অনেক দিন তারুকাকার দোকানের দিকে যাওয়া হয়নি। আজ ভাবলাম, একবার না হয় ঘুরেই আসা যাক। চটাদার খবরও নিতে হবে। আর মনের মধ্যে যে প্রশ্নগুলোর বুদ্বুদ ফুটছে, সেগুলোকেও রাখা যাবে।
চটাদাকে যথাসনেই পেয়ে গেলাম। সেই শোয়ানো ভাঙা ল্যাম্পপোস্টের বেঞ্চির এক ধারে। কিন্তু এ কী? হাত একেবারে খালি? পাশেও কেউ নেই? এরকম তো সচরাচর হয় না! আমাদের অঞ্চলের ডজন ডজন লোক এই ধনেশ চক্কোত্তি লেনের মোড়ে ছুটে আসে তারুকাকার বেগুনি আর চটাদার বাণীর টানে।
আজ কী হল?
দুনিয়ার কোথাও কি খুব বড় মাপের ওলটপালট হয়ে গেছে?
কিলিমাঞ্জারো পর্বতে কোনো ভিসুভিয়স জাতীয় লাভা উদ্গীরণ হয়েছে?
চিনের প্রাচীর কি ভেঙে পড়েছে?
লন্ডন ব্রিজ কি সত্যি সত্যিই এবার ফলিং ডাউন হল?
আদানিকে আমেরিকার আদালত টেনে নিয়ে গেছে শেষ কালে?
জানার জন্য তাড়াতাড়ি সাইকেল থেকে নেমে রাস্তার ধারে স্ট্যান্ড ফেলে রেখেই চট জলদি গিয়ে বসলাম চটাদার পাশে। জিগ্যেস করলাম – কী হয়েছে আপনার চটাদা?
চটাদা গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন – কিছু হয়নি তো! কী আবার হবে? তোর কী খবর বল?
– আমি ঠিক আছি। চা বলি?
– বল।
– আর কী বলব? সিঙ্গারা না বেগুনি?
– আর কিস্যু বলতে হবে না। চুপচাপ চা খেয়ে বাড়ি যা।
বুঝলাম, চটাদা কোনো কিছুর উপর, কিংবা, কারও উপর খেপে আছেন। কেসটার নাগাল পাওয়ার জন্য একটা ঢিল ছুঁড়লাম। অবশ্যই আন্দাজে। এবং অন্ধকারে – শরীর ঠিক আছে আপনার? প্রেসার বা সুগার বাড়েনি তো?
ঢিলটা ফসকে গেল। অনেক দূর দিয়ে। চটাদা বসার জ্যামিতি একটু পালটে নিয়ে বললেন – ওসব তোদের হয়। ভেতো বাঙালিদের। আমার হয় না।
– কিন্তু আপনার মন মেজাজ আজ ভালো নয় দেখছি। কিছু তো হয়েছেই। যদি বলতে না চান বলবেন না। আমি দুটো গরম সিঙ্গারা আনছি।
ভোগ দেওয়া গেল অবশেষে।
গরম সিঙ্গারা দুটোতে কামড় দিতে দিতে চটাদা এক সুদূর লোক থেকে দার্শনিক ভঙ্গিতে বললেন – দেশটার মান ইজ্জত বলে কিছু রইল না, বুঝলি?
– কেন কেন? আমি খুশি হয়ে উঠলাম, এতক্ষণে চটাদার মৌন কাটানো গেছে বলে।
– দেশের নির্বাচন কমিশনের পেছনে সবাই কীভাবে লেগেছে দেখেছিস?
আরে, আরে, আমি তো সেই ব্যাপারেই চটাদার কাছে পরামর্শ নিতে এসেছিলাম। বললাম – হ্যাঁ, রাহুল গান্ধী যেভাবে চেপে ধরেছে, ওদের একেবারে ন্যাংটো করে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে।
– তুই খুশি হয়েছিস এতে?
– খুশি হবার মতোই তো ব্যাপার। আমি বললাম – অনেক দিন পর পদ্ম শিবিরকে এত চাপে পড়তে দেখছি। বিরোধী শিবিরকে ঐক্যবদ্ধ দেখাচ্ছে। তোমার ভালো লাগেনি?
চটাদা যেন একটা মাছি তাড়ালেন। আসলে আমার কথাটাকে হাত দিয়ে ওনার কানের পাশ থেকে সরিয়ে দিলেন বলে মনে হল। তারপর বললেন – তোদের ভালো লেগেছে? অদ্ভুত ব্যাপার!
– আমারও অদ্ভুত লাগছে তোমার ভালো লাগেনি শুনে! তুমি সমস্ত ব্যাপারে কত ওয়াকিবহাল থাক। কত লজিক্যাল কথাবার্তা বল। সেই তুমি কিনা —-
– সেই আমিই বলছি, এটা ভালো লাগার মতো ঘটনা নয়।
– কেন কেন?
– নির্বাচন বুঝিস?
– সামান্য হলেও বুঝি। ভোট তো দিয়েছি কবার।
– সে তো বুথে গেলি, লাইনে দাঁড়ালি, টুক করে বোতাম টিপে চলে এলি। জানিস, পুরো আয়োজনটা করতে কী মেহনত লাগে? কত লোকজন লাগে? কী বীভৎস পরিমাণ ট্রেনিং দিতে হয়? ভোটিং মেশিন বানাতে চালাতে কতটা ঝামেলা পোয়াতে হয়? এসব কিছুর খবর রাখিস?
ধুস, আমার রাগ হয়ে গেল। চিরকাল দেখে এলাম, চটাদা সরকার রাষ্ট্র সরকারি প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করে এসেছে, আমরা বুঝতে না পারলে জলভাতের মতো করে বুঝিয়ে দিয়েছে, আর আজ এসব কী বলছে? কেমন যেন সাপোর্ট সাপোর্ট গন্ধ! বলে ফেললাম – যা বলতে চাও বলে ফেল।
চটাদা বললেন – রাগ করছিস তো? এই জন্যই আমি কিছু বলতে চাইনি। জানি, তোরা বুঝবি না। তোদের পায়রা মগজে এসব জিনিস ঢোকার নয়। মেমরি স্পেস একটু বেশি লাগে!
– বুঝিয়ে দিলেও বুঝব না? কত সমস্যাই তো বুঝিয়ে দিয়েছেন।
– বেশ তবে শোন। চুপটি করে বসে থাকবি। ফোরন কাটবি না। তার আগে তারুদার থেকে দুটো ডবল হাফ লিকার নিয়ে আয়। গরম গরম নিবি।
– ভারতবর্ষ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ যেখানে নিয়মিত নির্বাচন হয়। এটা নিশ্চয় মানিস। এই বিরাট দেশে এখন প্রায় আশি কোটি ভোটার। সেই ভোটাররা লোকসভা বিধানসভা হয়ে গ্রামে শহরে মিলিয়ে কয়েক লক্ষ বুথে বিভক্ত। এক একটা বুথে গড়ে হাজার বারোশ করে ভোটার। স্রেফ ডায়মেনশনটা ভেবে দ্যাখ।
– সে তো বটেই।
– এই অ্যাত বড় একটা মেশিনারিকে চালাচ্ছে মাত্র তিনটে লোক। ব্রেইনটা ধরতে পারছিস?
– এগুলো দিয়ে ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন, সেটাই ঠিক মাথায় আসছে না!
চটাদা চায়ের গ্লাশটা থেকে এক চুমুকে অনেকটা চা গলায় ঢুকিয়ে দিয়ে হাসলেন – এত সহজেই যদি বুঝে যাবি, তাহলে আর এই ধ্রুবেশ্বর চট্টোর কাছে তোকে ছুটে ছুটে আসতে হবে কেন? এই রকম একটা বিশাল মেশিনারিকে যাঁরা নাড়াচাড়া করছেন, তাঁদের অসম্মানটাই বা কেন চোখে পড়বে?
– অসম্মান? ওনাদের অসম্মান করা হচ্ছে?
– হচ্ছে না? তোদের রাহুল গান্ধী নইলে কী করছে? কটা বুথের কাগজ আর হিসাব সামনে এনে কী যাচ্ছেতাই করেই না ভোট চোর বলে গাল দিচ্ছে। এটা অসম্মান নয়? ওনারা কি ভোটে দাঁড়ান যে ওনাদের তোরা ভোটবাজ লোকেরা ভোট চুরির দায়ে ফেলবি? একটা সামান্য আক্কেলও কাজ করবে না? জানিস না, কতটা পড়াশুনা করে কঠিন কঠিন পরীক্ষা দিয়ে তবে ওনারা ওরকম জায়গায় যেতে পারেন?
– বা রে! ওনারা নিজেদের জন্য ভোট চুরি বা মিছে ভোটারের নাম ঢুকিয়েছেন – একথা কেউ কি বলেছে? শাসক দলের হয়ে ওরা এই কাজটা করেছেন — এটাই তো রাহুল গান্ধী, তেজস্বী যাদব, যোগেন্দ্র যাদব, দীপঙ্কর ভটচাজদের সন্দেহ বা অভিযোগ! এরকম চোরাই কাণ্ড করার জন্য লেখাপড়া জানেন কি জানেন না তার কী সম্পর্ক? প্রশাসক পদে থেকেই একটা শাসক দলের হয়ে কাজটা করে চলেছেন!
চটাদা প্রায় খেপে গেলেন? – তুই দেখেছিস?
– আমি তো নাম ঢোকাতে দেখিনি, রাহুল গান্ধীর প্রেস কনফারেন্সের ভিডিওটা দেখেছি।
– তাতেই বুঝে গেলি, ওনারা ভোট চোর? কী আশ্চর্য! ওনাদের প্রেস কনফারেন্সটা দেখলি?
– হ্যাঁ, ওটাও দেখলাম। কোনো প্রশ্নেরই তো উত্তর দিতে পারছেন না। আজে বাজে কথা বলে চলেছেন।
– আজেবাজে? কোনটা আজেবাজে কথা শুনি?
– এই যে একবার বললেন, আপনারা বুথের সিসিটিভি ফুটেজ কেন দেখালেন? এতে মহিলা ভোটারদের সম্ভ্রম হানি হতে পারে!
চটাদা ল্যাম্প পোস্ট বেঞ্চি থেকে নেমে সিধে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমার দিকে লাল চোখ পাকিয়ে বললেন – কথাটার মানে বুঝেছিস?
আমি এবার সত্যিই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। চটাদা বলে কী? – আপনি কি শুনেছেন সাংবাদিকের কথাটা? ভোট দেবার জায়গাটা মেয়েদের পোশাক পাল্টানোর ঘর নয়। মেয়েরা ওখানে বে-আব্রু অবস্থায় থাকে না। সেজেগুজেই থাকে। আর পোলিং বুথে সিসিটিভি লাগানোই হয় যাতে প্রতিটি ভোটারের গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখা যায়। এমনকি মহিলাদেরও। সেটা যদি লাইভ দেখা যায়, তার ফুটেজ দেখলে বা দেখালে নতুন কী সমস্যা হচ্ছে? আপনার সেই লেখাপড়া বাবুরা তার কোনো জবাবই খুঁজে পাননি! বুঝেছেন? খালি ত-ত-ত করে গেছেন!!
– যা বাব্বা, এখন দেখছি, তুই আমার জায়গাটা নিয়ে ফেলেছিস! আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস?
– জ্ঞান দেবার কী আছে? সাংবাদিক সম্মেলনে যা দেখেছি সেটাই বলছি।
– আর কী দেখলি?
– কেরালার ত্রিচুরে শুধু একটার পর একটা খালি ফ্ল্যাট আর বাড়ির নম্বরে ৬০ হাজার ভোটারের নাম ঢোকানো হয়েছে, যাদের কেউ ওসব জায়গায় থাকে না। বিজেপি ওখানে লোকসভায় ৭৪ হাজার ভোটে জিতেছে। ওদের মুখ চুন হয়ে গেসল।
– আর আর??
– আর বিহারে বিশেষ নিবিড় সন্ধান চালিয়ে জ্যান্ত ভোটারদের মৃত বানিয়ে ছেড়েছে, মৃতদের নাম তুলে দিয়েছে গাদা গাদা। কীরকম ইস্পেশাল সন্ধান কম্ম বল?
– বাপ রে, তুই তো দেখছি, রাহুল গান্ধী আর দীপঙ্কর ভটচাজ্যির ডায়লগ সব মুখস্থ করে নিয়েছিস। তার পর কী শুনলি?
– কেন, এমন এক বিশুদ্ধ তালিকা বানিয়েছে, যেখানে বাবার বয়স ৫৭ আর ছেলের বয়স ৭২। একই বাড়িতে ৮০ জন ভোটার। মন্টু দাসকে শুধু স্বামী দিয়েছে তাই নয়, স্বামীর নাম বানিয়েছে মনিরুল শেখ। কী নিবিড় সংশোধন ভেবে দেখ। একজন মহিলা জীবনে প্রথম ভোটার হল ১২৪ বছর বয়সে। নিখুঁত অনুসন্ধান — তাই না চটাদা?
চটাদা আবার বসে পড়লেন। বললেন – নে, অনেক কথা বলেছিস। আবার দুটো বেগুনি নিয়ে আয় আর চা বলে দে। তোর সঙ্গে বকবক করে গলা শুকিয়ে গেল।
আমি বললাম – আজ তো বেশি বকবক আমি করছি।
– স্বাভাবিক। তোরা লক্ষই করলি না, বিহারে ওরা বাংলাদেশি আর রোহিঙ্গা খুঁজে বেরবে বলে এত জোর দিয়ে ভোটার তালিকা চেক করেছে। তাতেই যা দুচারটে ভুল হয়ে গেছে।
– হা হা হা, দুচারটে ভুল? আমি বোধ হয় একটু বেয়াড়া ভাবেই হেসে দিলাম – দুচার লক্ষ ভুলকে আপনি দুচারটে ভুল বলছেন? এরকম বলা যায়? ৬৫ লক্ষ লোকের নাম বাদ দিয়েছে ওরা – সেই হিসাবটা আপনার খেয়াল আছে?
– হ্যাঁ, তা একটু বেশিই হয়ে গেছে।
– সেই ৬৫ লক্ষের মধ্যে কত জন বাংলাদেশি আর কত জন রোহিঙ্গা পাওয়া গেছে?
এই প্রথম চটাদা সঙ্গে সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারলেন না। একবার ডান দিকে তাকালেন। একটু পরে বাঁ দিকে চোখ ফেরালেন। তার পর মাথায় বেশ জোরে জোরে চুলকে নিলেন। আমি এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছি দেখে শেষে বললেন – যা বেগুনি নিয়ে আয়।
– অ, বেগুনি না আনলে বাংলাদেশি আর রোহিঙ্গার হিসাব মনে পড়ছে না?
– না, তা কেন? তুই যদি আর আমাকে বেগুনি খাওয়াতে না চাস, আনিস না।
আমি বললাম – আমি আপনার জন্য দুটো বেগুনি আর দুটো সিঙ্গারা নিয়ে আসব, আপনি শুধু বিহারে কজন বাংলাদেশি আর রোহিঙ্গা পাওয়া গেল সেই হিসাবটা করে রাখেন। আমি আসছি।
কাগজের ঠোঙ্গায় বেগুনি আর সিঙ্গারা নিয়ে এলাম। তারুকাকাকে বলে এলাম, দুটো চা পাঠিয়ে দিতে। এসেই আবার চটাদার দিকে তাকিয়ে বললাম – এবার বলুন।
– সাংবাদিক সম্মেলনে ওনারা কী বললেন?
– ওনারা বার বার প্রসঙ্গ পালটে পালটে অন্য কথায় চলে যাচ্ছিলেন। শেষে একজন দিল্লির সাংবাদিক যখন প্রশ্ন করলেন, আপ লোগোঁ কে পাস তব কোই আঁকড়ে নহি হ্যায় ক্যায়া, তখন চিবিয়ে চিবিয়ে জ্ঞানেশ কুমারজি বললেন, অব তক নহি!
– তার মানে তো দাঁড়ায়, যাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে, সকলেই ভারতীয়!
– তাই তো দাঁড়ায়।
– আসামেও ভারতীয়দের নাম কেটে বিদেশি বানিয়েছিল। বিহারেও কি সেটাই করতে চলেছে?
– তাই মনে হচ্ছে। তবে আসামে বাধা পায়নি। এবারে ভয়ঙ্কর বাধার মুখে পড়েছে। পদ্ম রাজারা এখন অন্য একটা মুদ্দার হুজুগ তুলে এদের বাঁচানোর চেষ্টা করবে বলে মনে হচ্ছে!
– দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়।
সাইকেলে যখন ফিরছি, মনটা খুব খারাপ। জীবনে এই প্রথম দেখলাম, চটাদার থিসিস দাঁড়াল না। পদ্মভোট কমিশন প্রচুর মেহনত করে কয়েকটি রাজ্যে পদ্মভোটারের সংখ্যা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দিয়েছে। আর রোহিঙ্গা বাংলাদেশি খোঁজার নামে বিহারে লক্ষ লক্ষ সহি ভারতীয় ভোটারের নাম কেটে দিয়েছে। যার কোনো ব্যাখ্যা ওরা দিতে পারছে না!!