শেষবার রেল পুলিশের খপ্পরে পড়েছিলাম ২০০৫ সালে, উত্তর প্রদেশের কানপুর শহরের কাছে ফাফুন্দ নামক একটি স্টেশনে। তখন ট্রেনে সিগারেট খাওয়া যাবে না কিন্তু প্ল্যাটফর্মে যাবে, বা সেটাও বেআইনী, এইসব নিয়ে নানা রকমের তর্ক ছিল, কেউই জানতো না প্ল্যাটফর্মে সিগারেট খাওয়া বেআইনী কি না। তো এহেন সময় ডাউন পূর্বা এক্সপ্রেস ট্রেন সিগন্যাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় নিচে নেমে সিগারেট ধরিয়ে কয়েকটা সুখটান দেওয়ার পরেই পিছনে টোকা, ঘুরে দেখি রেল পুলিশ (সরকারি রেল পুলিশ বা জিআরপি যা রাজ্য সরকারের অধীনে) এবং তাঁরা আমায় কোনো ভাবেই ছাড়বে না। শেষ পর্যন্ত অনেক তর্ক আর অনুরোধের পরে ৫০ টাকায় মিটমাট হল। তারপর থেকে রেলপুলিশ ধরেনি, আর সিগারেট খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছি বহুবছর। তবে তবুও ট্রেন যাত্রায় একটা ভীতি থেকে গেছে। একটা এমন ভয় যেটা নিয়ে আমি এবং “আমরা” যাদের ভারতবর্ষে “ওরা” করে দেওয়া হয়েছে কাউকেই মুখ খুলে বলতে পারি না।
বাল্যকালে আর কিশোর বেলায় ট্রেন যাত্রা মানে ছিল আমাদের আসানসোল শহর থেকে বিধান এক্সপ্রেস (অগ্নিবীণা) ধরে হাওড়া আসা আর কোলফিল্ড এক্সপ্রেস ধরে বাড়ি ফেরা। সাথে অবশ্যই বড় কেউ থাকতেন, এবং ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত একা যাত্রা করিনি। আর তখন যে ভয়টা ছিল সেটা দুটি বিষয় নিয়ে ছিল। প্রথমত, নয় দশকের মধ্য ভাগে, সেই সময় রাজ্যে ট্রেনে ডাকাতি খুব হত। সেই ইন্টারনেটের আগের যুগে আমাদের মতন ছোট্ট শহরের অচেনা-অজানা মানুষগুলোর বিশ্বদর্শনের একমাত্র অবলম্বন ছিল খবরের কাগজ। আর সেই কাগজে আসতো ট্রেন ডাকাতির ঘটনা। রাজনীতির যখন কিছুই বুঝতাম না তখন, সেই ১৯৯৭ কিংবা ১৯৯৮ সালের কাগজে পড়েছিলাম যে নকশাল নেতা কানু স্যানালকেও নাকি তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেসে ডাকাতেরা কুপিয়েছিল। তো সবসময় সেই চলন্ত ট্রেনে ডাকাতি হওয়ার ভয় মনকে যাত্রাপথে তাড়া করতো। দ্বিতীয় ভয় ছিল নিত্যযাত্রীদের উৎপাতের। সেই সময় সংরক্ষিত আসনে খুব কম লোকেই যেতেন আর আমি বা আমার পরিবারের লোকেরা অসংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণীতেই যাতায়াতে অভ্যস্ত ছিলাম। সেই সময়ে নিত্যযাত্রীরা “এই সিট আমাদের” বলে লোকজন কে জোর করে উঠিয়ে দিত, ভয় দেখাতো আর কখনো মারামারিও হত। তাই সেই ভয় বর্ধমান অবধি তাড়া করতো।
কিন্তু ছোটবেলার অন্ধকারের ভয় আর বড় বেলার অন্ধকারের ভয়ের মধ্যে তফাৎ হয়। সেই ২০০৩ সালে, ২১ বছর বয়সেই পেটের টানে বাড়ি ছেড়ে রওনা দিই রাজধানী দিল্লী। তখন দিল্লী যাওয়ার অনেক ট্রেন ছিল, আর সবার উপরে ছিল রাজধানী এক্সপ্রেস। কিন্তু তার ভাড়া, তখন ১,৩৫০ টাকা থার্ড এসিতে, আমার সাধ্যের বাইরে। ফলে আমি যেতাম পূর্বা এক্সপ্রেসে। সকাল ১০.৪৫-এ আসানসোল থেকে ছেড়ে পরের দিন সকাল ৮.১৫ নাগাদ নয়া দিল্লী পৌঁছে যেত। দীর্ঘদিন এই রুটে আমি শুধু স্লিপার ক্লাসেই ভ্রমণ করেছি। তারপরে, যখন একটু টাকা জমাতে পেরেছিলাম, তখন, সেই ২০১০ সাল থেকে আমি রাজধানী এক্সপ্রেসও চাপা শুরু করি, তবে নিয়মিত নয়। কারণ নিতান্ত চাপে না পড়লে অত টাকা খরচ করে বাড়ি আসা আমার কাছে বিলাসিতাই ছিল।
কিন্তু পরিস্থিতিটা ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করলো। সহযাত্রীদের কথাবার্তাও পরিবর্তন হওয়া শুরু হল। যখন ২০০২-এর গুজরাটে হওয়া মুসলিম গণহত্যার রেশ রয়েছিল বাতাসে, তখন আমি ট্রেনে খুব একটা সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা শুনতাম না। মুসলিম বিদ্বেষী কথাবার্তাও মানুষ মুখ খুলে সামনে বসে বলতো না। অনেকের মধ্যে মুসলিমদের প্রতি সাম্প্রদায়িক ঘৃণা থেকে থাকলেও, বেশির ভাগ মানুষকে আমি সেটা কথায় প্রকাশ করতে দেখিনি। কিন্তু ২০১৬ সালের পর থেকে সব পরিবর্তন হওয়া শুরু হল। তখন সহযাত্রীদের অনেকেই আর সাম্প্রদায়িক কথা বলতে সংকোচ বোধ করতেন না। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাড়ি ফেরার সময় পূর্বা এক্সপ্রেসের স্লিপার কোচে শুনেছিলাম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নাকি একবার রাজ্যে জিততে পারলে কী ভাবে “পাংচারওয়ালা মুসলিমদের ফুটো ঠিক করে দেবে” জাতীয় কথা। তখন আমি একা নই, শহরে রয়েছে আমার স্ত্রী আর ছোট্ট পুত্র। ফলে প্রথমবার আতঙ্কিত হলাম। সেই বছরেরই শেষের দিকে আবার ট্রেন যাত্রার সময় দেখি সহযাত্রীদের মধ্যে কয়েকজন নির্দ্বিধায় স্মার্টফোনে এমন সব ভিডিও দেখছেন, তাও বিনা হেডফোনে, যাতে জোরে জোরে মুসলিমদের সাথে সন্ত্রাসবাদ কে এক করে কোনো ধারাভাষ্যকর দেখাচ্ছিলেন।
এই পরিবর্তন আমায় চিন্তিত করলো। ২০১৪ সালের মোদীর উত্থান ও ভারতে অতি-দক্ষিণ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মূলস্রোতে আসার সাক্ষী আমি। ২০১৫ সালের প্রথম গো-রক্ষা সংক্রান্ত হিংসায় মোহাম্মদ আখলাক-এর মৃত্যুর পরে উত্তর প্রদেশের নয়ডার কাছে দাদরিতে তাঁর গ্রামেও গেছিলাম আমি। কিন্তু আমি যে নিজে গো-রক্ষকদের মাঝেই যাতায়াত করছি সে কথাই বারবার মনে হতে থাকলো। আমরা মুসলিমেরা সর্বদাই হালাল মাংস নিয়ে সংশয় থাকার কারণে রেলের মুরগির ঝোল খাই না এবং বেশির ভাগই নিজের খাবার নিজে নিয়ে যাত্রা করি। তবুও আমার অভিজ্ঞতায় খুব কম মুসলিমকেই আমি ট্রেনে বাড়ি থেকে আনা মাংস বা মুরগি খেতে দেখেছি। এর কারণ ছিল সহযাত্রীদের মনে কোনো ধরণের সংশয় না তৈরি করা আমাদের মাংসের উৎস নিয়ে। কিন্তু তবুও আমরা অনেকেই মাংস বা মুরগি বাড়ির থেকে নিয়ে যেতাম ও রাস্তায় খেতাম, তবে কখনোই গরুর মাংস নয়।
কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে সেই মাংস বা মুরগি নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, আমি ডিমও নিয়ে যাইনা ট্রেনে। কারণ তখন একের পর এক জায়গায়, বিশেষত উত্তর প্রদেশে গো-রক্ষার নামে মুসলিমদের পিটিয়ে মারা হচ্ছে, সব জায়গায় নাকি মুসলিমদের টিফিন কৌঁটো থেকে গরুর মাংস উদ্ধার হচ্ছে। এর মধ্যে দিল্লী আর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে যাত্রাপথে অধিকাংশ সময় যেহেতু উত্তর প্রদেশে কাটাতে হয়, সেখানে আবার তখন নতুন হিন্দু হৃদয় সম্রাট ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন, ফলে আমি বেশির ভাগ সময় হয় রাজধানীতে যেতে শুরু করি যাতে খাবারটা ট্রেনেই পাওয়া যায়, আর না হলে বাড়ির থেকে রুটি বা লুচি তরকারি নিয়ে যাত্রা শুরু করি। আর এই ২০১৭ সাল থেকেই দেখলাম ট্রেনের ভিতর সহযাত্রীদের অনেককেই একটু পাল্টে যেতে।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে সস্ত্রীক বাড়ি ফিরছি, সাথে এক বছরের শিশুপুত্র। ছোট্ট ছেলের তখন সবে কথা ফুটেছে আর আমাকে আব্বা বলে ডাকা শুরু করেছে। ট্রেনটির নাম দুরন্ত এক্সপ্রেস হলেও, সে মোটেও সেরকম দুরন্ত গতিতে ছুটছিল না। থার্ড এসিতে সাইড লোওয়ার ও সাইড আপার বার্থ আমাদের। প্রথম লম্বা ট্রেন যাত্রা বাচ্চাটা উপভোগ করছিল কিনা জানা যাচ্ছিল না তবে বারবার সে আমাকে আব্বা বলে ডাক দিচ্ছিল। আর তখনই দেখলাম পাশের বার্থের ছয় জনের মধ্যে অন্তত দুইজনের একটা বিদ্রুপ মূলক চাওনি। আপার বার্থের ভদ্রলোক ভাষায় বাঙালি হলেও ভুলভাল ব্যাকরণ ব্যবহার করে বিরক্তিকর হিন্দিতে কথা বলছিলেন তার মিডল বার্থের সহযাত্রীর সাথে। আর তাতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কিছু সরাসরি না বললেও কেন যোগী আদিত্যনাথ উত্তর প্রদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী ও কী ভাবে তাঁর আমলে আইনের শাসন বহাল হবে, কী ভাবে "মাথায় চড়ে বসা" দুষ্কৃতী দমন হবে আর হিন্দুদের খুব উপকার হবে সেই সব "তথ্য" ছিল। আর উঠতে-নামতে আপার বার্থের ভদ্রলোক বারবার আমাদের বার্থের সামনে দাঁড়িয়ে একবার করে জয় শ্রী রাম অবশ্যই বলছিলেন।
এই যাত্রার পরে, কোনো ট্রেনে টিকিট না পেয়ে দিল্লী ফিরছিলাম যুবা এক্সপ্রেসে। সেই সময় শ্রাবণ মাস উপলক্ষে আসানসোল থেকে প্রচুর পুণ্যার্থী শিবের মাথায় জল ঢালতে দেওঘর যাচ্ছিলেন। ফলে প্ল্যাটফর্ম লোকে লোকারণ্য ছিল রাতের বেলায়। এর মধ্যে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করছি সেখানে আমার ছেলে বারবার আব্বা - আব্বা বলে চিৎকার করায় সবার বাঁকা দৃষ্টি পড়ছিল। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। এই দিকে আমরা বসে আর চারদিকে পুণ্যার্থীরা। অন্য সময় হলে এদের সাথে আমার কোনো সমস্যা হত না, কিন্তু ২০১৭ সালে, সেই সময়, সারা ভারত জুড়ে বৃদ্ধি পাওয়া সাম্প্রদায়িক ঘৃণার পরিবেশে দাঁড়িয়ে নিজের ছেলের জন্যে তখন ভয় করছিল। এই ভয়টাই তারপরে, ধীরে ধীরে আরও বৃদ্ধি পেল।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বর্তমানে রাজ্য সরকারের মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়-র নেতৃত্বে এক বিরাট সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটে আমাদের শহর আসানসোলে। যে শহরে ১৯৯২ সালের পরে কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়নি। তখনকার হিংসার ঘটনাও রেল স্ট্রেশন লাগোয়া রেল পাড় অঞ্চল ছিল, যেখানে প্রচুর মুসলিম বাস করেন। এই সময় আমি আসানসোল আসি খবর করতে আর দেখি ট্রেনের ভিতরের আলোচনা পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সরাসরি “ওদের টাইট” দিতে হবে গোছের কথাবার্তায়। না, এটা অবাঙালি, উত্তর প্রদেশের বাসিন্দারা না, বলেছিলেন এক বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার, যিনি কর্মসূত্রে নাকি দিল্লীতে থাকতেন। আমার নাম যেহেতু জানাইনি, শুধু সাংবাদিক শুনে এই কথা বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন যে মমতা বন্দোপাধ্যায় কে এই “তোষণের রাজনীতি” করার "মূল্য পরিশোধ" করতে হবে। তাঁর কথায় সায় দিলেন পাশের এক প্রৌঢ়। সম্ভবত তখন ষাটের কোঠায় তাঁর বয়স। তাঁর আক্ষেপ যে মুসলিমদের মধ্যে ভীষণ ঐক্য, তাই ওরা কথায় কথায় অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, কিন্তু হিন্দুদের সেই ঐক্য নেই, ফলে তাঁরা নাকি সব জায়গায় আক্রান্ত। তাঁর দাবি হিন্দুদের শৈশব থেকে “মুসলিমদের মতন” অস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং দেওয়া হোক। আর এই কথা তিনি ফিসফিস করে বলছিলেন না, জোর গলাতেই বলছিলেন। তাঁর কাছে ধর্মীয় পরিচয় গোপন রেখে তথ্য নিয়ে হিন্দুদের আক্রান্ত হওয়ার মিথ ভাঙার চেষ্টা করতে গেলেই তিনি বলেন “আপনাদের মতন সেকুলারিজমের কথা বলা লোকেদের জন্যেই দেশের এই ক্যান্সার বেড়েছে।”
এই আলোচনার পরে আর আসানসোলের হিংসার ঘটনার পরে আর সপরিবারে ট্রেনে আসতে সাহস পাচ্ছিলাম না। আত্মীয় স্বজন কেউই ট্রেনে লম্বা সফরে গেলে আতঙ্কিত হওয়া শুরু করলাম তাঁদের সুরক্ষা নিয়ে। নিজেকে নিয়ে কোনোদিন ভয় পাইনি, কিন্তু যখনই মনে পড়েছে যে ২০০২ সালের গুজরাটে, ২০০৮ সালে কন্ধমালে, ২০১৩ সালে মুজফ্ফরনগরে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা কী ভাবে নারী ও শিশুদেরও রেয়াত করেনি, তখন ভয়টা পেয়েছি পরিবার কে নিয়ে। আমার মনে একটা মিথ ছিল যে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা নেই। তবে সে মিথ ভেঙেছিল যখন ২০১৫ সালে কয়েক মাসের জন্যে কাজের জন্যে কলকাতায় থাকতে এসেছিলাম আর বাড়ি ভাড়া খুঁজছিলাম। মুখের উপর সেই সময়ে স্পষ্ট বলে দেওয়া হত “বাঙালি এলাকা” তাই নাকি “মুসলিমদের ঘর ভাড়া দেওয়া যাবে না”। কিন্তু এর পরে দেখলাম, পশ্চিমবঙ্গের ট্রেনেই এক মৌলানা কে হেনস্থা হতে হল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের লোকের হাতে। এক বান্ধবী, যিনি মাদ্রাসায় পড়ান, বারবার উল্লেখ করেন কী ভাবে উত্তরবঙ্গের ট্রেনের কোচে, বিশেষ করে ২০২১ এর নির্বাচনের আগে ও পরে তিনি শুনেছেন মুসলিম বিদ্বেষী কথাবার্তা আর সারা রাত আতঙ্কে নিজের বার্থে ঘুমাতে পারেননি।
তবে ঘটনা হল এই দেশের সাম্প্রদায়িক হিংসারও একটা শ্রেণী চরিত্র আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যাঁরা মারা যান বা যাঁরা আক্রান্ত হন তাঁরা প্রান্তিক মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ। আমার মতন প্রিভিলেজ তাঁদের নেই। ফলে দিল্লীর যে জামিয়া নগর অঞ্চলে আমি থাকতাম, যাকে ইংরাজীতে বলে ঘেটো, সেখানে জাকির নগর, বাটলা হাউজ, ওখলা বিহার, শাহীনবাগ, জহুরি ফার্মস, প্রভৃতি এলাকায় কয়েক লক্ষ মুসলিম বাস করেন। আর তাদের বাইরের বৃত্তে রয়েছে গরিব মুসলিমদের বসবাস আর কেন্দ্রে রয়েছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা। ফলে যে কোনো আক্রমণ প্রথমে ওই গরিব মুসলিমদের উপরে নেমে আসবে জেনেও তাঁদেরই আমরা কোরবানির পশুর মতন নিজের স্বার্থে উৎসর্গ করতে হয়তো বিনা সুরক্ষায় রেখেছি। তেমনই, এই আতঙ্কের পরিবেশে যাতে আমার পরিবারের, আমার পুত্রের কোনো ক্ষতি না হয়, সেই কারণে বারবার আমি টাকা খরচ করেছি। থার্ড এসির থেকে সেকেন্ড এসি, বা প্লেনে যাতায়াত শুরু করেছি লম্বা যাত্রা এড়াতে বা বেশি ভিড় এড়িয়ে যেতে।
২০১৯ থেকে বেশির ভাগ সময় পরিবার কে নিয়ে হয় প্লেনে না হয় সেকেন্ড এসিতে চাপা শুরু করলাম যদিও আমার আয় এই বছরগুলোতে একদমই বাড়েনি। বারবার অনেকে প্রশ্ন করতো যে এত টাকা কেন খরচ করছি। আমি অনেককেই জবাব দিতে পারতাম না। ২০২০ সালের লকডাউনের সময় “করোনা জেহাদ” তত্ত্ব ব্যবহার করে মিডিয়া মুসলিমদের এই রোগ ছড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত করে। তখন সেলুন বন্ধ থাকায় আমার দাড়ি হুহু করে বেড়ে গেছে। এর মধ্যে ট্রেন চলা শুরু হতেই বাড়ি ফিরতে চাইলাম একা। আর তখন সবাই মানা করলো ট্রেনে যেতে কারণ বারবার নাকি আমাদের দেখে লোকে “করোনা, করোনা” বলে উত্যক্ত করছে তখন। অনেক মাস পরে বাড়ি ফিরলাম, তবে আবার প্লেনে। অনেক টাকা বেশি খরচ করে যাতে বাড়ির লোক টেনশনে না থাকে ২৪ ঘন্টা। সেই বছরই—২০২০ সালের ডিসেম্বরে— প্রথম রাজধানীর ফার্স্ট এসিতে চড়া শুরু করলাম। আর সেখানে আলাপ হল সংসদে কর্মরত এক বাঙালি আমলার সাথে, যিনি পুরো রাস্তা আমায় শোনালেন কেমন করে শুভেন্দু অধিকারী রাজ্যে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসবেন। আর মুসলিমেরা একজোট হয়েও এবার—২০২১ সালের নির্বাচনের প্রেক্ষিতে—বিজেপিকে আটকাতে পারবে না।
এই ঘটনার পরে ভাবলাম যে স্লিপার থেকে থার্ড এসি হয়ে ফার্স্ট এসি অবধি নিজের পরিবারের নিরাপত্তা খুঁজতে হাজার হাজার টাকা খরচ করেও সেই ইসলামবিদ্বেষ আর পিছু ছাড়ে না। যখনই ট্রেনের টিকিট চেকার এসে জানতে চান কী নামে রিজার্ভেশন আছে, তখন নামের বাংলা অংশটুকু বলি সপরিবারে চলার সময়। একা গেলে আতঙ্কটা কম থাকে, কিন্তু সেই সময় পরিবারের লোকেরা আতঙ্কে থাকে। আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে আমি যেন রাজনৈতিক ব্যাপার নিয়ে নিজের মত প্রকাশ না করি ট্রেনে, আমি যেন কারুর সাম্প্রদায়িক কটূক্তির বিরোধিতা না করি আর যেন কাউকেই নিজের সাংবাদিক পরিচয় না দিই। আর সবার উপরে আমার দাড়ির সাইজ বাড়লেই বাড়ির সবাই আপত্তি করে ওঠে, যে এতে আমারই ক্ষতি হবে। হাজি-নামাজী মুসলিম না হয়েও, শুধু নামের জন্যেই যে মারা যেতে পারি, সেটা বারবার বোঝাতে থাকে সবাই। সবার দাবি হল চুপ করে থাকা। অন্যায় বরদাস্ত করা, কারণ বাঁচতে হবে যে!
কিন্তু এভাবেও কি বাঁচা যায়। এই ধরুন কিছুদিন আগেই জয়পুর-মুম্বাই সেন্ট্রাল সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেসের একজন রেলওয়ে প্রটেকশন ফোর্সের (আরপিএফ) জওয়ান নিজের উর্ধতন অফিসার ও তিনজন মুসলিম কে বেছে বেছে চলন্ত ট্রেনে গুলি করে মারার ঘটনায় অভিযুক্ত হলেন। তাঁর নাম চেতন সিংহ। একটি ভিডিওতে, যার সত্যতা জিআরপি যাঁচাই করেছে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে, অভিযুক্ত কে দেখা গেছে ক্যামেরার দিকে পিঠ করে, মাটিতে কাতরাতে একটি রক্তাক্ত মানুষের দেহের উপর দাঁড়িয়ে মুসলিম বিদ্বেষী ভাষণ দিতে ও মোদী এবং যোগীর জন্যে মানুষকে ভোট দিতে বলতে। অভিযোগ উঠেছে যে তিনি নাকি বেছে বেছে, পোশাক আর দাড়ি দেখে মুসলিমদের হত্যা করেছেন থার্ড এসিতে, প্যান্ট্রি কারে আর স্লিপার কোচে।
সিংহ যাঁদের হত্যায় অভিযুক্ত তাঁরা হলেন আব্দুল কাদেরভাই মোহাম্মদ হোসেন ভানপুরওয়ালা (৪৮), যিনি আদতে জয়পুরের বাসিন্দা হলেও ব্যবসার জন্যে পালঘরের কাছে নালাসোপাড়ায় থাকতেন, সাদার মোহাম্মদ হুসেন (বয়স জানা যায়নি), যিনি প্যান্ট্রি কারে কাজ করতেন বলে দাবি করা হয়েছে, এবং আসগার আব্বাস শেখ (৪৮), যিনি আদতে বিহারের মধুবনীর বাসিন্দা হলেও নিজের ভাইয়ের কাছে জয়পুরে থাকতেন। ভানপুরওয়ালা মহরম উপলক্ষে বাড়ি গেছিলেন, ফিরছিলেন ট্রেনের থার্ড এসিতে। উনিও কি আমার মতন ভেবেছিলেন যে এসিতে নিরাপদে যাবেন? অন্যদিকে শেখ বহুদিন ধরে কারখানা বন্ধ থাকায় বেকার ছিলেন কিন্তু এবার কাজের খোঁজে মুম্বাই যাচ্ছিলেন। তাঁর এসিতে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাই স্লিপারে যাচ্ছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন জেনারেল কোচের থেকে ভাল ভাবে যাবেন। কিন্তু তাঁরও পৌঁছানো হল না।
ফলে, আমাদের নিরাপত্তা যে আসলে ট্রেনের কোনো শ্রেণীতেই নেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। তবুও আমরা যারা খরচ করতে পারি একটু নিরাপদে থাকতে ফার্স্ট এসিতে যাই, দাড়ি ছোট রাখি, কথা বেশি বলি না। কিন্তু যখন সেই ফার্স্ট এসির জানলা দিয়ে দেখি ট্রেনের জেনারেল কামরার দিকে ছুটে যাচ্ছেন সস্ত্রীক এক টুপি-দাড়িধারী মুসলিম, সাথে বোরখা পরা তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা, তখন ভয়ে প্রাণ কাঁপে। এরা কি নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাতে পারবেন? সেই ফার্স্ট এসির আয়নায় নিজেকে কিরকম কাপুরুষের মতন লাগে। টাকা দিয়ে নিজের নিরাপত্তা কিনে অন্যদের বিপদ কে অগ্রাহ্য করি কিভাবে? হয়তো সিংহ একজন ব্যতিক্রমী লোক, মানসিক ভারসাম্যহীন। কিন্তু তাঁর মুসলিম বিদ্বেষ, যা এখন জিআরপির খাতায় নথিভুক্ত হয়েছে, কি তাঁর মস্তিস্কপ্রসূত? তিনি কি কল্পনা করে এই ঘৃণার সৃষ্টি করেছিলেন না কি এটা পরিকল্পিত ভাবে তাঁর ও অসংখ্য অন্য মানুষের মাথায় বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা একটি প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেনের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে? আর সিংহ কি একা? নাকি তাঁর মতন অসংখ্য আততায়ী আমাদের চারপাশে ঘুরছে?
আমি হয়তো কিছুদিনের জন্যে নিজের আর নিজের নিরাপত্তা যাত্রাকালীন পর্বের জন্যে কিনেছিলাম। কিন্তু আমি বা অন্য মুসলিমেরা কি সব অর্থ ব্যয় করেও নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারবেন যদি ৮০% মানুষের মনে তাঁদের নিয়ে বিদ্বেষ ভরে দেওয়া হয় প্রতিদিন, নানা মাধ্যম ব্যবহার করে? আমার সুরক্ষার দায়িত্ব কি শুধু আমার? আর বাকি ৮০% এর কি কোনো দায় নেই আমার সুরক্ষা দেখার, আমার নিষ্পাপ বাচ্চাটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার? সিংহের মাইনের একটা অংশ তো আমরাও আমাদের আয়ের থেকে দিই, প্রধানমন্ত্রী থেকে সর্ব কনিষ্ঠ আমলাটির বেতনের টাকাও তো আমরা দিই। কই, এই ব্যাপারে তো আমাদের কোনো রেয়াৎ দেওয়া হয়নি। তাহলে কেন আমরা রাষ্ট্র চালানোর পয়সা দিয়েও বারবার অসুরক্ষিত হব? আক্রান্ত হব? আর আক্রান্ত হওয়ার পরে আমরাই দোষী চিহ্নিত হব? আমাদের রাস্তায় বের হওয়ার, আমাদের কাজে যাওয়ার আর নিরাপদে বাড়ি ফেরার দায়িত্ব কি রাষ্ট্র আর তার ৮০% নাগরিক এভাবে নিজের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে? এই প্রশ্নগুলোর জবাব হয় না। আমরা জানি, তাই আর জিজ্ঞাসা করি না।