বিজেপি পরিচালিত সরকারগুলির বুলডোজার পলিটিক্সে নতুন একটি সংযোজন হল এবছর এপ্রিলের শেষের দিকে গুজরাতে আহমেদাবাদের চান্দোলা লেকে উচ্ছেদের ঘটনা। চান্দোলা লেকে ৩ হাজার ৫০০ পরিবার এবং ৫০০ ছোট দোকান উচ্ছেদের কবলে পড়েছে। উচ্ছেদ হওয়া মানুষজনের মধ্যে কিছু সংখ্যক দেবীপূজক আদিবাসী, বাকি সকলেই মুসলমান। মুসলিমরা পশ্চিম বঙ্গ, বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে গিয়ে ওখানে কয়েক পুরুষ ধরে বসবাস করছিল। উচ্ছেদের বর্শামুখ ছিল বাঙালি মুসলিমদের দিকে তাক করা; সেটা বোঝা যায় ওখান থেকে একাধিক বাঙালি মুসলিমকে আটক করার ঘটনায়। আটক শুধু আহমেদাবাদ থেকে নয়, সুরাট, বদোদরা, ভাপি ও কুচ-এ অভিযান চালিয়ে সাড়ে ৬ হাজার বাঙালি মুসলিমকে আটক করা হয়েছিল। কারণ এরা নাকি ‘সন্দেহভাজন বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’। শেষমেশ অবশ্য চারশো পঞ্চাশজনকে ‘নিশ্চিত অনুপ্রবেশকারী জ্ঞানে’ গ্রেপ্তার করেছে। গুজরাত সরকার তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বললেও ৭৮ জনকে জাহাজে চড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ লাগোয়া সুন্দরবনে অলক্ষ্যে চোখ বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্বের কোথাও কি কখনো এরকম অভিবাসী প্রত্যর্পণ দেখা গেছে? ক’মাস আগে আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীদের অমানবিক কায়দায় জোর করে বিমানে চড়িয়ে ভারতে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। তবে যা করেছিল, প্রকাশ্যে করেছিল; আর মোদি প্রশাসন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে গেল কপটতায়, কিন্তু সবই করল গোপনে। তাও সীমান্ত পার করতে পারল না।
আহমেদাবাদ মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন জানিয়েছিল, চান্দোলা লেকে উচ্ছেদ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের হটানো। উচ্ছেদের পরে পুলিশ প্রশাসন অনুপ্রবেশের সঙ্গে যোগ করল সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গ। ওখানে নাকি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আল-কায়েদার গোপন কার্যকলাপ চলছিল। যদিও সরকারি মহল থেকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত ব্যক্তিদের’ সম্পর্কে চারজন ‘সন্দেহভাজন বাংলাদেশী সন্ত্রাসী’ আটক ভিন্ন আর কোন তথ্য দেয়নি, তবে পহেলগামে হামলাকারী সন্ত্রাসীদের টিকি না মিললেও দেশের ভিতরে ‘বড়সড় সন্ত্রাসী-চক্রের হদিশ করা’, ব্যাপারটা পহেলগামের ক্ষতের উপশমে সাহায্য করবে বলেই মনে হয়। আর পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের ‘যুদ্ধ’ শুরু হয়েও দু-কদম বাড়িয়েই থেমে যাওয়ায় মোদিকুলে আফশোস যা-কিছু ছিল, আহমেদাবাদে তা স্খলন করার মওকা মিলে গেছে বটে।
এখন প্রশ্ন হল : চান্দোলা লেকে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হল, নাকি, না কেঁচো, না সাপ, আসলে রজ্জুতে সর্প দর্শন হলো? চান্দোলার বাসিন্দাদের নাগরিকত্ব যাচাই না করে তাদের ঘর-বাড়ি ভেঙে দেওয়া হল কেন, সাংবাদিকদের এই প্রশ্নে গুজরাতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হর্ষ সাংভির জবাব ছিল, “এটা কোন মামুলি অভিযান ছিল না। বস্তিগুলিতে আল-কায়েদার কার্যকলাপের খবরের ভিত্তিতেই অভিযান চালানো হয়েছে এবং এই কারণেই আমরা নাগরিকত্ব যাচাইয়ের মতো লম্বা সময় অপেক্ষা করতে পারিনি।’’ যেখানে পুলিশের কথা অনুসারে জানা যাচ্ছে, উচ্ছেদ অভিযানে নেমে আল-কায়েদার কার্যকলাপের হদিশ মিলেছে, সেখানে মন্ত্রীর কথায় ঢাকঢাক-গুড়গুড় নেই, তিনি বলেই দিয়েছেন, আল-কায়েদার কার্যকলাপ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে।
ফলে গুজরাতে এই উচ্ছেদের আসল কারণ এবং গুজরাতের বিভিন্ন জেলায় অনুপ্রবেশের ধুয়ায় ধরপাকড় এক বিপজ্জনক রাষ্ট্রীয় প্রবণতার সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। তা হল, মুসলমান, অনুপ্রবেশ, সন্ত্রাসবাদ – তিনটি প্রসঙ্গকে পরস্পরের পরিপূরক হিসাবে দেশবাসীর কাছে উপস্থিত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে বিজেপি ময়দানে নেমেছে।
মোদি জমানার সোহাগে গড়ে ওঠা ‘বুলডোজার রাজ’, যার বর্শামুখ সর্বদা মুসলিমদের দিকে তাক করা ছিল, এই নিয়ে ইতিমধ্যে উত্তর প্রদেশের যোগী প্রশাসন সবচেয়ে (বদ)নাম কুড়োলেও এর পথপ্রদর্শক আসামের হিমন্ত বিশ্বশর্মার প্রশাসন। মুসলিমদের উপর প্রথম বুলডোজার আক্রমণ নামানো হয় আসামের দরং জেলার সিপাঝারে। সেখানে ২০২১এর ২০ সেপ্টেম্বর বেসরকারি হিসাবে প্রায় কুড়ি হাজার গরিব বাঙালি মুসলিমকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল সরকারি জমি অবৈধ দখলমুক্ত করার অজুহাতে। শুধু এইটুকুতেই তাদের অপকীর্তি ঢাকবার নয় বুঝে স্বয়ং আসামের মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছিলেন যে, উচ্ছেদ হওয়া মানুষেরা সবাই বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী। বিপরীতে সাংবাদিকদের সরজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, তারা ১৯৭০ সালের কয়েক বছর আগেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসে ঐ এলাকায় বসবাস করছিল এবং ১৯৮৫ সালের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সূত্রে তারা ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়েছে। ‘সেন্টার ফর মাইনোরিটি স্ট্যাডিজ, রিসার্চ অ্যাণ্ড ডেভেলপমেন্ট ইন আসাম’এর রিপোর্ট থেকেও জানা যায়, উচ্ছেদ হওয়া ঐ মানুষজন কেউই অনুপ্রবেশকারী নয়। তথাপি এরকম উচ্ছেদ অব্যাহত ছিল।
অন্যদিকে আসামের দেখানো পথে বিজেপি শাসিত একাধিক রাজ্যে মুসলিমদের উপর বুলডোজার অভিযান চালানো হয়েছিল। সেসব ক্ষেত্রে নতুন নতুন অভিযোগ আনা হয়েছিল। হিন্দু ধর্মীয় সমাবেশে পাথর ছোড়া, উস্কানি দেওয়া, ধর্মীয় প্রতিবাদের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ইত্যাকার অভিযোগে বুলডোজার অভিযান সম্পর্কে হিন্দুত্ববাদীদের ভাষ্যে বলা হয়েছিল ‘শাস্তিমূলক ধ্বংসসাধন’। এমনকি হরিয়ানার নূহ-তে ২০২৩এর ৩১ জুলাই একটি হিন্দু ধর্মীয় শোভাযাত্রা চলাকালীন বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাম্প্রদায়িক হিংসার আবহে হরিয়ানা সরকার নূহ ও গুরুগ্রামে বাঙালি মুসলমান বস্তিগুলিতে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে আলটপকা দাবি করে, ওরা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী।
বুলডোজার অভিযানের ভয়াবহতা টের পাওয়া যায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি রিপোর্টে চোখ রাখলে। সংস্থাটির রিপোর্ট ‘বুলডোজার ইনজাস্টিস ইন ইণ্ডিয়া’ থেকে জানা যায়, আসাম, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ ও দিল্লি, এই পাঁচ রাজ্যে ২০২২এর এপ্রিল থেকে জুন, কেবল এই তিন মাসেই মুসলিমদের বাসগৃহ, দোকান ও ব্যবসায়িক কাঠামো ধ্বংসের অভিযান চালানো হয়েছিল ১২৮টি জায়গায়। এগুলির মধ্যে বুলডোজার ব্যবহার করা হয়েছিল ৩৩টি জায়গায়। ফলে ৬১৬ জন গৃহহীন হয়েছে অথবা তাদের জীবিকা বিপর্যস্ত হয়েছে। এসময় দিল্লি ছাড়া বাকি চার রাজ্যে ছিল বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকার। দিল্লিতে বিজেপির সরকার না থাকলেও মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন তার হাতে ছিল; আর পুলিশ প্রশাসন সব সময়েই কেন্দ্র সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন।
এদেশে সমাজ-সংস্কৃতির দিক থেকে, রাজনীতির দিক থেকে, রাষ্ট্রের দিক থেকে লাগাতার মুসলিমদের বিরুদ্ধ ও বিপজ্জনক হিসাবে দেখানো হয়েছে। তার তীক্ষ্মতা কতদূর পৌঁছেছে, তা বুঝতে আমরা গত লোকসভা নির্বাচনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুসলিমদের প্রতি একাধিক বিদ্বেষমূলক ভাষণের কথা স্মরণ করতে পারি। মোদি জমানায় মুসলমান সম্প্রদায়কে যতরকমভাবে বদনাম করা দস্তুর -- মুসলিমদের অধিক সন্তান জন্ম দেওয়ার মতো অবাস্তব ও নিকৃষ্ট কথা থেকে অনুপ্রবেশ পর্যন্ত, সবই ছিল তাঁর বক্তব্যে।
এরকমই ধারাবাহিক মুসলমান বিরোধী রাজনৈতিক ও সামাজিক বাতাবরণে আনা হল চান্দোলা লেকে মুসলিম সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগ। এতদিন ভারতে মুসলিম সন্ত্রাসবাদ বলতে বোঝা হত বাইরে থেকে দেশের ভিতরে জঙ্গি হামলা এবং ভিন দেশী একাধিক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর মডিউলদের ভারতের কোন কোন জায়গায় আস্তানা গাড়ার ব্যাপার। চান্দোলা লেকে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ কি ঐ ধাঁচের, নাকি দেশের ভিতর ঘাঁটি গাড়ার ব্যাপার, সেটা এখনো সরকারী ভাষ্যে পরিষ্কার না হলেও এটা স্পষ্ট যে, এই প্রথম মুসলমান অনুপ্রবেশের সঙ্গে মুসলিম সন্ত্রাসবাদকে যুক্ত করা হল। এটা করতে তারা পুলওয়ামায় সন্ত্রাসী হামলা এবং সারজিক্যাল স্ট্রাইকের প্রতিক্রিয়ার মতো কোন এক উত্তেজনাপূর্ণ দেশভক্তির আবহের অপেক্ষায় ছিল। পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা এবং তার জেরে ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের’ আবহ একদমে মুসলমান-অনুপ্রবেশ-সন্ত্রাসবাদের কথা বলার সুযোগ এনে দিল। সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে সিঁদুর রঙে রঞ্জিত উন্মত্ত দেশভক্তির গাঁজলায় মুসলিম সন্ত্রাসবাদের মন্থন করানোর জন্য বিজেপি ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
২.
দেশে মুসলিমদের উচ্ছেদের ঘটনায় অনেক জায়গাতেই অনুপ্রবেশকে মূল ইস্যু করা হয়েছে, এবং তা কেবল মুসলমান নয়, বাংলাদেশী মুসলমান। যদিও ভারতে মুসলমান অনুপ্রবেশ মামুলি ব্যাপার, তথাপি ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির প্রয়োজনে এটাকে ইস্যু করা হয়েছে। হিন্দুত্ববাদীদের এই একঘেয়ে বাগাড়ম্বরের সৌজন্যে ব্যাপারটা বেশ সরল। কিন্তু বাংলাদেশী মুসলমান কেন? পাকিস্তান নিয়ে তাদের এত গুমোর, দেশটাও মুসলমান প্রধান। আহমেদাবাদ, সুরাট, বদোদরা, কি বেঙ্গালুরু, দিল্লি থেকে বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তান অনেক কাছে। কিন্তু পাকিস্তানি মুসলমান অনুপ্রবেশ নিয়ে সেভাবে কথা নেই। ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ প্রবাদে তুড়ি মেরে ভারতে যত্রতত্র ‘বাংলাদেশী মুসলমান অনুপ্রবেশকারী’ পাকড়াও চলছে। ব্যাপারটা মোটেই সাদামাটা নয়। এখানে শুধু ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসাবে ‘মুসলমান’ নেই, জাতি হিসাবে বাঙালিও আছে। ধর্মীয় বিদ্বেষের নিক্তিতে মুসলমান আর জাতি-বিদ্বেষের নিক্তিতে বাঙালি -- দুইকে মিলিয়ে-মিশিয়ে বিদ্বেষ-বিভাজনের এক ককটেল পলিটিক্স নামিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা। এতে ম্যাজিক আছে; ‘হিন্দু খতরেমে হ্যায়’ বলে বাঙালি মুসলিমদের তাক করার মধ্য দিয়ে সূক্ষ্মভাবে জাতি বিদ্বেষকে লালন-পালন করা যায়। হিন্দুত্ববাদীরা সেটাই করছে। এর ভবিষ্যৎ হবে সংঘাতময়।
হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রয়োজনে হিন্দুত্ববাদীরা জাতিকে ভাঙতে চায় ধর্মীয় আঙ্গিকে। বাঙালির ক্ষেত্রে ওরা এই কাজে খুবই মনোযোগী। আবার মণিপুরে ওরা এই কাজই করছে কিছুটা ভিন্নভাবে। মণিপুরে সংখ্যাগুরু মেইতেই জাতির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু। অন্যদিকে সংখ্যালঘু কুকি-জোমি-নাগা উপজাতির প্রায় সকলেই খ্রিষ্টান। মেইতেই ও কুকি-জোমি-নাগাদের মধ্যে কিছু দ্বন্দ্ব রয়েছে, যার মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বই প্রধান। বিজেপি-আরএসএস এটাকে উস্কে দিয়ে জাতি-দাঙ্গার আগুন জ্বালিয়েছে, এবং এই সুযোগে মেইতেইদের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে কলকাঠি নাড়ছে।
অতি সম্প্রতি ওয়াকফ সংশোধনী আইনের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনায় অভিযোগ উঠেছে, আরএসএস বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকে হিন্দিভাষী হিন্দু লোকজন এনে মুর্শিদাবাদে তাণ্ডব চালিয়েছিল। এরই মধ্যে বাংলার শহরতলীর বিজেপি নেতা অর্জুন সিং হুমকি দিলেন -- বিহার-ঝাড়খণ্ড থেকে হিন্দুদের নিয়ে মুর্শিদাবাদ-মালদহে মুসলিমদের নিকাশ করতে একদিনের বেশি সময় লাগবে না। আপাতভাবে বিষয়টি মুসলমান প্রাসঙ্গিক; কিন্তু নিহিতার্থে তা হিন্দি-হিন্দু আগ্রাসনের ইঙ্গিতবাহী। ওদিকে বাংলার বাইরে অনেক জায়গায় ‘বাঙালি মুসলমান’এর মুসলমান উহ্য রেখে বাঙালি-বিদ্বেষের রিহার্সাল চলছে। মেইন স্ট্রিম খবরের কাগজ দেখে ব্যাপারটা ঠিকঠাক টের পাওয়া মুশকিল। গুজরাতে চান্দোলা লেকে উচ্ছেদ ও রাজ্যের নানা স্থানে বাঙালি মুসলিমদের ধরপাকড় সম্পর্কে খবর জানতে চেয়ে আমার এক পরিচিত গুজরাত নিবাসী বাঙালির কাছে জানতে পারলাম, গুজরাতে যত্রতত্র বাতাসে গুঞ্জন ভাসছে – এখানে বাঙালিদের ব্যবসা করতে দেওয়া যাবে না। মানেটা কী দাঁড়াল? গুজরাত সরকার নেমেছে বাঙালি মুসলমান উচ্ছেদে ও বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী শিকারে; আর পাবলিকের কাছে বার্তা পৌঁছচ্ছে সমগ্র বাঙালির বিরোধিতা করার। জটিল সমীকরণ। গুজরাত হল সেই রাজ্য, যেখানে রাজ্য জুড়ে মুসলিমদের উপর গণহত্যা ভারত ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্তর পর্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হয়েছিল। সেই ক্ষত কি শুকিয়ে গেছে? তা যে সম্ভব নয়, বিলকিস বানুর স্বামী ইয়াকুব রসুলের এক ভয়ার্ত কথায় সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। গুজরাত গণহত্যার সময় বিলকিস বানুর উপর গণধর্ষণকারী ও অপরাধীদের সাহায্যকারী যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এগারোজনকে সাজার মেয়াদপূর্তির আগেই গুজরাত সরকারের বদন্যতায় ২০২২এর ১৫ আগস্ট মুক্তি দেওয়া হলে ইয়াকুব রসুল সাংবাদিকদের সামনে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সাজা মকুব সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেছিলেন অন্য কথা, বলেছিলেন “আমাদের এখন কোন ঠিকানা নেই। আমরা লুকিয়ে থাকছি। কারণ তা জানালে আমাদের বাঁচা কঠিন হয়ে পড়বে।’’ এরপর এই কথাই বলতে হয়, সঙ্ঘীকুলের গুরুজি গোলওয়ালকর সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্যে যা বলেছিলেন – হয় বশ্যতা মেনে নাও, নচেৎ দেশ থেকে বিদেয় হও -- গুজরাতের মুসলিমদের প্রথম অপশনটাই বেঁচেবর্তে থাকার শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং সেখানে এদিকটা নিয়ে আপাতত হিন্দুত্ব শিবিরের মাথা না ঘামালেও চলবে; এখন বিদ্বেষ-বিভাজনের নতুন ভাষ্য রচনার মরশুম – এখন বাঙালি মুসলমানের বকলমে জাতি-বিদ্বেষ দস্তুর।
ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের সামনে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হচ্ছে। শুধু ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই-ভাই’ ধরনের ভাষ্য দিয়ে তার কাউন্টার করা যাবে না। এই বিচারধারার গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই নিশ্চয়। কিন্তু হিন্দুত্ব শিবির তাকে পাশ কাটিয়ে অনুপ্রবেশ, সন্ত্রাসবাদ, দেশবাসীর নিরাপত্তার প্রশ্নে বিভাজনের নতুন ন্যারেটিভ রচনায় ব্যস্ত, তারা হিন্দু জাতীয়তাবাদের জাঁতাকলে জাতি-উৎকর্ষকে পিষে নিঃশেষ করতে চায়। এসব নিয়ে নতুন ন্যারেটিভ দাঁড় করানো এখন ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের কাছে আশু কর্তব্য।