেলার ক্যানিংমুখী লোকাল বিলকুল ফাঁকা। দরজায় বসা মেছুনিরা ঠোঁট বাঁকায়, গা টেপাটেপি করে তাকে দেখে। ঝিল্লি পাত্তা দেয় না। ব্লাউজের ফাঁক গলে পিঠ বেয়ে ঝিরঝির বাতাস ঢোকে, মাইরি! কখনও এমন ঝামড়ে পড়ে হাওয়া যে, চুলগুলো সামনে উড়ে এসে মুখ ঢেকে দেয়। বড় মেছুনি কয়, 'চুল বেঁধে নে না মাগী।'

 

 

শাঁ শাঁ হাওয়ায় তার কথা কেটে যায়। শুনেও শোনে না ঝিল্লি। কিলবিলে লোহার কেন্নোর পেটে এমন আকুল-বিকুল হাওয়া দেয়, কে জানত! কাজ ধরার আগে অবধি সে ট্রেনে চড়েছে কম। এই ধরো, বচ্ছরকার দিনে ঠাকুর দেখতে। তারপর ধরো, বে-র পর শউরবাড়ি যাওয়ার সময় একবার। আর ফি বছর একবার সোনারপুর বাপের বাড়ি আসার সময়। বাপের না, সে মায়ের ভাড়ার বাসা। সেসব দিনে সুধাকরও সঙ্গে ছিল। জড়োসড়ো পুঁটুলি বউ ঝিল্লির সাধ্য কি ঘোমটা সরিয়ে হাওয়া খায়!

 

এখন নাইট ডিউটির পর উল্টোবাগের ট্রেন। প্রতিদিন। সিট ফাঁকা। তবু দরজার ধারে ঝুলে যেতে মন করে। ওই ভঙ্গিতে রোখ আছে। সার্কাসের মেয়েদের মতো হাওয়ায় দোলে সে এক হাতের বেড়ে রড জড়িয়ে। পাখির মতো হালকা লাগে। আর ওই যে ছেলেটার চোখ মটকানি স্টেশনে স্টেশনে — বসন্ত হাওয়ার মতো শিরশিরে তাও।

 

যাদবপুর। একটা ন্যাতাকানি শাড়ি ছুটে এসে ক্ষিপ্র গতিতে শুকনো কাঠকুটোর বস্তা ঝুলিয়ে দিল জানলা থেকে আংটা বরাবর। ঠং শব্দে ঝিল্লির চিন্তা ছিঁড়ে গেল। জানালার পাশে বসেছিল যারা, নাইট ডিউটি ফেরতা নার্স, খোঁচা খাওয়ার ভয়ে ছিটকে সরে গেছে। এ লাইনে এসব মাস্তানি বিন্দাস চলে। বেপরোয়া ও নির্মম  এ লেডিজ কামরা। পা মাড়িয়ে যায়। কান গরম করা খিস্তি ছোটে। হাতাহাতিও লেগে যায় অবরে সবরে। এত সশব্দ নারীজগৎ ঝিল্লি আগে দেখেনি কোথাও। এরা শউরবাড়িতেও এমনতরো? শউরবাড়িতে ঝিল্লি রা কাড়ে না এখনও। সবজিউলি মুমতাজকে প্রশ্ন করায় সেদিন বলল, 'ক্ষেপিছ? ওখানে রা কাড়তি পারে না বলিই টেরেনে তড়পায়।'

 

বিশেষত যে মেয়ে-বউদের গায়ে সুখী বড়লোকি গন্ধ ভিনভিন করে, তাদের রেয়াত নেই লেডিজে। প্রথম প্রথম ঝিল্লি অবাক মানত। চার অক্ষর শুনে কান চাপা দিত। এখন ঘোর লেগে গেছে। কাল এক ইস্কুলের মেয়ের পা মাড়িয়ে দিল সে-ও। বেটি দরজায় ঝুলন্ত ঝিল্লিকে ঠেলে ট্রেনে উঠতে হাঁকপাক করছিল। কচি পা-টা দেবড়ে দিতেই 'ও বাবাগো' চিল্লালো। শুনে আমোদ হল। ঝিল্লিও যেতে চেয়েছিল ইস্কুলে। আট ক্লাস পাশের সার্টিফিকেট তার তোলা হয়নি। দরকার পড়েনি কারও। আপাতত হাওয়া তাকে উথালপাথাল করে। হাওয়া রসকষ মেরে পাথুরেও করে। ভাগ্যিস সুধাকর কাছ ঘেঁষে না আজকাল। নইলে এ মায়াহীন ঝিল্লির আঁচ সে-ও পেত। পায় না কি একেবারেই?

 

আজকাল সুধাকর বারান্দায় বসে খক খক কাশে দিনভর। ঘেন্না করে। যদিও তা ঝিল্লি মুখে বলে না। মাস্ক পরে জল দিয়ে আসে। বলে, 'ছাওয়ালটারে না রোগে ধরে… মাস্ক পরো বলতেছি! তোমারই ছাওয়াল তো, নাকি?' মণিকে  সে সত্যি চোখে চোখে রাখে। বিকেলে বেরোনোর আগে কপালে চুমো দিয়ে দিব্যি গেলে বলে যায়, 'মায়ের মাথা খা, বাপের কাছ ঘেঁষবিনি বলতেছি।'

 

ডাক্তার বলেছে, গেল দুই বার টিবির চিকিচ্ছে পুরো করার আগেই ভেগেছিল যেহেতু, এবার তাই সুধাকরের রোগ আরও জোরালো হয়েছে। আশা কম। সুধাকর এমনই গোঁয়ার। বিনিপয়সার ওষুধ, তবু অরুচি। প্রথমবার দশ দিন ওষুধ খেয়ে কাশি কমলে, শাউড়ি জল পড়া এনে দিল। সর্বরোগহর জল খেয়ে রোগ নাকি নাশ হল এমন, পরদিন থেকে ওষুধপালা বন্ধ এক্কেরে। দ্বিতীয়বার ডাক্তার তাই পাঠালো যাদবপুরের টিবি হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি নিল — পাছে বাড়ি গেলে ফের মাঝপথে ওষুধ বন্ধ হয়! একা সুধাকর তো ওয়ার্ডে বন্দি নয়, ঝিল্লিও দিনরাত ওয়েটিং রুমে পড়ে থাকত। চেষ্টা সে কম করেনি! অথচ শাউড়ি বলল, 'মাগী ডাক্তার ধরে কী বিষ খাওয়াচ্ছে ছাওয়ালটারে, কে জানে!'

 

পনের দিনের মাথায় অতএব আবার পালাল রুগী। পুরুষ মানুষকে প্রশ্ন করা মানা। তবু ফেরার রুগীকে খুঁজে হাল্লাক হল ঝিল্লি। সুধাকরকে বাঁচতেই হবে। না তো কি আজীবন থান পরে কাটাবে ঝিল্লি? সাজতে সে ভালোবাসে। কুমকুম টিপে তার মতো নক্সা আর কে বা তুলতে পারে?

 

চুল্লুর ঠেকে তাকে খুঁজে পাওয়া গেল শেষমেষ। ঝিল্লি হাউমাউ কেঁদে হাসপাতালে ফিরে যেতে বলেছিল। সুধাকর এক লাথ মেরেছিল বুকে। এখন বোঝ্ ঠ্যালা! মরণের দ্বারে বসে মিনসেটা খক্ খক্ কাশে। মায়া হয় না, আবার হয়ও। এখন ঝিল্লি চোখে ব্লু হেভেন কাজল টেনে কাজে বেরোয়। বর মরলে সাজবে কী করে, এমন অদ্ভুত কথা দু বছর আগে ভেবেছিল বলে হাসি পায়। কিন্তু মরার আগে রোগের ভাগ ছেলে-বউকে দিয়ে যাওয়া কেন বাপু? ঢেমনি বুড়ি মাকে দিয়ে যা না! শাউড়িকে মনে মনে নতুন শেখা কিছু গাল দেয় ঝিল্লি।

 

 

*******

 

লেডিজ কামরা সয়ে গেলে মজা আছে। সুখ দুঃখের গপ্প করে ওরা। চিল্লিয়ে গান গায় সমস্বরে। সিটের উপর এক পা তুলে বসে জুত করে স্যাঙাতের নখে রঙ লাগিয়ে দেয় কেউ। মায় মাথার উকুনও বেছে দেয়। ঝিল্লি অবশ্য এখনই বসবে না সিটে। এই এক নেশা নেশা হাওয়া, আর ওই ছেলে—  ওকে ঠায় দাঁড় করিয়ে রাখে দরজায়। যাদবপুর স্টেশনে নেমেছে ছেলেটা। কোথায় বাড়ি ওর? বালিগঞ্জে এসেছিল পিছু পিছু। এই নিয়ে চারদিন। কখনও যাদবপুরে নেমে দেখা দিয়ে যায়। কখনও বাঘাযতীন বা গড়িয়ায়। তলপেটেরও নিচে শিরশির টের পেয়েছে ঝিল্লি। সরস্বতী পুজোর দিন ছেলেরা পিছু নিলে যেমন হত! অথচ একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখ দেখার সাহস ছিল না তখন।

 

সে'সব মাত্র দুতিন বছরের লফড়া অবিশ্যি। চোদ্দয় পড়তেই মায়ের কান ভাঙাল বাড়িউলি। 'বাড়ি বাড়ি খেটে খাও। সারাদিন সোমত্থ মেয়েদুটো একা। চলন বলন বদলাচ্ছে মেয়েদের। একে একে পার করো দিকি।' বোন জবার তখন এগারো। মাসিক শুরু হয়নি বলে ছাড় পেয়ে গেল। খুব কেঁদেছিল ঝিল্লি। মা বলল, দেখাশোনা করতে দোষ কী? একশ কথায় এক বিয়ে হয়। তদ্দিনে নাকি কম-সে-কম ষোল পার হবে। সুধাকরের যখন তাকে মনে ধরল, তখন সে পনের সবে। তবু মায়ের তর সইল না। 'বিয়ে করবি না তো কি লটঘট করবি?', মা বলেছিল।

 

'লটঘট' ধরনের শব্দ মাকে আগে বলতে শোনেনি বলে নোংরা লেগেছিল। বাপ মরা থেকে মা দুই বোন নিয়ে ভেন্ন হয়েছিল। কাজ ধরেছিল তখনই। ভেন্ন হয়েছিল, না বের করে দিয়েছিল জ্যাঠা-রা? সেই থেকে নিরামিষ, কণ্ঠি আর গোপাল সেবায় মাকে আশপাশের সব পাড়া চেনে। কাজে-যাওয়া বউদের নামে রটে কত শত কথা! তার উপর অল্পবয়সী বিধবা। দুর্নাম না রটে, মা কি কণ্ঠি ধরেছিল সেই ভয়ে? ঝিল্লি কি দুর্নামে ভয় পায়? পায়। খুবই পায়। আবার পায়ও না। না হলে কেন শ্যামতনু ও যুবকের দর্শনলোভে ঝোলে ট্রেনের দরজা থেকে?

 

সে রাতে মায়ের মুখে 'লটঘট' শুনে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সে। জবা কানে কানে বলেছিল, 'কাঁদিস কেন? জামাইবাবু খুব চটকাবে। মজা হবে।' ঠাস করে চড় লাগালেও জবার কথায় তলপেটের নিচে শিরশিরানিটা বোঝা গিয়েছিল। একই শিরশিরানি আজকাল ছেলেটাকে দেখলে আবার টের পায় হাঁসবেড়ের সুধাকরের বউ। মণির মা সেই ইস্কুলবেলার পঞ্চদশীর মতো ভয় পায়। কি এক টানে যে তবু ফিরে ফিরে চায়! এই যে ট্রেনটা পোঁ দিতেই ছেলেটা দৌড়ে উঠে গেল পাশের কমপার্টমেন্টে, ঝিল্লির বুক ধক করে উঠল। ঘাড় বাড়িয়ে দেখল, পড়ে গেল না তো? বড় বড় গামলায় মেছুনিদের হাত চলছিল দ্রুত। আঁশটে জলে মাছ খাবি খাচ্ছিল। ছোট মেছুনি তার উচাটন দেখে বলছিল 'মরণ।' আর তখুনি ঝিল্লি দেখে, সেই ছেলেটা আবার নেমেছে।  গরগরে লাল কৃষ্ণচূড়া গাছে ছাওয়া এক ইস্টিশনে। ছেলেটা তাকে ইশারায় ডাকে। ঝিল্লির তলপেটের অনেক তলায় শিরশির করে। সে নেমে যায়।

 

 

*******

 

 

ধাঁ করে রদ্দাটা পড়ল ঘাড়ে তখনই, যখন সবে কুয়োতলায় নুয়ে পা ধুচ্ছে ঝিল্লি। কৃষ্ণচূড়া রাঙা ইস্টিশনে নামার ঠিক দশ দিন পর। রদ্দার চোটে হাতের মুঠি খুলে বুড়ির চুলের প্যাকেট পড়ে গেল। ও রদ্দা ঝিল্লির চেনা। সুস্থ থাকতে কিল, চড়, রদ্দা — সবই চালাত সুধাকর। এখন রুগ্ন শরীর দেখে বোঝার উপায় নেই, প্রহার ও রতির সময় সুধাকরের গায়ে অযুত হাতির জোর ভর করত। কতবার যে হাতে মোচড়! কাঁকালে লাথি অগুনতি। নেহাতই রাজরোগ পুংধর্ম-কে থমকে রেখেছে। তা বলে কি আনাচার সয়?

 

চুলের মুঠিতে টান পড়ে। মাটিতে ঘষটাচ্ছে ঝিল্লি। সিন্থেটিক শাড়ি ধুলোয় মাখামাখি। দাওয়া থেকে চিৎকার করে কেঁদে উঠল মণি। মা মার খেলে যেমন প্রায়শই কেঁদে ওঠে। ঘষটাতে ঘষটাতে মনে পড়ে, কাঁদলে কী হবে, মণিও আজকাল ছোট ছোট হাতে চুলের মুঠি ধরে। ছোট ছোট পায়ে লাথি কষায়। নকলনবিশি বোঝা যায়।

 

সিঁড়ি নেই বলে ইঁট পাতা ধাপগুলো মাটির দাওয়ায় উঠে গেছে। ইঁটের ধাপে হাঁটু ঘষটে ছিলা উঠে গেল। 'ও বাবাগো' বলে কঁকিয়ে ওঠে ঝিল্লি, ইস্কুলের মেয়েটার মতো। দাওয়া বেয়ে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে তাকে ঘরে নিয়ে যায় সুধাকর। শাউড়ি রান্নাঘর থেকে দেখে। বেবাক। তারপর হাড় জ্বালিয়ে বলে 'তোর মরণ হোক, বেশ্যা।' ওষুধের শিশি উল্টোয়। পিকদানি ছেতরে যায়। সংক্রমণের ভয়ে ঝিল্লি আঁচলে মুখ চাপা দেওয়ার উপক্রম করতেই, আরো জোরে টান পড়ে চুলে। গোলাপি বুড়ির চুল আনমনে হাওয়ায় ওড়ে। মণি একবার সে খাদ্যকে দেখে, একবার মাকে।

 

সুস্থ থাকতে সুধাকর একশ দিনের কাজ ধরত মাঝেসাঝে। কখনও বা জোগাড়ের কাজ। বাকি সময়, সোহাগ হত খুব প্রথম প্রথম। তারপর বউয়ের হাতের রুটি শক্ত লাগল। তরকারি বিস্বাদ। সুস্থ ও স্বাভাবিক পুরুষের যেমনটা লাগে। ষোড়শী ঝিল্লি তালপাতা পাখা হাতে থিরথির কাঁপত খেতে বেড়ে।

 

বোন জবা বলল — তখন সে ঋতুমতী অতএব আরও চৌখশ — বর পটাতে বিবিয়ানি সাজ চাই। ভিকো টারমারিক। তার উপর পাউডার প্রলেপ। ডিওডেরান্টের ছোট ছিরিক বোতল কুড়ি টাকায় মেলে — সে খবরও সে দিল। এক বিকেলে ঝিল্লি গা ধুয়ে ঝুপ্পুস পাউডার মাখল সুধাকরের ফেরার সময় হলে। সুগন্ধী ছড়ালো বাহুমূলে। সুধাকর সেদিন সদ্য শুনে এসেছে, একশ দিনের কাজে মাইনে এবার ব্যাংকে ঢুকবে সরাসরি। হাতে হাতে টাকা পাওয়া যাবে না মোটেই। ব্যাংকের খাতা নাই এদিকে আদ্দেকের। এমতাবস্থায় বউয়ের সাজ দেখে তার ভ্রু সহজে কোঁচকায়।

 

পাশের পাড়ায় দিদির ঘর বলে যে জামাই প্রায়শই আসে, রঙ্গ-রসিকতা করে নতুন বউ-এর সঙ্গে, তারই নাম তুলে প্রথম ঘুষিটা মেরেছিল সুধাকর। জামাইবাবুর প্রাসঙ্গিকতা ঝিল্লি বুঝতে না বুঝতে আরও এক ঘুষি। তারপর থেকে আগল খুলে গেল। হপ্তায় একবার। বা পনের দিনে। তারও বেশি দিন মারধোর না হলে শাউড়িও উশখুশ করত। সে বেটির পিঠেও চ্যালাকাঠের দাগ, শোনা যায়। এখন তার মজা দেখার পালা।

 

ঝিল্লি ভেবে দেখেছে, সুধাকরের মরণের সম্ভাবনাটা তাকে কষ্ট দেয়নি মোটে। এই বিগতস্পৃহায় তার অসতীপনার শুরু। তৃতীয়বার যবে সে মারণ কাশি কাশতে শুরু করল, ঝিল্লি ছকে নিল কী কী করণীয়। এক, মণির সংক্রমণের দোহাই দিয়ে বিছানা আলাদা করতে হবে। দুই, রুগ্নের প্রহার-ক্ষমতা কমে এলে কাজে বেরোতে হবে। মা-কে বললে কাজ ঠিক করে দেবে না একটা?

 

সুধাকর থালাবাটি ছুড়ল যথারীতি। শাউড়ি বলল, 'ও চায় না যখন, তুমি বাড়ি থাকো। আমি কাজ ধরি।' কিন্তু ঝিল্লি হেব্বি ভাল বউ ও বৌমা তখন। কান্না গলায় খুড়শউরের সামনে দিব্যি গেলল। বর আর শাউড়ি যে না খেয়ে মরবে সে কাজে না গেলে! বুড়ি শাউড়িকে কি জোয়ান বউমা কাজে পাঠাতে পারে প্রাণে ধরে? লোকে কী বলবে?

 

খুড়শউর দেখল, এইবেলা ঘাড় না নাড়লে মৃত দাদার গুষ্টির চারজনায় তারই ঘাড়ে পড়বে। সুধাকর তবু পাড়া মাথায় করল। যেমন করছে এখন। ঝিল্লি সয়ে নিল। সয়ে নিলে, কাল থেকে মুক্তি। কাল থেকে ট্রেনের খোলা হাওয়া। যেমন এখনও সয়ে নিচ্ছে ঝিল্লি চুপচাপ।

 

কিন্তু ঘরের মেঝেতে ফেলে সুধাকর যেভাবে তার উপর চড়াও হল, সে ভঙ্গি ভাল ঠেকল না। তৃতীয়বার টিবি-তে ধরার পর সুধাকর প্রবেশ করেনি। কিছু মায়া কি ছিল বাকি? আজ কী করতে চাইছে? ঝিল্লি প্রাণপণ মুখখানা ঘুরিয়ে রাখে সুধাকরের মুখের থেকে। হাঁকপাক করে আর বলে, 'মাস্ক পরো, মাস্ক পরো। পায়ে পড়ি। আমি মরলে মণিকে কে দেকবে?'

 

সুধাকর থমকায়। ছিটকে সরে আসে। বলে, 'ছেইড়ে দেব। বল্ আর কাজে যাবিনি!'

 

'কী বলতেছ যা তা! খাবে কী? তোমাদের জন্যই তো…'

 

'ফের মিছে কথা কইবি তো মুখ ভেঙে দেব মাগী! কার সঙ্গে লটঘট তোর, জানি নে ভেবেচিস? গেরামে মুখ পুড়েছে আমার। টিবি বলে কি হিজড়ে হয়ে গেচি? একদম বন্ধ তোর কাজে বেরুনো। এবার বেরুলি চিরতরে বেরুবি বাড়ি থেকে।'

 

'কী বলচ? কী হয়েচে শুনি?

 

নিজের ফোনটাকে উঁচিয়ে তোলে সুধাকর। হোয়াটস্যাপ খোলা। আননোন নাম্বার থেকে আসা একখান ছবি। ছাঁটের ঝোলের মতো গরগরে লাল কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ঝিল্লি। তার কোমরে সেই ছেলেটির হাতের বেড়, যার ইশারা মোহনবাঁশির মতো অমোঘ ও অসামাজিক।

 

 

 

 

******

 

 

বৌদি যে তার কথা বিশ্বাস যাচ্ছে না, তা বেশ বোঝা যায়। বিশ্বাস করার কথাও নয়। ঝিল্লি কি নিজেও জানে না যে তার কথায় যুক্তি কিছু নেই? অথচ বৌদিকে বিশ্বাস করাতেই হবে। সালিশির কথা শুনে পুকুরপাড় ধরে এক ছুটে পালিয়ে এসেছে ঝিল্লি বাসরাস্তায়। টোটো ধরে ইস্টিশন ফের। যে ট্রেন ছাড়ার উপক্রম করছিল, তাতে উঠেছে হাঁপাতে হাঁপাতে। কাজবাড়ির বৌদির ভরসায় এতটা পথ দৌড়ে ফিরেছে। কেচ্ছা নিয়ে মায়ের বাসায় গেলে ঢুকতে দিত কি? এমন কোনো বাড়ি পৃথিবীর কোনোখানে নাই, যা কেচ্ছাময়ীকে কোল পেতে দেয়। ফিরতি পথে আবার সে দরজায় ঝুলেছে। এইবার পাখির মতো হালকা লাগেনি। বরং এতটা ভারি, যেন কেন্দ্রাভিমুখী বলে তাকে 'আয় আয়' ডাকছে রেল লাইন। সে ডাক অগ্রাহ্য করে এত দূর আসা বড় সহজ ছিল না।

 

বৌদি লোক ভাল। নিজের বাড়ির ঠিকানায় ঝিল্লির পার্সেল আসতে দেয়। ঝিল্লি বৌদিকে দেখে ফ্লিপকার্ট-মিশো শিখেছে। চুমকি বসানো এক শাড়ি লুকিয়ে কিনেছে। বৌদি চোখ মটকে একবার জিজ্ঞাসা করেছে, 'ব্যাপার কী, অ্যাঁ?' উত্তর দিতে জোর করেনি। ব্যাপার কী, তা ঝিল্লি নিজেও জানে না সঠিক। জানে না, কার লাগি অঙ্গ কাঁদে? শুধু জানে, জোয়ার এসেছে। ঢেউ ভাঙছে কোথাও৷ সুধাকরের পাঁচ বছরের পুরোনো বউ-এর কুড়িতে পা দিয়ে কী যে হল!  তার তলপেটের অনেক নিচে মাঝে মাঝে শিরশির করে।

 

এখন আলুথালু ঝিল্লি ফরাসে বসে আছে। বৌদি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে সোফা থেকে।

 

'আমি কিছু জানিনে বৌদি। পেইলে এসেচি। আমার কোনো দোষ নেই মাইরি। অকারণ আমায় সন্দ করল। সালিশি সভা বসাবে নাকি। চরিত্ত খারাপ পোমান হলে নাকি ন্যাড়া করি দেবে।'

 

'ছবিতে কি তোমাকে দেখা যায়?'

 

'তেমনই মনে হল।'

 

'কে তুলল?'

 

'জানি নে।'

 

'গাঁয়ের আর কেউ, যারা কাজে যায় একই ট্রেনে, তারা করতে পারে?'

 

'পারে।'

 

'তাহলে স্বীকার করছ যে তোমার সম্পর্ক হয়েছিল?'

 

'মাক্কালির দিব্যি বলছি, আমি সীতা-সাবিত্তির মতো পবিত্ত।'

 

'দেখো, পুলিশের কাছে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু পুলিশও তো একই প্রশ্ন করবে। আর তুমি ঝেড়ে কাশবে না। উলটে পুলিস তোমাকেই খিস্তি মেরে ভাগিয়ে দেবে। তার চেয়ে পালিয়ে এসেছ, বেশ করেছ। সালিশিতেও যেতে হবে না। ন্যাড়াও করবে না। কেচ্ছা আছে যখন, চেপে যাও।'

 

ডুকরে কেঁদে ওঠে ঝিল্লি। সে কান্না হাওয়ার মতো প্রগলভ, বেগবান, আদিমতম, ভানহীন — যতটা ভানহীন ঝিল্লির তলপেটের অনেক তলার শিরশিরানিও। কান্নার গতি বাড়ে। ঝিল্লি আর্তনাদ করে 'আমার ছাওয়ালরে দেবা না? আমার পেটের ছাওয়াল? বাপ যা ভাববে তাই হবে? মোড়ল যা ভাববে, তাই? মায়ের কোনো কতার দাম নাই? ভাল হই, খারাপ হই, মা তো! আমার ছাওয়ালরে দেবা না?'

 

অসতী নারীর কান্নায় অসত্য খুঁজে পাওয়া ভার।

 

 

*****

 

 

মাস খানেক পর ঝিল্লিকে ফের দেখা যায় ট্রেনের দরজায়। সাদা সালোয়ার-কুর্তার উপর হালকা সুতোর কাজ। নিয়মভঙ্গে দিয়েছিল বৌদি। মণির জন্য জামাকাপড়ও। সুধাকর মরেছে দু হপ্তা আগে। মরার আগে নাকি বউ-এর নাম ধরে ডেকেছিল বার দুই, শাউড়ি বলেছে। পুরুষমানুষের এই এক রোগ। নিকষ রাত নামার আগে তারা কোমল স্বরে গলা সাধে না। অথচ 'সুধাকর' নামে সুধা ছিল। আর জনমে যদি তোমায় পাই সুধাকর, তুমি কি বালকসম হুটোপুটি খাবে আমার আকাশে? নরম সাদা জ্যোৎস্না ঢেলে দেবে? তুমি কি বোঝোনি ঝিল্লি কোমল আদরে বশ মানে? এখনও কি বুঝিসনি মিনসে?

 

আপাতত ঝিল্লি হাওয়া খায়। সদ্য বিধবার সাদা উড়নি পতপত ওড়ে। যে হাতে রড জড়িয়েছে, তার বিপরীত হাতে ধরা বুড়ির চুল। মণি মনমরা হয় বাপের জন্য সাঁঝবেলায়। ঝিল্লিও কি হয় না? বুড়ির চুল বা এটা ওটা পেলে ছাওয়াল মানুষ ভুলে থাকে। ঝিল্লি কি নিয়ে ভুলে থাকে? হঠাৎ কী মনে পড়ে ফিক্ করে হেসে ফেলে ঝিল্লি। সালিশি ফালিশি কোথায় কী? ছেলেকে দেবে না নাকি! হুঁঃ! বরং ছেলে গছাতে পারলে বাঁচে। সুধাকরের ছাওয়াল সম্পত্তির ভাগীদার যে! বাপ অকালে মরলে নাবালককে যদি মায়ের হাতে মুফতে গছানো যায়, তবে আর খুড়শউর কী চায়? মোড়লকে সে বুড়ো-ই ম্যানেজ করে নিল। কোনো পক্ষই কাউকে ঘাঁটাল না আর৷ জগৎসংসারের এমনধারা সতীত্ব দেখলে হাসি পাবে না, তোমরাই কও?

 

উড়ন্ত চুল, উড়ন্ত উড়নির ঝুলন্ত মেয়ের ফিক্ ফিক্ হাসি দেখে মেছুনিরা মুখ বাঁকায়। বলে, 'ঢঙ!' তাদের হাত ঝপাং ঝপাং চলে মেছো গামলার জলে। আর আঁশটে গন্ধ ছড়ায়। নরেন্দ্রপুর স্টেশনে অন্য কোনো ছেলে নামে। চোখ মটকায়। ঝিল্লি চোখে চোখে ইশারা ফিরিয়ে দেয়। ট্রেন হুইসল দেয়। অতিশব্দময় মেয়ে কামরা গতি নেয়।

 

0 Comments

Post Comment