দুখিরামের পাহাড়-পর্বত জেনে লাভ কী! আজ হাটে গিয়ে কালুকে বেচতে হবে। কিছুই করার নেই তার। কালু হল একটি এঁড়ে বাছুর। এখন আর বাছুর বলা যায় না। আর বছর খানেক পরেই কাঁধে জোয়াল চাপালে লাঙল টানতে পারবে। আ-চষা মাটিকে ফালা ফালা করে দেবে। ততোদিন তো আর তর সইলো না ফুলমনির। বলতে গেলেই মুখ ঝামটা দিয়ে উঠবে, এঁড়ে মরদের এঁড়ে এঁড়ে বুদ্ধি! ওই গরু তুমার সংসারের কুন উপকারটা করচে শুনি! না বাড়বেক পালে, না লাগবেক সংসারের হালে। উয়ার পেছুনে এত সুময় দিয়ার কী দরকার!
দুখিরাম বলেছে, টুকুন বড় হোক কেনে। তখন দেখবি কালু লাঙল টানবেক, জমি চষবেক!
ফুলমনি তেঁতে হাড়ি। লাটসাহেব আমার বড় চাষি গো! হাল রাখবেক বাড়িতে! আছে তো ওই বন ঘেঁষা কাঠা দশেক জমি। শালের পাতা পড়েই বুজে যায়। দুনিয়ার গাছের শিকড়-বাঁকড়। আওতা মাটি।
দুখিরাম কোনও যুক্তিই খাঁড়া করতে পারেনি বউয়ের কাছে। শুধু বলেছিল,এখন দাম নাই গরুর,আর একটু দাম বাড়ুক।
ওই ভাবে ঠেকঠুক দিয়ে আর কতদিন আটকে রাখা যায়! সামনে কুরবানির হাট। পাড়ার জগদীশ সেদিন বলল, গরুটাকে বেচবে তো বৌদি এই সুময় হাট লিয়ে যাওয়া করাও। এখন ভালো দাম উঠবেক।
ফুলমনি বলল, হ,জগদীশদাদা, উয়াকে তো বলচি। বলে বলে ব্যাত ধরে গেলেক। মিনষে কথাটা কানে লেয়নি গো আমার!
জগদীশ বলল, কী রে দুখে,গরুটাকে লিয়ে তুর মতলবটা কী শুনি!
কুনু মতলব নাই। তুই এত ফচর ফচর করিস না দিনি! যুথাকে যাচ্চিছ যা কেনে!
এই লাইনে একটা বাস চলে, নাম দাঁড়াশিং। সারাদিনে দু-বার যাওয়া আসা করে। শেষ খেপ নিয়ে যখন বাসটা ফিরে যায়,তখন লাল ধুলোর আস্তরণে দাঁড়াশিং- এর শিংটিং কিছুই বেরিয়ে থাকে না। গ্রামের ভেতরটা পিচ পড়েছে। গ্রামের শেষ থেকে নদীর ঘাট পর্যন্ত মোড়াম বেছানো। রাস্তার ধারে টলি কতোক চিপ পাথর পড়েছিল,কোনও কারণে কাজ শুরু হয়নি। বছর কতক হল ওইভাবেই পড়ে আছে। চিপগুলো যে যার প্রয়োজনে বস্তায় ভরে ঘর ঢুকিয়ে নিয়েছে। দু-পাশের দুটি গ্রামের মানুষও দিব্যি চলাচল করে ওই পথ দিয়ে। কারও কোনও মাথাব্যাথা নেই। ভোট আসে। ভোট যায়। শিমুলতলীর রাস্তা দাঁড়াশ সাপের মতো বুক চিতিয়ে পড়েই থাকে।
খেয়াঘাট পর্যন্ত দাঁড়াশিং বাসটাতেও আসা যায়,কিন্তু গরু নিয়ে তো আর বাসে ওঠা যায় না! হাঁস-মুরগী হলে অন্য কথা ছিল। শুধু হাঁস-মুরগী কেন! হাটের দিন বাস ফাঁকা থাকলে ছাগল পর্যন্ত তুলে নেয় কেউ কেউ।
দুখিরাম তাই হাঁটছে,গট গট করে হাঁটছে। হাতে তার কালুর গলার দড়ি। কালু কি কিছু বুঝতে পেরেছে! যে তাকে আজ হাটে বেচে দেওয়া হবে!
সেই এতটুকুন ছানা বয়েস থেকে কালুকে লালনপালন করছে দুখিরাম। কালুর মা-টা সাপে কেটে মরল। গাইটা সেদিন দহিজুড়ির কাঁন্দর পাড়ে চরছিল। ঝোপঝাড়ে ভর্তি জায়গাটা। সন্ধের সময় যখন ফিরল,তখন কেমন ঝিমানো ভাব। গোয়ালে ঢুকেই কালুর মা শুয়ে পড়ল। দেখে সন্দেহ হল দুখিরামের। গাইটার হলটা কী! প্যাটের ব্যামো!
কোনও বিষাক্ত লতাপাতা শুকলে,কিংবা খেয়ে নিলে এমন ভাবধারা থাকে গরুর। অবলা পশু তো মুখে কিছু বলতে পারে না। সেরকমই কোনও কিছু হবে হয়তো,সেই ভেবে গ্রাহ্য করেনি দুখিরাম।
রাত্রে কালুকে দুধ খাইয়ে গঁজে বেঁধে রেখে দেয় দুখিরাম, নাহলে সকালে যখন গাই দোহাই তখন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর রোজ দিনের মতোই সেদিন কালুকে দুধ খাওয়াতে ঢুকল। গোয়ালে ঢুকেই ধপ করে বসে পড়ল সে। দেখল গাইটা নেতিয়ে পড়ে আছে। জিভ বেরিয়ে গেছে। মুখে ফ্যানা। দুখিরামের চিৎকারে টর্চ নিয়ে ছুটে এল ফুলমনি।
সারারাত বাচ্চা ছেলের মতো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছিল দুখিরাম,কারও মা-বাপ মরলেও এমন করে কাঁদে না। সকালে গরুটার ঠ্যাঙে দড়ি বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে যখন বাইরে বের করা হল,তখন চোখে পড়ল ক্ষতটা। পিছনের পায়ের একটু ওপরে দুই আঙুল ফাঁক দুটো গভীর ক্ষত। জায়গাটা ফুলে নীলচে হয়ে গেছে।
সেই থেকে কালুর মা বলো, বাপ বলো সব তো দুখিরাম। গরুটাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে সে। আর একা একা ছেড়ে দেয় না। ঘাস,পাতা এনে খাওয়ায়। কাজের শেষে নিজে সাথে থেকে চরিয়ে আনে। দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল কালু। দুখিরাম না জল দেখালে জল খায় না, ছানি খায় না। ফুলমনিকে দেখতে পারে না কালু। উলটে জলের বালতি ফেলে দেয়। দড়ি খুলে বাথান থেকে গোয়ালে বাঁধতে গেলে গুঁতাতে যায়।
নদীটির স্থানীয় নাম বউটানা। দুখিরাম যখন খেয়াঘাটে এল,তখন বেলা অনেক বেড়েছে। চালে চালে রোদ ওঠা বেলা। হাটের দিন খেয়াঘাটে ভিড়। ভটভট্টি নৌকা ছাড়াও লোক পারাপারের জন্য কয়েকটা ডিঙি নৌকাও চলে আজ। ইঞ্জিন চালিত নৌকাগুলো গরু-মোষ-ছাগল সব পারাপার করে। যারা গরু পাইকের,পাল পাল গরু নিয়ে যায়,নিয়ে আসে—তারা ঘুরে ঘুরে চুয়ামাহিনা,শুকলাশোল হয়ে ল্যাদাসিংহির ব্রিজ পেরিয়ে যায়। অনেকটা ঘুরতি পথ। দুখিরাম একটি গরু নিয়ে কেন ওই পথে যাবে! খেয়ার জন্য অপেক্ষা করে সে।
অশ্বত্থ তলায় নুলো গাজুর চা-চপের দোকান। কাঠের বেঞ্চিতে পা ঝুলিয়ে চা খাচ্ছে কয়েকজন। দুখিরাম এক হাতে দড়ি ধরেই হাঁক পাড়ে গাজুকে। গাজুর ছোট ছেলেটা চা দিয়ে যায়।
বেঞ্চিতে বসা নামো-সিকলাবাদের একজন চাপ দাড়ির পাইকের দুখিরামের গরুটাকে চা খেতে খেতে দেখছিল। চা শেষ করে গলা ঝেড়ে উঠে এল। বলল,কতই ছাড়বে মালটাকে?
দুখিরাম চমকে উঠল। বলল,হাটে লিয়ে গিয়ে দেখি,কত উঠে।
কত উঠে আবার কী কথা! তুমার জিনিস,তুমাকে দাম হাঁকতে হবেক নাই!
এটা কি হাট বটে নাকি!
দোকানে যারা বসেছিল,তারাও হা হা করে হাসল,তুমি খ্যাপা বটো নাকি ভাই। তুমার জিনিস তুমি বিচতে লিয়ে যাচ্চ। কত দাম ফেড়েফুঁড়ে বলো। যদি পুষায় দিবে,না পুষায় না দিবে। হাটে যাওয়ার আগেই বিক্রি হয়ে গেলে তো তুমারই লাভ। খামোকা এতদূর যেতে হবেক নাই।
দুখিরাম একটা উচ্চ দাম ডাকল। তা দশ হাজার দিবে।
এই গজালে পারা গরুটার দশ হাজার দাম!
পাশের একজন বলল, ছেড়ে দে বে। হাটে কি গরু নাই নাকি! উয়ার গরু বেচার মুন নাই। কথাবার্তা শুনে বুজতে লারচিস!
হ,ভাই। তুমার গরু হাটেই লিয়ে যাও।
খেয়া এল। দুখিরাম চাপল, কিন্তু কালু পা বাড়ায় না। দড়ি ধরে টেনে তুলল কালুকে। জল দেখলে ভয় পায় কালু। যখন ঘোষদের পুকুরে গা ধোয়াতে নিয়ে যায়,তখনও এমন করে। ঘাটে চান করতে আসা বউ-ঝিরা বলে,এমন গরু এখানে আনো না বাপু। তুমাদের আদিবাসী পাড়ায় তো একটা পুকুর আছে। ছোট ছেলেপুলে লিয়ে চান করতে আসি আমরা,ভিড়কে গিয়ে যদি পায়ের চাট মেরে দেয়,তখন হবে কী!
কথাটা অবশ্য কেউ ভুল বলে না। জল দেখে কালু লাফঝাপ মারে। পাড়ার পুকুরটা অনেক খাল। নামার তেমন ঘাট নেই। দুখিরাম তাই ঘোষ-পুকুরে কালুকে চান করাতে নিয়ে যায়। ভিড় থাকলে অপেক্ষা করে।
নৌকায় ছাগল চাপল, ব্যাপারিরা হাঁস-মুরগির খাঁচা নিয়ে উঠল। কয়েকজন আদিবাসী মেয়ে জঙ্গলের কেঁন্দ, কচড়া, কুঁড়কুঁড়ি ছাতু, মেটে আলু বেচতে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ নিয়ে যাচ্ছে খেজুর পাতার ঝাঁটা, মুড়ি ভাজার কুচি কাঠি। কেউ বা খেতের আনাজপাতি।
দুখিরাম কালুকে শক্ত করে ধরে রাখল, লাফিয়ে দিলে মুশকিল! যা ছটফটে! ইঞ্চিন চলছে। কালো ধোঁয়া উগড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কালু জলে নিজের মুখ দেখছে।
গরুর দশটাকা আর দুখিরামের সাত টাকা মিলে সতেরটাকা ভাড়া লাগল। কিছুটা গিয়েই পিচরোড। দুখিরাম পিচ ছাড়িয়ে নেমে গেল নিচের খোয়াই রাস্তায়। ওই তো বন। শাল, মহুয়া, পিয়াল, কেঁন্দ, তার ফাঁকেই জোড়া পাহাড়ির টিলাদুটো হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
বন দেখে কালুর চলার গতি বেড়ে গেল। ভাবছে চরাতে নিয়ে যাচ্ছে। বনে মাঝেমধ্যেই কালুকে চরাতে নিয়ে যায় দুখিরাম। শিমুলতলীর দক্ষিণেও তো বন। গ্রামটা একসময় জঙ্গলের মাঝে ছিল। মানুষজন যত বাড়ল,বনটা ততো পিছনে সরে গেল।
বনের পথ কত ছায়াময়। কালু পথের ধারে গাছপালা দেখে মুখ বাড়ায়,খপ করে এক খাবলা ছিঁড়ে নিয়ে চিবতে চিবতে এগোয়। এক সময় হাটে পৌঁছাল দুখিরাম। ও বাবারে বাবা! আজ এত ভিড়!
জোড়া পাহাড়ির হাটে এর আগেও অনেকবার এসেছে দুখিরাম। পরবের আগে ফুলমনিকে নিয়েও এসেছে। জামা-কাপড়, জুতো কিনতে। দোকানের থেকে অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। কিন্তু কুরবানির সময় হাটে কখনও আসেনি। এখন শুধু গরু-ছাগল কেনাবেচার সময়।
দুখিরাম হাটে ঢুকে কোনও স্থল পেল না। কী করবে,কোথায় যাবে সে! জিনিস কিনে নিয়ে গেছে হাট থেকে,কিন্তু বিক্রি করতে আসেনি। বিক্রি করার মতো আছেটাই বা কী! ফুলমনি যায় জঙ্গলে। শালপাতা তুলে এনে সেলাই পাতা বানায়। বিড়ি পাতা তুলে এনে শুকিয়ে রাখলে গাঁয়ের গনা মিস্ত্রীর ব্যাটা কিনে নেয়। এই এলাকার যত আদিবাসী বউ-ঝি আছে,সবাই গনার ব্যাটাকেই মাল দেয়। আর দুখিরাম যায় লোকের ধান কাটতে, রোয়াতে,কখনও পাথর খাদানে। কোনওদিন বসে থাকে না মানুষটা। যেমন বেঁটেখাটো গোলগাল শক্তসমর্থ চেহারা,তেমন ভুসভুষে কালো গায়ের রঙ। কারও সাতেপাঁচে থাকে না। খেটেখুটে আসে, আর ওই কালুকে নিয়েই পড়ে থাকে।
সূর্য এখন মাথার ওপর। বিশাল এলাকা জুড়ে হাট! টিলার নিচে বড় বড় মহুয়া গাছের তলায় অস্থায়ী সস্তা ভাতের হোটেল,চা-চপের দোকান,সেলুন, কামারশাল, দরজি। এক পাশে জামা-কাপড়,জুতো বিভিন্ন ইমিটেশনের মনহারি সামগ্রীর পশরা। তারই সম্মুখে শাক-সবজি, ফলফুলের বাজার। আর হাটের বিঘা পাঁচেক বিশাল পড়ো মাঠটা পশু-পট্টি। ওখানেই হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল-মোষ কেনাবেচা হয়। পশু পট্টিতে এর আগে কখনও ঢুকেনি দুখিরাম। গরু-ছাগলের দাম-দর সম্বন্ধেও কোনও ধারণা নেই তার। হাটে আসার আগে ফুলমনিকে তাই জিজ্ঞেস করেছিল, কত পেলে বিচব গরুটাকে?
ফুলমনি চালাক মেয়ে। একে তাকে বলে যাচিয়েও নিয়েছে কেমন দাম হতে পারে। বলে দিয়েছে সাত হাজারের কমে দাও না।
দুখিরাম ভিড় ঠেলে কালুকে নিয়ে পশু-পট্টিতে ঢুকে। পশু-পট্টিতে কত গরু নেমেছে! অধিকাংশই বনধারের গরু। কুরবানির সময় দূর দূরান্ত থেকে গরু কিনতে আসে এই হাটে।
একটা পলাশ গাছের নিচে জায়গা করে নিয়ে দুখিরাম দাঁড়াল। পথচলতি মানুষদের মধ্যে অনেকেই কালুর গায়ে হাত দিয়ে দেখে যাচ্ছে। কেউ দাম জিজ্ঞেস করছে। দুখিরাম দাম ধরেছে দশ হাজার।
মানুষজনের কোলাহল আর পশুদের আত্মচিৎকারে জোড়া পাহাড়ির হাট গম গম করছে। দুখিরাম ভেবে অবাক হয়,এত হাজার হাজার গরু ছিল কোথায়! কোনও গরু নিজের গোয়াল ঘরটি ছেড়ে এসে অচেনা জায়গায় এসে গো গো ডাক ছাড়ছে। কোনও বাছুর মা ছাড়া, কেউ বা তার বাছুরটিকে ছেড়ে এসেছে। এক বাড়ি থেকে চলে যাবে অন্য বাড়িতে,অন্য গ্রামে। আর কি কখনও মা ছেলের দেখা হবে! হায় রে পশু জীবন! কালুর গায়ে হাত বুলোয় দুখিরাম। কী ভেবে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল তার। কালুও তো চলে যাবে! আর কি কোনওদিন দেখতে পাবে!
মানুষের পায়ে পায়ে ধুলো উড়ছে হাটে। একটা গুমোট ভ্যাপসা গরম। গড় গড় করে ঘামছে দুখিরাম। দু'একজন দাম জিজ্ঞেস করে আর দ্বিতীয় কথাও বলেনি। দুখিরামের এত তাড়া নেই। জিনিস তার, সে গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। কারও পোষালে নেবে, না পোষালে না নেবে।
ছাতিম তলায় পিক-আপ ভ্যানের ওপর একজন আখের রস বিক্রি করছে। পিপাসায় গলা শুকিয়ে গেছে দুখিরামের।
লোকটা চোখাচোখি হতেই বুঝতে পারল। হাঁক পাড়ল, খাবে নকি?
দুখিরাম বলল, হ, দিয়ে যাও কেনে।
লোকটা এক গ্লাস রস দিয়ে গেল। টাটকা পেষা রস। বরফকুচি মেশানো।
রস ওয়ালা বলল, এটাই পরবের শেষ হাট। পরের হাটে গরুর দাম পড়ে যাবেক। কাউকে পেলে গতিয়ে দাও দাদা।
দুখিরাম বলল, গতানোর কী আছে! আমার গরু খুঁতো নাকি হে!
দুখিরামের মেজাজ দেখে রসওয়ালা পয়সা নিয়ে সরে পড়ল। দ্বিতীয় কোনও কথা বাড়াল না।
অবশেষে একজন এল। ডুঁয়াসাহির আবিদ মিঞা। লাল মেহেদি করা চাপ দাড়ি। সুরমা পরা চোখ। ফতুয়া আর মালকোঁচা মেরে পরা নীল চেক চেক লুঙি। কাঁধে গামছা। সাথে পাচন হাতে একজন অল্প বয়সী ছোকরা।
আবিদ মিঞা গরু পাইকের। শিমুলতলীতেও গরু কিনতে যায়। ব্যবসাদার মানুষ। দুখিরামের গরুটাকে দেখে, নাকি পলাশ তলায় ছায়া দেখে কে জানে, হটর পটর করে কাছে এসে দাঁড়াল। গামছা দিয়ে মুখ গলার ঘাম মুছে বলল,তুমাকে চিনা চিনা লাগচে। কুথায় দেখিচি বলোদিনি!
দুখিরাম বলল, আমার গাঁ শিমুলতলী। তুমি তো আমাদের ওদিকেও যাও।
পান চিবুচ্ছে আবিদ মিঞা। পিরিচ করে পিক ফেলে বলল,তা ক' দেঁতে?
দাঁত-ফাতের আমি কিছুই জানি না। তুমিই দেখে লাও।
দুখিরাম বলার আগেই আবিদ মিয়ার সাথের ছোকরাটি কালুর গলাটা হাত পেচিয়ে ধরে দাঁতকপাটিটা ফাঁকা করে গরুর দাঁত দেখে। বলল, দুলাভাই, মোটেই দু'দেঁতে।
আবিদ মিঞা বলল, দেখেই বুঝেছি কচি গরু, খালি গায়েগতরে বেড়ে গেছে।
সম্বোধনে বোঝা গেল ছোকরাটি আবিদ মিঞার শালা। জামাইবাবুকে সাথে নিয়ে কুরবানির গরু কিনতে এসেছে।
আমরা তো একলাই কুরবানি দুবো। এটাই ঠিক আছে দুলাভাই। বেশি বড় গরু এবছর পারবনি।
দুখিরামের বুক কেঁপে উঠল। তার কালুকে কুরবানি দিয়ে দেবে!
আবিদ মিঞা বলল, দাম বলো তো ভাই। কত লিবে?
দুখিরামের মন ঘুরে গেল। খিটখিটে মেজাজে বলল, দশ হাজার টাকার কমে দুবোনি।
খ্যাক খ্যাক করে হাসল আবিদ মিঞা। তুমি তো ভাই প্রথমেই দুবোনি বলে দিচ্চ। তাইলে লুবো কী করে! দিবার দাম বলো একটা।
দুখিরাম বলল, ঠিক দামই বলচি দাদা। বুনো গরু। চেহারা দেখো।
বুনো গরু কী আর নাই নাকি হাটে? দশ হাজারে ইয়ার থেকেও অনেক ভালো গরু হবেক।
আছে তো লাও গা কেনে। আমি ইয়ার কমে দুবোনি।
তুমার গরু ভাই তুমি রেখে দাও গা। এত মেজাজ কীসের! চল সরুল, অন্য জায়গায় দেখি। আবিদ মিঞা চলে গেল সরুলের হাত টেনে। কিন্তু কিছুটা গিয়েই পেছন ফিরে আবার একবার দাঁড়াল,আটে ছাড়বে কি? এক দাম।
দুখিরাম বলল, না।
মুখ বিকৃত করে আবিদ মিঞা চলে গেল।
বেলা অনেক বেড়েছে। খিদেই পেট চুঁইচুঁই করছে। দুখিরাম ভাবে ফুলমনি যা বলেছিল,তার থেকেও একহজার বেশি উঠল। অথচ সে গরু না বেচে দাঁড়িয়ে আছে কেন! কী করবে সে এখন! কেউ যদি দশহাজার টাকাতেই নিয়ে নিতে চাই,তখন? আরও একটু বাড়িয়ে বলবে কী! গরু না বিক্রি করলে ঘরে ফিরে ফুলমনিকেই বা কী জবাব দেবে!
মানুষজনের ভিড় ধীরে ধীরে কমছেও। যাদের কেনাবেচা হয়ে গেছে,তারা হোটেলে গিয়ে ভাত, রুটি খেয়ে নিচ্ছে। দুখিরাম সেই সকালে মুড়ি খেয়ে বেরিয়েছে, গরু তো বিক্রিই করেনি। খেতে গেলে ঘর থেকে আনা টাকাগুলো ভাঙতে হবে। নাকি কালুকে নিয়ে বেলা থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়বে! মাথায় কোনও বুদ্ধিই আসে না দুখিরামের। কালুকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পলাশ তলায় বসে পড়ে। এদিক ওদিক চায়,মানুষের পা দেখে,ধুলো খায়।
আবিদ মিঞার শালা সরুল একটা গরু নিয়ে দুখিরামের গা ঘেঁষে পেরিয়ে গেল। আবিদ মিঞা দুখিরামকে শুনিয়ে বলে,দেখো গরু কাকে বলে। ছয় হাজারে তুলেছি। তুমার মতন কু-পেকো লোকের গরু বিক্রিই হবেক নাই। সারাদিন বসে বসে মাছি তাড়াও।
দুখিরাম নিজের মনেই পাগলের মতো খ্যাক খ্যাক করে হাসল। শালা গরুই বিচব নাই। কেমন কিনতে পারিস, কিন দেখি!
হাটের তলাওয়ালা খাতা হাতে ঘুরছে। দুখিরামের কাছে এসে দাঁড়াল, কই দেখি ভাই তুমার তলাটা,দশটাকা দাও।
দুখিরাম উঠে দাঁড়াল। বলল,কীসের টাকা? আমি তো এখনও গরু বিচতে পারি নাই!
বেচতে পার নাই তো কী হয়েছে! কেউ বারণ করেছে নাকি তুমাকে বেচতে?
না বিচলে টাকা পাব কুথাকে।
ওইসব ধানাইপানাই অন্য জায়গায় করো। রঙ চালাকি পেয়েছ নাকি হে! হাটে আসবে, তলা দিবে নাই!
দুখিরাম আর কথা বাড়াল না। লোকটার মুখের যা ধার, কিছু বলতে গেলে এবার গায়ে হাতই না তুলে দেয়। বুক প্যাকেট থেকে পলিথিনের পুটলিটা বের করে খুচরো গুনে গুনে দশটাকা দিয়ে দিল লোকটাকে।
তলা ওয়ালা লোকটা চলে গেলে টাকাগুলো গুনে দেখল দুখিরাম। একী! আর মোটে পঁয়ত্রিশ টাকা পড়ে আছে! তাহলে খাবে কী করে! ত্রিশ টাকায় সবজি ভাত খাওয়া যাবে, খেলে খেয়া পেরবে কী করে! বেশ চিন্তায় পড়ে গেল সে। বাড়ি থেকে বেশি টাকা নিয়েও বেরোয়নি। ভেবেছিল কালুকে বিক্রি করলে হাতে তো টাকা আসবে। টাকা নিয়ে যাওয়ার কী দরকার আছে!
সারাদিন পেটে ভাত পড়েনি দুখিরামের। রোদে-গরমে ভিড়-ভাট্টায় থেকে খুব জব্দ হয়ে গেছে সে। কালুও কিছু খেতে পাইনি। দুখিরাম আর বসে না। উঠে গামছা দিয়ে পেছনটা ঝাড়ল। তারপর গাছ থেকে দড়ি খুলে কালুকে নিয়ে হাট থেকে বেরল।
হাট ছাড়িয়ে দুখিরাম যখন নেমে এল জঙ্গলের রাস্তায়,তখন সূর্য অনেকটা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। শরীর ক্লান্ত,অবসন্ন। সন্ধ্যার আগে খেয়া পেরতেই হবে, নাহলে কালুকে পার করা খুব হ্যাপা হয়ে যাবে।
হ্যাঁ গো, হাটে তুমাকে অনেকক্ষণ ধরেই লজর রেখেচি। তুমি কুন গাঁয়ের লোক বটো গো?
আচমকা মানুষের গলা পেয়ে দুখিরাম চমকে উঠল। পিছন ফিরে দেখল একটা কালো ছিপছিপে লোক কোলে একটা খাশি ছাগল নিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। দুখিরাম বলল, আমি শিমুলতলীর লোক বটি গো। তুমি কুন গাঁয়ের!
আমি মহুলডাঙার।
অহ, কাছেই তো তাইলে। তা,গরুটাকে বিচলে নাই যে!
ইটো হামার সন্তান আছে। ইকে বিচব নাই। হামার জান বটে,রক্ত বটে।
কী করবে ইয়াকে লিয়ে? এঁড়ে গরু।
কেনে! জোড় করলে লাঙল টানবেক,জমি চষবেক।
তা ভালো কথা। জমি-জায়গা আছে নকি?
দুখিরাম ঘাড় নাড়ল। আছে কাঠা দশেক। জমির যা ছিরি! নাই বলাই চলে।
কিছুক্ষণ দু'জনেই নীরব।
তুমি ছাগলটাকে কিনলে নকি?
না হে বন্ধু। ইটাকেও বিচতে পারলাম নাই। আমার ছোট মেয়ে সাঁজলির ছাগল। হালোয়ানটার দুটো ছা' হলেক,একটা পাঁঠা আর একটা পাঁঠি। পাঁঠিটাকে গোয়াল থেকে হেঁড়লে কান ধরে টেনে নিয়ে গেলেক। পাঁঠাটাকে কাটিয়ে খাশি করেছিলাম। ভাবলাম টুকুন বড় হয়েচে, খাশিটাকে রেখে কী করব! বিচে দিয়ে আসি। ইটা তো পালে বাড়বেকনি!
তা বিচলে নাই কেনে!
আনার সুময় সাঁজলি খুব কাঁদছিল বন্ধু। ধরে রাখা যায়নি ওকে। কোনও মতে ছুটে চলে এসেচি। তারপর মনটা কেমন করতে লাগলেক। তুমাকে কী করে বুঝাব হে! এ জ্বালা বড়ই জ্বালা। ছাগলটা কিনেও লিয়েছিল একজন। বিচে দিয়ে আর থাকতে পারলমনি। সাঁজলির জলে ভিজা চোখ দুটো খুব মনে পড়ছিলেক।
তা লোকটা ফিরায় দিলেক?
এত সহজে কি আর ছাড়ে! সব খুলে বললম। কমিটির লোক পঞ্চাশটাকা ফাইন করলেক, তারপর ঘুরে দিলেক। সে লাগুক। একটাই মেয়ে আমার,তাকে কাঁদিয়ে টাকাটা কি হজম হতুক!
আমার তো ছেলেপুলেও নাই হে বন্ধু। এই কালুই আমার ছেলে, কালুই আমার মেয়ে। বিচি কী করে বলোদিনি! বউটা খালি ঘ্যানঘ্যান করে।
গরু-ছাগল বড়ই মায়ার জিনিস বন্ধু। তুমার আমার মতো লরম মানুষের ইসব না পালায় ভালো।
লোকটা মহুলডাঙার বাঁকে আসতেই ঘুরে গেল। বলল,আসি হে বন্ধু। সাবধানে যাও।
দুখিরাম হাঁটতে হাঁটতে লোকটার কথা ভাবে। সে ভাবত পৃথিবীতে তার মতো পাগল আর বুঝি দ্বিতীয়টি নেই। আজ আরও একজন পাগলের দেখা মিলল।
আলোর তেজ কমে আসতেই কালো ছায়া পড়ল পথে। বনের পথ অন্ধকার ছায়াময়। কালু রাস্তার ধারে কচি শাল পাতা দেখে মুখ বাড়ায়। খুব খিদে পেয়েছে বেচারির। দুখিরাম খানিক দাঁড়ায়। খেতে দেয় কালুকে। গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে। তুকে বেচতে পারি রে কালু! তুই আমার জানের জান, পরাণের পরাণ! সারাজীবন তুকে রেখে দুবো। কুনুদিনও বেচব নাই।
পরক্ষণে বউয়ের মুখটা ভেসে উঠতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল দুখিরামের। বাড়ি ফিরে ফুলমনিকে কী জবাব দেবে সে! আজকের মতো ফাঁড়া কাটলেও কালুকে কি বাঁচাতে পারবে! তাহলে এখন কী করবে দুখিরাম! কালুকে নিয়ে কি পালাবে কোথাও? কোথায় যাবে সে! পালালে ফুলমনির কী হবে! কালুকে বাঁচানোর নানারকম উপায় খুঁজতে থাকে দুখিরাম।
আচ্ছা,কালুকে যদি জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়,তাহলে কেমন হবে? কালু পারবে বাঁচতে! কথাটা মনে হতেই গলার দড়িটা খুলে দিল দুখিরাম। তারপর পিঠ চাপড়ে দিল কালুর। যা কালু,যা। নিজের মতো চরে খেয়ে বাঁচ বাপ।
কালুর কোনও হেলদোল নেই। নিজের মনে পাতা খেয়েই যাচ্ছে। দুখিরাম আর দাঁড়াল না। সুর সুর করে সরে পড়ল। পিছন ফিরেও তাকাল না।
দুখিরাম যেই খানিকটা এগিয়েছে,অমনি খুরের শব্দ পেল। থমকে দাঁড়াল দুখিরাম। দেখল কালু তার পিছু পিছু হেঁটে আসছে। এ তো মহা মুশকিল! ঘুরে তাকাতেই এক ছুটে কাছে চলে কালু। কাছে এসেই লেজ নাড়িয়ে, কান নাড়িয়ে মুখটা ঘঁষতে লাগল দুখিরামের গায়ে। চোখে জল চলে এল তার। দুই হাত দিয়ে কালুর মাথাটা জড়িয়ে ধরল দুখিরাম।
সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। দড়িটা কালুর গলায় পরিয়ে দিল দুখিরাম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে খেয়াঘাটে পৌঁছাতে হবে।
আজকাল, শারদ ১৪২৯ পূর্বে প্রকাশিত।