পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে...

  • 20 July, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 847 view(s)
  • লিখেছেন : ঋষি ঘোষ
পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণা থেকে শুরু হয়ে গণনা শেষ অবধি, হিংসার অনেক ঘটনা শোনা গেছে, কিছু কিছু খবর হয়েছে, কিছু হয়নি, সেইরকম একটি ঘটনার একটি অংশ দেখা গেল, এই প্রতিবেদনে। দেখালেন ঋষি ঘোষ।

"আমাদের হাতে পায়ে মাঠঘাটের কাদা,মুখে মঞ্চের আলো,আঙুলে ভোটের কালি।দূর থেকে দেখি,আমাদের ধর্ম আর রাজনীতি অধর্মের পা ধরে আছে।"

                                  উপন্যাস 'ত্রিস্তর'(২০০৮) - রাজর্ষি দাশ ভৌমিক

 

ঐ যে তরুণ,শুয়ে আছে বিডিও অফিসের সরু বেঞ্চে, যাঁর ব্যান্ডেজবাঁধা মাথা সদ্যবাঁধা বোমার মতো-ও টেবিলে টেবিলে চা দেওয়ার অর্ডারটা পেয়েছিলো...ঐ যে মাস্টারমশাই, প্রিসাইডিং অফিসার যাঁর নাম, ভোটের ডিউটিতে বেরোনোর আগে আট বছরের মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বারবার সেলফি নিতে থাকেন; কিংবা ঐ যে মুখে গামছা জড়ানো মাঝবয়সী, নিরাসক্ত ভঙ্গিতে খইনি ডলতে ডলতে যিনি বলেন-"বলে দিয়েছে, ইশারা করলে ভিড়ের দিকে আটটা ফায়ার করতে হবে। দু নম্বরি মুঙ্গেরি তামাঞ্চা...তিন রাউন্ডের পর এমন গরম হয়ে যায়, হাতে ধরে রাখা যায় না। ফেটে গেলে আমিও মরতে পারি-কি করে বলবো কার গায়ে লাগবে? এর জন্য পাঁচ হাজার দিবে-ছেলেটার কিডনির অসুখ, রাজি না হয়ে উপায় কি?" এরা সবাই সেই বিয়োগান্তক নাটকের কুশীলব, যার সুতো ধরা আছে রাষ্ট্রের হাতে।

ইংরাজিতে 'এক্সলটেশন অফ এন্ডস ওভার মিনস' বলে একটা কথা আছে- এখানে সবাই এক বিরাট চক্রের অংশ হিসাবে সেই শেষটা দেখার অপেক্ষাই করে চলেছে, তার পদ্ধতিটা নিয়ে কেউ ভাবিত নয়। এই না-ভাবনার জগতে হারিয়ে যাওয়াটুকুই আমাদের সঙ্গী থেকে যায়।

তিনটে পোলিং বুথ একই স্কুল ক্যাম্পাসের মধ্যে। বোমাটা ফাটানো হয়েছিলো মাঝখানের ফাঁকা মাঠে, কাউকে আঘাত করা নয়, ভিড় কাটিয়ে দেওয়াই ছিলো প্রধান লক্ষ্য। অন্যান্য ভোটকর্মীদের সঙ্গে সেও দরজার আড়ালে আশ্রয় নিয়েছিল। সঙ্গে থাকা দিশেহারা নিরাপত্তারক্ষীটি ততোক্ষণে প্রায় শাসানির সুরে পরিস্কার বলে দিয়েছে, "স্যর,নিজেরা নিজেরা ম্যানেজ করবেন। কোনো ঝামেলায় আমায় ডাকবেন না"। সে বোঝে, কিছু কিছু ক্রোধ ভয় আর অসহায়তা থেকেই আসে। তাঁর ফোন ঘনঘন বেজে চলে-সে অসহায়ভাবে নিজের অক্ষমতাটুকু জানিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। ফুল, ফল, নৈবেদ্যর সামনে পাথরের মূর্তি যেমন অসহায়-সে জানে তার পুজো হবে; কিন্তু শোকতাপটুকু শুনে যাওয়া ছাড়া সে আর কিচ্ছুটি তার হাতে নেই! সে গালভরা নামের সেক্টর অফিসার-সে নৈবেদ্যর উপরের দুর্গামণ্ডা-কোন কাজে লাগে না,তবু তাকে রাখা হয়; তাকেও অবহেলার ফুল ছুঁড়ে দেওয়া হয়।

হঠাৎ চোখ পড়ে বুথের এক্সিট দরজাটার দিকে...একটা ছোট্ট ছায়া ঘোরাফেরা করছে! চমকে উঠে সে দেখে, সেই বাচ্চাটা না! মায়ের কোলে চড়ে এসেছিলো...মজা করে পোলিং অফিসার তার ছোট্ট আঙুলে লাগিয়ে দিয়েছিলেন ভোটের কালি। হুড়োহুড়িতে মা ছিটকে গেছে কোথাও-নাকি আরো খারাপ কিছু! বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে তাঁর। শুনশান বুথে পোলিং আর সেক্টর অফিসার গলা যথাসম্ভব নিচুতে রেখে ডাকতে থাকেন বাচ্চাটাকে। একটা মৃদু ফোঁপানি...একটা হালকা "মা মা" ডাক-বাচ্চাটা এইসব অচেনা ডাকে ভ্রূক্ষেপও করে না, এলোমেলো পায়ে ঘুরতে থাকে।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর 'কলকাতার যিশু' কবিতায় কলকাতার ব্যস্ত ট্রাফিককে স্তব্ধ করে রেখে একটি উলঙ্গ শিশুর রাস্তা পার হওয়াকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রেখেছেন। সেখানে সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দে সমগ্র বিশ্বকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার বিশ্বাসটুকু নিহিত ছিলো। আর এই মেঘচাপা শ্রাবণের দুপুরে, বুথের 'বাহির' লেখা দরজা দিয়ে শিশুটির একাকী বেরিয়ে আসা...এ তো আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়ানো, তবে তাতে বুকের মাঝে কোন বিশ্বলোকের সাড়া নেই। সরকার আর দল যখন এক হয়ে যায়, তখন সিস্টেমের নির্লজ্জ নিষ্ঠুরতা আর প্রতিকারহীন স্বার্থপরতা গণতন্ত্রকে,স্বাধীন মত প্রকাশের ন্যূনতম অধিকারকে এভাবেই দরজা দেখিয়ে দেয়।

ছোট মানুষ সিল্যুয়েটে দীর্ঘ ছায়া ফেলে গুটিগুটি পায়ে দরজা পার হয়ে বারান্দার দিকে এগোতে থাকে-বাইরে পলায়নরত পায়ের শব্দকে ঢেকে দেয় সেন্ট্রাল ফোর্সের ভারি বুটের আওয়াজ। মারামারি, বুথ জ্যাম ,ছাপ্পা, রক্তপাত আর হিংসার ছবিতে তার মেমোরি উপচীয়মান-এতোক্ষণে একটা মনমতো ফ্রেম তার সামনে পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো হাজির হয়! সন্তর্পণে মোবাইল বের করে ক্যামেরা তাক করে সে...

 

0 Comments

Post Comment