নতুন কৃষি বিল কী এবং সে প্রসঙ্গে দেশ জুড়ে কী হচ্ছে, তা নিয়ে আবার শুরু থেকে শুরু করার কোন মানে হয়না। এতদিনে সকলের সব কিছু জানা বোঝা হয়ে গেছে। বরং প্রশ্নের পিঠে প্রশ্নের মত অনেকগুলো নতুন প্রশ্ন উঠে এসেছে, তার উপরে আমার বুদ্ধিমতে একটু আলোকপাত করার চেষ্টা করি।
প্রেক্ষাপট ঝালিয়ে নেওয়ার খাতিরে মনে করে নেওয়া যাক, কী কী আইন বদল হয়েছে।
চুক্তি চাষের মাধ্যমে ফসলের মূল্য সুনিশ্চিত করা– শুধু পণ্য নয়, এখন কৃষি সংক্রান্ত পরিষেবাকেও চুক্তির আওতায় আনা যাবে। চুক্তি চাষ, দাদন দিয়ে চাষ – এইসবে আর কোন আইনি বাধা থাকছে না।
অত্যাবশ্যক পণ্য আইনে সংশোধন– চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তেল – এইসব অবাধে মজুত করা যেতে পারে। যদি কোন পচনশীল খাবারের খুচরো দাম ১০০% বাড়ে বা অপচনশীল খাবারের দাম গত বছরের তুলনায় বা গত ৫ বছরের গড়ের তুলনায় ৫০% বাড়ে – একমাত্র তবেই সরকার বিধিনিষেধ জারি করতে পারে।
কৃষিপণ্য সংক্রান্ত ব্যবসা বাণিজ্যে সংশোধন – ব্যবসায়ী সংগঠনগুলি চুক্তি চাষের মাধ্যমে চাষ করে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কিনে নিতে পারবেন। বাজার কমিটির নিয়ন্ত্রণে থাকা মান্ডির মাধ্যমে কেনাবেচা করার দরকার নেই।
(বিধিসম্মত সতর্কীকরণঃ এই আইনগুলি কিন্তু আচমকা আকাশ থেকে পড়েনি – সারা পৃথিবী জুড়ে কৃষিকে সরকারি ‘কবল’ থেকে ‘মুক্ত’ করে বাজারমুখী, রপ্তানিমুখী, পণ্যসর্বস্ব করে তোলার চেষ্টা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। নড়বড়ে নব্বইয়ের দশকে বিশ্ব বাণিজ্য চুক্তিতে সই করেওই চুক্তির এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচার মেনে নেওয়ার মানেই খোলা বাজার ও কোম্পানি রাজ মানতে একরকম ভাবে বাধ্য হওয়া। ১৯৮৬-র ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টেই এই দিশা পরিষ্কার দেখা যায়। এমন কী সেই গ্যাট চুক্তির আগে থেকেই কর্পোরেট গ্যাঁট হয়ে বসতে চাইছে। ২০০৮-এর রিপোর্টে ‘গ্রামের গরীবদের উন্নয়ন’ করতে গিয়ে বহুজাতিক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির উন্নয়নের রাস্তা বেশ নির্লজ্জ ভাবেই পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এ এক বিশ্বব্যপী সিনেমার স্ক্রিপ্টের অংশ – আমাদের সরকার সেখানে মেরুদন্ডহীন গোবরের পুতুল মাত্র! এ রাজ্যে বাম জমানায় একসময় রিলায়েন্স ফ্রেশ-এর লাইসেন্স দেওয়া হয়নি একচেটিয়া ব্যাবসা আটকাতে – সেই সরকারই আবার মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারিকে ডেকে আনে। ২০১৪ সালে এরাজ্যে বর্তমান সরকার এগ্রিকালচার প্রোডিউস মার্কেট কমিটি আইনে রদবদল ঘটিয়ে কোম্পানিদের পথ প্রশস্ত করেছে। সুতরাং বদল আসছিল অনেক আগে থেকেই – আর আসছিল এত ধীরে ধীরে যে আমাদের সাদা চোখে তা ধরা পড়ছিল না। কিন্তু এখন এই তিন আইন বদল আমাদের চোখ এমন খুঁচিয়ে দিল, যে, দেখলাম তো বটেই, উল্টে চোখ দিয়ে ঝর ঝর জলের শেষ নেই! লাল নীল গেরুয়া – সব সরষে ফুলই চোখের সামনে জ্বলছে নিভছে।)
পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং আরও অন্যান্য কিছু কিছু প্রদেশের কৃষকদের নিরবিচ্ছিন্ন ধর্নায় অনেকের ভুরু কুঁচকেছেন, অনেকে দেখতে পাচ্ছেন সরষের মধ্য ভূত। ‘কেন শুধু পঞ্জাব?’‘দেখেছেন তো, সমস্ত কৃষকরা সার্বিকভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে নেই।’ ‘আন্দোলনে সব পাঞ্জাবের দালাল আর ফড়েরা – ওরা আবার কৃষক নাকি?’ ‘এই আন্দোলনের পিছনে আসলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের মদত আছে।’ – এই সব নানা কথা হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে।
একটু খতিয়ে দেখা যাক।
ভারত কৃষিপ্রধান দেশ - সেই হাজারবার পড়া লাইনটাই আবার লিখতে হল। এক হেক্টরের থেকে কম জমি থাকলে তাকে বলা হয় প্রান্তিক চাষি, এক থেকে দুই-এর মধ্যে থাকলে ছোট চাষি। বোঝার সুবিধার জন্য – একটা ফুটবল মাঠ সাধারণত ০.৬ থেকে ০.৮ হেক্টর মত হয়। ভারতে ৮৬ শতাংশ কৃষক ছোট ও প্রান্তিক কৃষক। গড় জমির হিসাব দেখলে, নাগাল্যান্ডে চাষিদের গড় জমি ৫ হেক্টর – সব থেকে বেশি। পঞ্জাবে ৩.৬ হেক্টর, পশ্চিমবঙ্গে সেখানে ০.৭৬ হেক্টর।পাশাপাশিদেখাযাক, পঞ্জাবে ৩৫ শতাংশ কৃষক ছোট ও প্রান্তিক, সেখানে পশিমবঙ্গে তা প্রায় ৯৫ শতাংশ, অর্থাৎ পুরোটাই প্রায় ছোট জোতের কৃষক। চাষব্যবস্থারই একটা মস্ত ফারাক আছে। পঞ্জাবে একরকমের চাষ একরের পর একর। পশ্চিমবঙ্গে মেলানো মেশানো নানা ফসল। ওখানে সবটাই সেচের জলে, এখানে অনেকটাই বৃষ্টিনির্ভর। কী করে হল এই ফারাক? ষাটের দশকে যখন নানা ভাবে খাদ্য সুরক্ষার দোহাই দিয়ে কৃষিকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, সেই সময় পাঞ্জাবে প্রচুর পরিমাণে বড় কৃষি পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয় – সারা রাজ্য জুড়ে ক্যানেল সেচ, ঢালাও হাইব্রিড বীজ, রাসায়নিক সার, বিষের যোগান। সঙ্গে সঙ্গে হাত ধরে আসে বাজারের পরিকাঠামো – মান্ডি। তথ্যর খাতিরে বলা যায় দেশের মাত্র ১.৫ শতাংশ জমিতে চাষ করে পাঞ্জাব দেশের ২২ শতাংশ গম আর ১০ শতাংশ চাল উৎপাদন করে। পশ্চিমবঙ্গ বা অন্য অনেক রাজ্যে এই পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি – বাগড়ে তোলার দিকে মন দেয়নি কোন সরকার।
(বিধিসম্মত সতর্কীকরণঃ এই সাঙ্ঘাতিক বুভুক্ষু চাষ ও তার পরিকাঠামো পাঞ্জাবের জলমাটি কৃষকের স্বাস্থ্যকে নিংড়ে নিয়েছে। এই হাইব্রিড ফসল নির্ভর রাসায়নিক উপকরণ নির্ভর চাষও আসলে ঐ কোম্পানি নির্ভর চাষেরই নামান্তর। কিন্তু এই বিষাক্ত চাষের হাত ধরেই আয়ও বেড়েছে।)
তার ফল কী? পাঞ্জাবে কৃষকের পরিবারের গড় মাসিক রোজগার ২৩১৩৩ টাকা। পশ্চিমবঙ্গে ৭৭৫৬ টাকা। বিহারে ৭১৭৫ টাকা। পাঞ্জাবে সাধারণভাবে গ্রামীণ পরিবারের গড় আয় ১৬০২০টাকা – অর্থাৎ প্রায় ৭০০০ টাকা কম। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে ৬৮৬০ টাকা – অর্থাৎ মাত্র ৯০০ টাকা কম।এর একটা সহজ মানে হচ্ছে – পাঞ্জাবে কৃষকরা অন্য পেশার লোকেদের থেকে ধনী – সেখানে পশ্চিমবঙ্গে কৃষির রোজগারই একমাত্র রোজগার – কিন্তু তাতেও কৃষকরা খুব ভালো রোজগার করেন একথা বলা যাবে না। পাঞ্জাবে রোজগার এতটা ভালো হল কী করে? কারণ বাজার পরিকাঠামো – অর্থাৎ সরকার পরিচালিত মান্ডি ব্যাবস্থা। একটি নির্দিষ্ট ন্যূনতম দামে সরকার ফসল কেনেন – এবং পাঞ্জাবে মান্ডির বাইরে কোন ফসল বিক্রিই হয়না – ৯৫% মান্ডিতেই বিক্রি হয়। পশ্চিমবঙ্গে ব্যবস্থাটা মিশ্র – মান্ডি ও খোলাবাজার। বিহারে পুরোটাই খোলাবাজার।
আর একটু সংখ্যা ঘেঁটে দেখা যাক। ২০১৯-২০ সালে পাঞ্জাবে মোটামুটিভাবে ১৫২ লাখ টনধান উৎপাদন হয়েছে। অথচ পাঞ্জাবের মান্ডি ধান কিনেছে প্রায় ১৬৪ লাখ টন! কী সব্বনাশ! নিজেদের খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি যদি বাদ দিই তাহলে মনে করা হচ্ছে অন্তত ৪০ লাখ টন মত ধান অন্য রাজ্য থেকে পাঞ্জাবে বিক্রির জন্য ঢুকেছে – কারণ পাঞ্জাবে ন্যূনতম দামে বিক্রি করে মুনাফা বেশি পাওয়া যায়। বিহারে খোলাবাজারে ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা কুইন্টালে ধান বিক্রি হয়, যেটা পাঞ্জাবে নিয়ে আসার খরচ জুড়ে ১৫০০ টাকা ধরলেও পাঞ্জাবে ১৮৮৮ প্রতি কুইন্টাল দামে বিক্রি করা সম্ভব। প্রসঙ্গক্রমে, ২০১৯-২০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ১৯ লাখ টন ধান কেনা হয়েছে।
এতসংখ্যা পড়ে মাথা ঘুরে গেলেও নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে – যে মান্ডি পরিকাঠামোর সুযোগ পেয়ে পঞ্জাব এবং আরও কিছু রাজ্যের কৃষকরা ভালো রোজগার করছেন,সুনিশ্চিত বিক্রির জায়গা ও দাম না থাকায় অন্য রাজ্যের কৃষকরা তা থেকে বঞ্চিত। তাই এই কৃষি আইনে যখন খোলাবাজারকে আইনগত বৈধতা দিয়ে, সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে,মান্ডি ও ন্যূনতমদামকে একটা প্রশ্ন চিহ্নের সামনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তখন সব থেকে আগে ভুগবেন পাঞ্জাব হরিয়ানার কৃষকরা – তাই তারা রাস্তায়এখন।
অন্য রাজ্য দিল্লীর রাস্তায় নেই কেন? নেই তার কারণ ছোট কৃষকরা, পুঁজিহীন কৃষকরা চাষবাস ছেড়ে দীর্ঘদিন সুদূর দিল্লী গিয়ে বসে থাকবেন – এটা একটু অতিরিক্ত চাহিদা। আর সুনির্দিষ্ট বাজার মোটেই ছিল না, ন্যূনতম মূল্য থেকেও না থাকা – তাই আইনের আগুন এখনও চামড়া পোড়ায়নি। পাঞ্জাব বিপদ আঁচ করেছে সকলের আগে। আমরা কৃষকদের হাটুর উপরে ধুতি আর না খেতে পাওয়া চেহারা দেখতে অভ্যস্ত, তাইই করে রাখতে চেয়েছি – তাই পিৎজা খাওয়া কৃষক দেখে আমরা ভিরমি খাচ্ছি! তবে ক্ষুব্ধ কৃষকরা নানা জায়গায় একজোট হচ্ছেন, দিল্লী না গেলেও নানা জায়গায় – তার কতটাএই কৃষি আইনের অলিগলি বুঝে তা বলা মুশকিল – কিন্তু সাধারণভাবেও কৃষকরা অখুশি তো বটেই। সেতো উপরে লাভের খাতার আঁক দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এবারে পশ্চিমবঙ্গে আলু বেচে আলুর বীজের দাম ওঠে কিনা সন্দেহ। সব শ্রেনীর সব কৃষকদের সংগত দাবী – নিশ্চিত বাজার, নিশ্চিত দাম - ছোট-প্রান্তিক-বড় সকলেরই এই দাবী। পাঞ্জাব যদি এক্ষেত্রে ফল ভালো করে থাকে – তবে পাঞ্জাবের এই বাজারের মডেল দেশ জুড়ে নয় কেন? উল্টে কেন সরকারী নিয়ন্ত্রণ তুলে তা কর্পোরেটদের হাতে দেওয়ার চেষ্টা? মান্ডি না থেকে খোলা বাজার অবস্থায় বিহারের আয় তো লিখেছি আগেই – সেই খোলা বাজারে কর্পোরেটরা কেন টাকার থলে নিয়ে বেশি দাম দিতে হাজির হননি? এ আইনে পাঞ্জাব দেউলিয়া হওয়ার পাশাপাশি বাকিরাও যে আরও তলানিতে পড়বেন সেকথা বলাই বাহুল্য – তবে কিনা ছোট কৃষকের কিছু হবেনা, ন্যাংটার নেই বাটপারের ভয় ভেবে বসে থাকলে, ন্যাংটার গায়ে কোনদিনই জামাকাপড় জুটবে না – একথা নিশ্চিত। বরং চামড়াটুকুও বাঁচে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
(বিধিসম্মতসতর্কীকরণ – মাত্র ২৩টি ফসলের ন্যূনতম মূল্য থাকায় কৃষকরা তার বাইরে ফসল ফলাতে উৎসাহিত থাকেন না - ফলে চাষে বৈচিত্র আনা – অর্থাৎ আমাদের খাদ্য ও পুষ্টিব্যবস্থায় বৈচিত্র আনা,এই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য মুখাপেক্ষি চাষব্যবস্থায় কতটা সম্ভব, সেটা তর্কসাপেক্ষ – সুতরাং পাঞ্জাব মডেলের কপিপেস্ট খুব কাজের কথা হবেনা।কিন্তু বাজার ও দামের নিশ্চিতির জন্য ভাবতে হবে – সরকার হাত তুলে কোম্পানিকে সব তুলে দিয়ে টঙে চড়ে মজা দেখবে বললে চলবে কেন?)
ইদানীং দুচারটি কৃষকের লাভের গল্প ফেঁদে ‘দেশজুড়ে চুক্তিচাষে কৃষকদের তো সুবিধাই হবে’ – জাতীয় বক্তব্যে সরকার ঘেঁষা হয়ে উঠতে চাইছেন কেউকেউ। বলছেন – আরে দামতো এমনিতেই পাচ্ছেনা, কেউ দাম দিয়ে কিনে নেবে এই চুক্তিতে গেলে তো কিছু অন্তত রোজগার হবে! চুক্তি চাষ সংক্রান্ত আইনটিতে অনেক ফাঁক আছে – সেকথা এতদিনে আপনারা জেনে গেছেন– কিন্তু বুঝে নেওয়া যাক, চুক্তিচাষ ব্যাপারটাতেই গোড়ায় গলদ আছে।
বর্ধমান, হুগলী, নদীয়া অঞ্চলে পেপসিকো আলুচাষ শুরু করেছেন চুক্তিচাষের মাধ্যমে – যদিও এ ব্যাপারে সরকার সানগ্লাস পরে দৃষ্টি ধূসর রাখার চেষ্টায় আছেন। সরকারিভাবে এই চাষকে মন চলছে, কৃষকদের কী অবস্থা – এ নিয়ে কোন তথ্য নেই। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে বলে করা রিপোর্টের ভিত্তিতে বোঝা গেল – বীজ ও সার প্রথমে কোম্পানি দিয়েছেন, পরে তার দাম আলুর দামের থেকে কেটে নেন – এই দাম নিয়েও অনেকে খুশি নন। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আলু কোম্পানির চিপসের চাহিদা অনুযায়ী হয় না – ফলে সেগুলো কোম্পানি নেয় না। বাজারেও এর বিক্রি নেই – ফলে হয় অন্যায়ভাবে অন্য আলুর সঙ্গে মিশিয়ে বেচে দেওয়া হয় বা ফেলে দেওয়া হয়। অনেকে গুনগুন করে ঠিক সময়ে বকেয়া পাওনা মেটানো নিয়ে অভিযোগও জানাচ্ছেন – তবে তারাএটাও মেনে নিচ্ছেন যে – কী আর করা যাবে, দেখার তো আর কেউ নেই! ৫৪ শতাংশ কৃষক মাত্র ৪০ শতাংশ আলুর জমিতেই এই চাষ করছেন – বাকিটাতে তারা সেই সাধারণ আলু চাষই চালিয়ে যাচ্ছেন – বিশ্বাস আসেনি এখনও। ৫০ শতাংশ কৃষক এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন চুক্তি চাষ। তবে চুক্তিচাষ আইনগতভাবে সিদ্ধ হয়ে গেলে তখন চুক্তি থেকে কৃষকরা বেরিয়ে আসতে পারবেন কিনা এ ব্যাপারে স্পষ্ট দিক নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সাময়িক লাভের মুখ দেখছেন অনেকেই একথা ঠিক – কিন্তু নীলচাষিরাও সাময়িক লাভই দেখেছিলেন, সেকথা মনে আছে নিশ্চয়।
হাতেনাতে প্রমাণ সয়াবিন চাষে। নব্বইয়ের দশকে সিগারেট কোম্পানি আইটিসি খাবার দাবারের ব্যবসায় আসে। ২০০০ সালে কৃষকদের কাছ থেকে তারা সয়াবিন কিনতে শুরু করে - ২০০১-০২ সালে ৬০,০০০ মেট্রিক টন, ২০০২-০৩-এ ২,১০,০০০ মেট্রিক টন সয়াবিন কেনে মান্ডির বাইরে। প্রাথমিকভাবে ভালো দাম পাওয়ায় অনেকে সয়াবিন চাষ শুরু করে – ফসল চক্র বদলে যায়, মান্ডি ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে, ছোট কোম্পানি যারা সয়াবিন থেকে নানা জিনিস বানাত, তারা বিপদে পড়েযোগানেরঅভাবে। কিছুদিনের মধ্যেই নানাঅজুহাতে সয়াবিনের দাম কমিয়ে দেয় আইটিসিসমস্ত ফসল কিনতেও তারা অস্বীকার করে।
চুক্তি চাষে স্বাভাবিকভাবেই কয়েকটি ফসলকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে – সুতরাং বৈচিত্রের কোন স্থান নেই। মুনাফাই প্রধান, সুতরাং মাটির, পরিবেশের, মানুষের স্বাস্থ্য ধর্তব্যের মধ্যে আনাটা যথেষ্ট ব্যবসায়িক হবেনা একথা বলাই বাহুল্য। মেদিনীপুর, সুন্দরবন অঞ্চলে চিংড়িচাষের জমির অন্ত্যেষ্টি দেখলে একথা বুঝতে আরও সুবিধা হবে। কিন্তু মুনাফার হিসাব কি শুধু পয়সায় হয়?
মুরগী, চিংড়িচাষ, কাটাপোনা – সবইতো এখনই কোম্পানি চাষের আওতায়। দিব্যি তো চলছে। মুরগী, ডিমের দাম কমেছে কত – সস্তায় প্রোটিন পৌঁছে যাচ্ছে ঘরে ঘরে -এ কথাও শোনা যাচ্ছে আকাশে বাতাসে। কিন্তু সেই মাছের ডেডবডি, হরমোন ও অ্যান্টিবায়োটিক সমৃদ্ধ মুরগীর খাদ্যগুণের কথা আর নাই বা তুললাম। কোম্পানি এসেছে মুনাফা করতে – তার দোষ দেখিনা। কিন্তু রাশি রাশি শহুরে মানুষ এই সাব স্ট্যান্ডার্ড খাবারের পিছনে দৌড়চ্ছেন – আর রাশি রাশি গ্রামের মানুষও চাট্টি দেশী হাঁস মুরগী পুঁটিমাছ পোষার বদলে বাজার থেকে কুখাদ্য কিনে খাচ্ছেন – আর ১১৫ টা দেশের মধ্যে বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে ১০২ নম্বর জায়গা দখল করে আমরা এখনও কোম্পানির গুন গাইছি – এসব কথা ভাবলেই আমার যুক্তিবোধ আর কাজ করেনা।
(বিধিসম্মতসতর্কীকরণ – প্রসঙ্গক্রমে, প্রবলশীত, তুখোড়গ্রীষ্ম ও মোটা চামড়ার রাজনৈতিক নেতাদের উপেক্ষা করে বুক পেতে বর্ষা নেওয়ার জন্য কৃষকরা এখনও রাস্তায় বসেআছেন। সে খবর আশা করি নানা নাটক ছাপিয়ে মাঝেমাঝে আমাদের মনে ভেসে ওঠে?)
--