পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য: মার্কসবাদের অতন্দ্র সেপাই

  • 22 October, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1733 view(s)
  • লিখেছেন : শুভেন্দু সরকার
অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের কাছে এস্টাবলিশমেন্ট বিরোধিতা নেহাত মুখের বুলি ছিল না; সে-ছাপ পড়েছে রামকৃষ্ণবাবুর সামগ্রিক জীবনচর্যায়, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক বিরল ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য— একইসঙ্গে আপসহীন ও সোচ্চার।      

  

অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য (১৯৪৭-২০২২) ছিলেন পুরনো ঘরানার অনুতাপহীন মার্কসবাদী- লেনিনবাদী। ১৯৬০-এর দশকে বিদ্যাসাগর কলেজ আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরিজি সাহিত্য নিয়ে পড়াকালীন তিনি শুধু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সি পি আই)-র ছাত্র সংগঠন, সারা ভারত ছাত্র ফেডারেশন (এ আই এস এফ)-এর সদস্যই ছিলেন না, বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতিও হন। ১৯৬৪/৬৫-তে ভিয়েতনামের ওপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কলকাতার উত্তাল ছাত্র আন্দোলনে রামকৃষ্ণবাবুর ভূমিকা ছিল দেখার মতো। অন্যদিকে,      ১৯৬৮-তে, যখন সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রর নেতৃত্বে ওয়ারশ চুক্তিবদ্ধ পূর্ব ইওরোপের অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ করল, তখন অনেকের মত রামকৃষ্ণবাবুও তা মেনে নিতে পারলেন না। এর জেরে প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতির পদ ছাড়েন তিনি। আবার, কেরলে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পর ১৯৭০-এর রাজ্য নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস-সি পি আই জোট বাঁধলে পার্টির সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্কের ইতি টানলেন রামকৃষ্ণবাবু। নির্বাচন-কেন্দ্রিক দলীয় রাজনীতি যে তাঁর ক্ষেত্র নয়— এ কথা বুঝতে তাঁর খুব দেরি হয়নি। কিন্তু মার্কসবাদে রামকৃষ্ণবাবু আস্থা হারাননি কোনোদিন। শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে গণসংগ্রাম ছাড়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে মুক্তি অসম্ভব— তা তিনি বিশ্বাস করতেন আমরণ। সেইজন্যে সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতে ভরসা চলে যাওয়ার পর রামকৃষ্ণবাবু স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন লেখালিখির জগৎ। নানা বিষয় নিয়ে অক্লান্ত গবেষণার পেছনে সর্বদা কাজ করেছে তাঁর একটাই উদ্দেশ্য— পাঠকের সামগ্রিক বৌদ্ধিক বিকাশ। রামকৃষ্ণবাবু জানতেন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্থায়ীত্বর পূর্বশর্ত হলো বৈজ্ঞানিক বিশ্ববীক্ষার বিস্তার। যুক্তিবাদ, অ-ধর্মীয় মনোভাব, বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, ইতিহাসবোধ— এসবের প্রসার যে সমাজের আমূল পরিবর্তনের জন্যে কতখানি জরুরি তা বিলক্ষণ বুঝতেন তিনি। তাই স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির বদলে রামকৃষ্ণবাবু বেছে নিয়েছিলেন এক দীর্ঘমেয়াদি নিরন্তর লড়াই। সে-কাজেই নিজেকে উজাড় করে দেন তিনি। অন্যভাবে বললে, রামকৃষ্ণবাবু ছিলেন কার্ল মার্কস-এর মতে “ব্যাপক অর্থে ঐতিহাসিক পার্টি”-র সদস্য (বন্ধু ফার্ডিনান্ড ফ্রাইলিগ্রাট-কে চিঠি, ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৬০)। দমনপীড়নের পর ১৮৫২-য় কমিউনিস্ট লিগ (১৮৪৭) ভেঙে যায়। মার্কস অচিরে বুঝতে পারেন, ইওরোপের তৎকালীন পরিস্থিতিতে সাংগঠনিক কাজকর্ম চালানোর চেয়ে ঢের বেশি দরকার তাত্ত্বিক পড়াশোনা। তাই ধীরে ধীরে তিনি ডুবে গেলেন অর্থনীতি নিয়ে গভীর তাত্ত্বিক গবেষণায়— যার চূড়ান্ত পরিণাম পুঁজি (খণ্ড ১, ১৮৬৭)। মার্কস ঐ চিঠিতে লিখেছিলেন, পরিবর্তিত অবস্থায় তাঁর গবেষণা আর লেখালিখিই ছিল শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থে বেশি উপযোগী। এ দিক দিয়ে দেখলে, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিছিন্ন থেকেও ব্যাপক ঐতিহাসিক অর্থে পার্টিরই কাজ করছিলেন তিনি।

রামকৃষ্ণবাবুর কাছে মার্কসবাদ ছিল এক অখণ্ড বিশ্ববীক্ষা— পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান আর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা যার লক্ষ্য। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, এ এক দীর্ঘ লড়াই যা অদূর ভবিষ্যতে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। পাশাপাশি, সমাজবদলের জন্যে রাজনৈতিক পালাবদলের চেয়ে বরং বেশি দরকার মানুষের মনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন— এমনই ছিল রামকৃষ্ণবাবুর বিশ্বাস। তাই আপাত-সঙ্গতিহীন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা স্বাদের ছোটো-বড় অজস্র লেখায় পাঠকের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চেতনার বিস্তার তিনি ঘটাতে চেয়েছেন অবিরাম। বলা চলে, রামকৃষ্ণবাবু বেছে নিয়েছিলেন দূরপাল্লার দৌড়— যেখানে সাময়িক হার-জিৎ নয়, বরং অক্লান্ত পরিশ্রমের পর অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছনো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

নিছক রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, মার্কসবাদকে রামকৃষ্ণবাবু আদতে মনে করতেন দর্শন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর কাছে অতীত ও বর্তমানকে মূল্যায়নের পদ্ধতি। মানুষের সমগ্র ইতিহাস যে প্রত্যক্ষ শ্রেণিসংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে দর্শনের বিপরীত দুই ধারা (বস্তুবাদ আর ভাববাদ)-রও লড়াই— তা বারবার মনে করিয়েছেন রামকৃষ্ণবাবু। এই ইতিহাসবোধ থেকেই প্রাচীন ভারতীয় বস্তুবাদী চার্বাক দর্শন নিয়ে তাঁর আকর্ষণ জাগে। পরে বৌদ্ধ দর্শন নিয়েও তিনি লেখেন। এছাড়া, সামগ্রিকভাবে বস্তুবাদ (প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য) ছিল রামকৃষ্ণবাবুর গবেষণার অন্যতম বিষয়। বলা বাহুল্য, মার্কসবাদের প্রতি আগ্রহ থেকেই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশ প্রসারিত হয়েছিল। তিনি বুঝতে পারেন, বস্তুবাদের এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফসল হলো মার্কসবাদ। একইসঙ্গে রামকৃষ্ণবাবু এও বিশ্বাস করতেন, দেশে যে বস্তুবাদী দার্শনিক ঘরানা প্রাচীনকাল থেকে প্রতিষ্ঠিত— তা নিয়ে আজকের মার্কসবাদীর সম্যক ধারণা থাকা দরকার। অতীতের সঠিক মূল্যায়নই তাকে পথ দেখাবে বর্তমানে।

রেনেসাঁস পরবর্তীকালে বুর্জোয়াশ্রেণির ক্ষমতাদখলের সঙ্গে সঙ্গে ইওরোপে যে যুক্তিবাদী ধ্যানধারণা প্রাধান্য পেয়েছিল— তা ছিল বস্তুবাদী দর্শনের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) থেকে দেনিস দিদেরো (১৭১৩-১৭৮৪) হয়ে অগস্ত কোঁৎ (১৭৯৮-১৮৫৭) পর্যন্ত ক্রমশ এগিয়ে চলে সেই ধারা। মনে রাখা দরকার, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনকালে ভারতে চালু হয় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা। সেই সুযোগে উনিশ শতকে নবযুগ আসে বাঙলায়। ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার থেকে শুরু করে সে-লড়াই বিশ শতকে স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত হয়েছিল। বিদেশি শাসকের থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি দেখা দিয়েছিল আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনেরও চাহিদা। বিশ্বাস জেগেছিল কমিউনিজমে। এই সামগ্রিক ঐতিহ্যকে মার্কসবাদীদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত।

উনিশ শতকের বাঙলার প্রগতিশীল ধারা নিয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন রামকৃষ্ণবাবু। রামমোহন, অক্ষয়কুমার দত্ত আর বিশেষত বিদ্যাসাগর নিয়ে তাঁর লেখালিখির ভরকেন্দ্র ছিল তাঁদের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি— যা দিয়ে তাঁরা লড়েছিলেন তৎকালীন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যুক্তিবাদী মনোভাব। দেখার ব্যাপার, একপেশেভাব নয়, রামকৃষ্ণবাবুর বিশ্লেষণে গুরুত্ব পেয়েছে দ্বান্দ্বিক বিচার। দেশ-কাল-পরিস্থিতির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একজন ব্যক্তি সমাজবদলের কাজ যে অনেকখানি এগিয়ে দিতে পারেন, এসব মনীষীর মাধ্যমে তা তুলে ধরাই রামকৃষ্ণবাবুর লক্ষ্য। এও মনে রাখা জরুরি: অতীতের মূল্যায়নে আটকে না-থেকে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার সেই ধারা যেন আজও অব্যাহত থাকে— পাঠকের মনে সেই বোধ জাগানোও ছিল রামকৃষ্ণবাবুর অন্যতম উদ্দেশ্য। তিনি স্রেফ অ্যাকাডেমিক গবেষক ছিলেন না। লেখাপড়ার জগৎকে রামকৃষ্ণবাবু মনে করতেন অন্যতম একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট।

রামকৃষ্ণবাবুর বিশ্বাস ছিল যে, মার্কসবাদ কোনো আপ্তবাক্য নয়; বরং তা হলো কাজের দিশারি। তাই দ্বান্দিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করে আর মূল লক্ষ্য (শ্রমিকশ্রেণির শাসন কায়েম) স্থির রেখে নতুন-নতুন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব। একইভাবে, তথ্যর ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা চলে অতীতের কোনো পর্ব; তুলে ধরা যায় শ্রেণিবিভক্ত সমাজের তৎকালীন ছবি। এভাবেই মার্কসবাদী সমালোচনা ও গবেষণার ভাণ্ডার ক্রমাগত সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। এই নিরিখে ভারতে পথ দেখিয়েছেন দামোদর ধর্মানন্দ কোসম্বী, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এঁরা সকলেই আলাদা-আলাদা ক্ষেত্রে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেছেন; নতুন আলো ফেলেছেন অতীতের ভারতীয় সমাজের ওপর। তাঁদের কাজও পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন রামকৃষ্ণবাবু। চার্বাক দর্শন নিয়ে তাঁর গবেষণা দেবীবাবুর কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে।

ভবিষ্যতের ব্যাপারে রামষ্ণবাবু ছিলেন সর্বদা আশাবাদী। সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র ও পূর্ব ইওরোপের বেশ কিছু দেশে সমাজবাদী কাঠামো ভেঙে পড়া অথবা চিনে পুঁজিবাদের অনুপ্রবেশ ঘটা সত্ত্বেও রামকৃষ্ণবাবু অন্য অনেকের মতো সমাজবাদ তথা মার্কসবাদে আস্থা হারাননি। বরং অতীতের নজির টেনে বারবার পাঠকের কাছে নিয়ে এসেছেন সুদিনের বার্তা। বিপ্লব একবার অসফল হলেই যে চিরকালের মতো সব শেষ হয়ে যায়— এমন নয়। বরং দেখা যায়, বিপ্লব আর প্রতিবিপ্লবের মধ্যে লড়াই বহুদিনের। বলা চলে, শোষণভিত্তিক সমাজব্যবস্থা যতদিন বহাল থাকবে বিপ্লবের সম্ভাবনাও বিলীন হবে না। তাই বিশেষত দুর্দিনে দরকার আরও বেশি বিচারবুদ্ধি সজাগ রাখা আর নতুন সুযোগের জন্যে অপেক্ষা করা। রামকৃষ্ণবাবু বলতেন, নানাভাবে সমাজবদলের জন্যে কাজ সম্ভব। নাটক প্রযোজনা, পত্রিকা ছাপা, গণসংগঠন চালানো, ইত্যাদি— সবই সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মানুষকে একজোট করে। তাই নিজের সাধ্য ও পছন্দ অনুযায়ী যে-কেউ তাতে হাত লাগাতে পারেন। রামকৃষ্ণবাবুর রাজনৈতিক কাজকর্মর ধারণা ছিল এতটাই ছড়ানো।

সাহিত্য সমালোচনা অথবা নন্দনতত্ত্বর এলাকাতেও রামকৃষ্ণবাবু একইভাবে প্রয়োগ করেছেন মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। দেশ-বিদেশের সাহিত্যকর্ম ও লেখককে (যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বের্টল্ট ব্রেশ্‌ট্‌, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ) দেখেছেন সেই চোখ দিয়ে। এছাড়া আছে পরশুরামের গল্প নিয়ে তাঁর মৌলিক ও মনোগ্রাহী গবেষণা। সবমিলিয়ে রামকৃষ্ণবাবুর বইয়ের সংখ্যা তিরিশের ওপর। এছাড়া আছে অগুন্তি অগ্রথিত প্রবন্ধ। বাঙলার পাশাপাশি ইংরিজি রচনাতেও তিনি ছিলেন সমান স্বাচ্ছন্দ্য। ইংরিজিতে বই চারটি।   

রামকৃষ্ণবাবুর লেখালিখির আলোচনায় তাঁর গদ্য সম্বন্ধেও বলা উচিত। সহজ সরল বাঙলায় তিনি হাজির করতেন তাঁর যাবতীয় বক্তব্য। ভাষা যেন পাঠকের সামনে বাড়তি বাধা তৈরি না-করে— সে-বিষয় থাকত রামকৃষ্ণবাবুর কড়া নজর। তাই লৌকিক শব্দ, ছোটো-ছোটো বাক্য আর উপমা তাঁর গদ্যে ঠাঁই পেত হামেশা। লেখার আঙ্গিকের বেলায়য়ও রামকৃষ্ণবাবুর রাজনৈতিক বোধ ছিল সমান সজাগ। এভাবেই তিনি লিখেছেন দর্শন আর কমিউনিজমের সহজ পাঠ। রামকৃষ্ণবাবুর চেতনায় যে গদ্যর একটি রাজনৈতিক মাত্রা ছিল, তা বোঝা যায় যখন তিনি আলাদাভাবে অরবিন্দ ঘোষ (পরে শ্রীঅরবিন্দ) আর ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের গদ্য ভাবনার পেছনে রাজনৈতিকবোধ নিয়ে বিশদে লেখেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধী ধ্যানধারণা সহজসরল গদ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল বাঙলা সংবাদপত্র আর পত্রিকা। ইংরিজি নয়, মাতৃভাষাই যে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তুলতে কাজে লাগে— এ প্রত্যয় আমরণ লালন করেছেন রামকৃষ্ণবাবু।      

রামকৃষ্ণবাবু জানতেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন পরিস্থিতি ও সমস্যা আসে। সবকিছুর সমাধান নিশ্চয়ই মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও-এর লেখাপত্তরে পাওয়া যাবে না। মূল দার্শনিক সূত্র (দ্বান্দিক বস্তুবাদ) অপরিবর্তিত রেখে বরং পরবর্তীকালের মার্কসবাদীদের সেসসবের মোকাবিলা করতে হবে। তাঁর মতে, পরিবেশ আর লিঙ্গবৈষম্যর মতো অনেক বিষয়কে আলাদা-আলাদা স্বয়ংসম্পূর্ণ খোপ না-ভেবে বরং পুঁজিবাদের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেখা উচিত। উল্টোদিকে, রামকৃষ্ণবাবু মনে করতেন, অন্যান্য আধুনিকোত্তর ঝোঁক (গঠনমূলকবাদ, উত্তরগঠনমূলকবাদ, পাঠক-প্রতিক্রিয়া তত্ত্ব, অবিনির্মাণ ইত্যাদি) যেখানে আঙ্গিকসর্বস্বতা আর অযুক্তিই বড় হয়ে ওঠে, সেসবের বিরোধিতা করতে হবে নির্মমভাবে। বিভিন্ন চোরা পথে নানা কেতাবি নামে ভাববাদ ক্রমাগত দখলদারির চেষ্টা চালায়। তাই সর্বদা সজাগ থাকতে হবে বস্তুবাদীকে।

বাজারি বাণিজ্যিক পত্রিকার ‘অনুরোধ’ ফিরিয়ে দিয়ে সারা জীবন রামকৃষ্ণবাবু লিখেছেন অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনে; ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব পাঠকগোষ্ঠী। এস্টাবলিশমেন্ট বিরোধিতা তাঁর কাছে নেহাত মুখের বুলি ছিল না; সে-ছাপ পড়েছে রামকৃষ্ণবাবুর সামগ্রিক জীবনচর্যায়। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক বিরল ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য— একইসঙ্গে আপসহীন ও সোচ্চার।         

0 Comments

Post Comment