পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

করোনার দিনরাত

  • 05 April, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1230 view(s)
  • লিখেছেন : আয়েশা খাতুন
সেই ঈদের পরে পরে গ্রাম খালি করে গ্রামের লোক চলে গেছিল প্রবাসে, কাজে। আজ লকডাউন হতেই সব ফিরে এসেছে ছুটি পেয়ে। যেন অসময়ের ঈদ গ্রামে।


রাত অনেক হলো। বিছানায় শুয়ে আছি। আমার মা ঘুমিয়ে গেছে।মায়ের ঘুমন্ত মুখখানি স্নিগ্ধতায় ভরে নেই। কী দুখিনী মুখ! আমার তো ঘুম আসে না। খোলা জানালা দিয়ে দেখা যায় আকাশ,দেখা যায় চাঁদ, ঝরতে দেখি উল্কা! ঘুম আসে না! বিছানকাটা নিয়েছে আমার। শুনেছি মরার আগে মানুষের বিছানকাটা নেয়।সে একবার ওঠে একবার শোয়। ভাবছি আমারো কি তাই!
ঘুম আসে না কিছুতেই। আর
আসবেই বা কেনো! আজ সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ির একটি তিন বছরের বাচ্চার গলায় চকলেট আটকে যায়। গ্রামে বাস,কোনো উপায় নেই। গলায় আঙুল দিয়ে বমি করানোর চেষ্টা, তার পর পিঠে জোরে থাপ্পড়। যদিও মনে হলো ঠিক হয়ে গেছে, কিন্তু বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়ছে,বাচ্চাটি ঘামছে।ভয় পেয়ে প্যাটেলনগর হাসপাতালে পাঠানো হলো। ডাক্তার পরিবহর কথা মনে পড়লো, সেদিন জানতে পেরেছিলাম সরকার এমন প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ১৪টি ডাক্তার রেখেছে আমাদের মতো গ্রামের মানুষের জন্য। কারণ ডাক্তারবাবুরা গণ পদত্যাগ করছিলেন। গুনেগুনে ১৪ জন।
আজ গিয়ে দেখা গেলো 'একা কুম্ভ রক্ষা করে নকল বুঁদীর গড়'
পাঠিয়ে দিলো সিউড়ি সদর হাসপাতাল। আমাদের গ্রাম থেকে প্রাইমারি হাসপাতাল ৮কিলোমিটার, সদর ২৮ কিলোমিটার। এদিকে লকডাউন, অন্যদিকে অন্ধকার আর দূরত্ব, পাশে ঘুমন্ত বাচ্চাটি জাগছে না।
যায় হোক সিউড়ি পৌঁছনো গেলো। বাচ্চাটি ভালো আছে।
কিন্তু ভাবনা অন্য জায়গায়।করোনাকে নিয়ে। করোনা এহেনো দরিদ্রের কাছে তেমন কোনো বড় বিষয় না। কত উলাওঠা,কত ডাইরিয়া,কলেরা,দুধেআলতা বসন্ত,কত ডেংগু,কত চিকুনগুনিয়া,কত নিপা পেরিয়ে এসেছে তার ইয়ত্তা নেই।
তায় এই সামান্য করোনা!
সত্যিই তাই,এগ্রাম সেগ্রামের সবে যুবক হওয়া ছেলেরা ড্রাইভারি করতে সারা দেশে ঘুরেছে কতদিন। সেই ঈদের পরে পরে বেরিয়ে গেছে। কতদিন পরে বাড়ি ফিরেছে।ওদিকে কিছু গ্রামে দশবছরের বাচ্চা পর্যন্ত গ্রামে থাকতে পায়না, তারাও রাজমিস্ত্রিদের সঙ্গে চলে যায় করনি ধরা শেখে।
কিছু হতাশা মাখা টাকা বাড়িতে এনে দেয়।তারাও ফিরেছে গ্রামে। কাজ নেইগো সরকার বলেছে। এখন করোনা দেশজুড়ে , তাই তালা মারা হলো। গ্রামে গ্রামে যেন ঈদ এসেছে। সত্যিই তাই।এতো সহজে এতো ছুটি!
কে কাকে কোয়েরেন্টাইনে থাকতে বলেছে! কী হাসি তাদের!
একটি ছেলেকে বললাম,
ঘরে থাক, বাইরে চরম বিপদ। ছেলেটি হেসে বললো, কি যে বলো,সেই সাত আট বছর বয়সে বাড়ির বাইরে চলে গেছি,তখন তো ঘর খুব ভালো লাগতো কিন্তু গরিবের আবার ঘর! মনিবের ছাগল চরানো, ঘাস কেটে আনা, ভারা ভারা জল আনা এই সব ছিলো খেলার সাথী। মাকে বলতাম,মা আজ যাবো না মনিবের ছাগল চরাতে।মায়ের কী রাগ! বলতো বাপের কি ময়রস বাধা আছে? যি ঘরে বসে খাবি?
আজ আবার ঘরে থাকতে বলছো! হা হা ঘরে কি আর থাকা যায় গো!
ভাবছি খুবই ঠিক বলছে। দেখছি তাদের মেলামেশা,উদার কোলাকুলি। মোড়ের মাথায় বসে তাস খেলা আড্ডা দেওয়া। তেরঙ্গা চাবানো, যেমন করে রিত্তিক রোশন খায়।
মোটরবাইকে তিনজন চারজনের উড়ে যাওয়া,বোতাম খোলা সীনা। ছেলেরা এখন ৫৬" ছাতির মালিক!কিসের ভয়!
এদিকে পুলিশের ভারিক্কি খুব।মানুষ বড়ো বেয়াড়া, খালি উল্টো কাজ করে। ঘরে বললে বাইরে হাজির। ঘর ঢোকাতে মোটরবাইক কেড়ে থানার চত্বর ভরতি করেছে কিন্তু মানুষ মুক্ত পথ করতে পারছে না। ক্লাবে তালা দিয়েছে সম্পাদক মহাশয়। ছেলেরা ক্যারমবোর্ড নিয়ে গাছ তলায় ভিড় জমিয়ে বেট ধরেছে' এবার পালা আমার।' ওদিকে নামাজিদের বড়োবারান্দায় ভিড়।মসজিদে মসল্লি যাওয়া এখন বারণ তাই।
ভাবছি,এবার কী হবে? মাঠে মাঠে বরোচাষ করেছে,ময়ুরাক্ষী নদীর জল দিয়ে। এক নিড়ানি হয়ে গেছে।ধানের গুছির পাশে যত আগাছা ভিড় করে আছে।এখন তো দুনিড়ানির সময়। মাঠে জল ছলবল করছে। মুনিশ নেমে গেছে মাঠে।হাঁটু ভেঙে বসে মাথার পাগড়ি নাড়িয়ে দুনিড়ানি দিয়ে যায় ভোরভোর দল বেঁধে।
ধানের পাতা চ্যাপ্টা হয়েছে,
মাঝড়া পোকা উড়ে আসছে, সেপাতায় বিষ ঢালতে। এদিকে সে ধানের গাছে এসেছে ভ্রূণ,এইতো সবে ঝিল্লির চাদরের বিছানায় গা এলিয়ে কচি ধানের থর ঘুমাচ্ছে।এই ভ্রূণ না বাঁচাতে পারলে আগড়া পড়ে যাবে।খাবে কী! হোক বিষ তবুও তো ধান দেখা যাবে।চাষিরা তাই বিষ ছড়াচ্ছে দিন ডুবু ডুবু বেলায়।
এদিকে হীরাপুরের মঙ্গল হেমরম ফোন করে, দিদি আজ ১৫ দিন ঘরে আছি কাজপ্যাট নাইখো।রেশন সেটোও আলো না! কী খাবো!
ভাবছি কী করব। সারা বইকেলি আকাশে কোদালিমেঘে ভরা। ওদিকে দোয়েল আসে,আসে কোকিল, কাকেদের জ্বালাতন করতে কাঁঠাল পাতার ঝোপে, কাজললতা পাখি সেও কত ভয়হীন। এসে বসেছে আমগাছে। অনেক পাখিদের আনাগোনা। কাঠঠোকরার তুঁতেসবুজ ডানার পালক স্পষ্ট দেখা যায়। চড়াইদের ঝগড়া কতদিন পরে দেখা গেলো। একটুক চালের খুদ কতবার ঠোঁট দিয়ে ভাঙে! ভারি মজা। হাঁস মুরগি নেই গ্রামে আর।কবে যে ফ্লুর নাম করে কল্লা মুচড়ে মেরে দিয়ে গেছে আমাদেরই ভোটে জেতা পঞ্চায়েত প্রধান।তারপর সগুনা,শালিমার আরাম্বাগিদের রাজত্ব। তবুও জানেরার মা বার বার বলে গেছে মরার আগে জানেরাকে,শুনে রাক মা,মুরগির আন্ডা জান রেখে ঠেন্ডা।দিয়েলের কুলুঙ্গি তে পাড়বে আন্ডা।হিথাহুথা চারানার সিকি খুটে থাকবে বান্দা। ভুলিস না দুটো টিলি মুরগি মরগ ঘরে রেখতে।
সময়ে সময়ে জানেরার খাজুরে মরগ বাং দিয়ে বাজায় সময়ের ঘন্টা।এবার রাত ভেঙে যাবে, পেঁচা ডাকে,বাদুড়ের ঝটপটানি মনে করিয়ে দেয় ফের করোনার গান,এবার হয়তো পড়বে মিনারে আজান।জেগে আছি এখনো আমার ঘুম আসেনি।
রাত ঘুমায় রাতের সিথানে। মা ঘুমিয়ে আছে, আকাশের চাঁদ আছে জেগে। ভারতের নাক ডাকা শুনি।কী ক্লান্ত ভারত সারা বেলা করোনাকে কলমা পড়াতে।আমার ঘুম আসেনি এখনো।

0 Comments

Post Comment