একটা পরিস্থিতি কল্পনা করুন। ধরুন আপনার একটা সাত-পুরুষের পৈত্রিক বাড়ি আছে। আপনার পূর্বপুরুষ সহ আপনি সেই বাড়ি ভোগ করেছেন ও করছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে সেই বাড়ির দেখভাল ও করছেন। আরও কল্পনা করুন, আপনার বাড়ির লাগোয়া জমি থেকে আপনার সম্বৎসরের সব্জি-পাতি জুটে যায়। এমন কি বাড়ি মেরামত করতে গেলে যখন বাঁশ ইত্যাদির দরকার হয়, তা আপনার বাড়ির লাগোয়া বাগান থেকে পান। আপনি ছোটবেলা থেকে বিশ্বাস করে এসেছেন— এইটি আপনার ঘর। এরপর হঠাৎ শুনলেন, আপনার চির-পরিচিত ভিটেটি আপনার নয়। কারণ, আপনার ভিটেমাটি রক্ষা করার জন্য যে সরকারি দপ্তরটি তৈরি হয়েছিল, তার ‘ব্যস্ত’ বাবুরা কলমের এক খোঁচায় আপনার বংশানুক্রমিক ও পারম্পরিক স্বত্তাধিকার নাকচ করে দিয়েছে। তাই বন-সংরক্ষণকারী একটি সংগঠন আপনার ভোগ-দখলের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আপনার জন্য যেটুকু বা আইনি রক্ষাকবচ ছিল, তার সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এবং আপনার স্বার্থরক্ষার জন্য নিবেদিত সেই দপ্তরের প্রতিনিধিরা হয় আদালতে আসে নি, নয় আপনার অধিকারের জন্য সওয়াল করেনি। অতঃপর মহামান্যআদালত আপনাকে অনধিকার দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মজার কথা হল, এই মোকদ্দমায় অংশগ্রহণকারীরা আপনার মতো আপনার বাড়ী-ঘর-দুয়ারকে চেনে না, জানে না। আর আপনার বক্তব্য রাখার কোন জায়গা নেই। আপনি শুধু জানলেন আপনাকে যেকোন দিন আপনার ভিটেমাটি থাকে বের করে দেওয়া হবে। আপনি এবার কী করবেন? আন্দোলন করবেন পথে নামবেন? বলবেন, “প্রাণ দেব, ঘর ছাড়ব না”? নাকি নিজের জায়গাকে ছেড়ে বিভুঁইয়ে গিয়ে ভুঁই খুজবেন? কিন্তু এসব কিছু করেও আপনি ঐ দূরবাস নীতি-নির্ধারকদের বোঝাতে পারবেন না— আপনার সঙ্গে আপনার জায়গার সম্পর্ক শুধু ব্যবহারিক নয়। তার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক মানসিক, শারীরিক, ও জ্ঞান কেন্দ্রিক সক্ষমতার।
মুখবন্ধের শেষের শব্দ-বন্ধ নিয়ে আপনার অস্বস্তি বোধ হলে বুঝে নিন আপনি শহুরে ও আপনার অস্তিত্ত্বটি আপনার চারপাশ থেকে বিযুক্ত। আপনি আপনার জীবন-যাপনের জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীল হলেও, আপনি টাকা দিয়ে সব কিছু করা সম্ভব— এই ধারণায় প্রয়োজনাতিরিক্ত বিশ্বাসী। কিন্তু তার আগের কথাগুলি বোঝা আপনার পক্ষে বোঝা একেবারে অসম্ভব নয়।
এই কাল্পনিক পরিস্থিতি বন-নির্ভর আদিবাসী ও মূলবাসী মানুষদের জীবনে সত্য ঘটনা।গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের যে রায়টি বর্তমানে স্থগিতাদেশ প্রাপ্ত, সেটি বলবত হলে প্রায় ২০ লাখ মানুষ নিজেদের পারম্পরিক জীবন-চর্যা থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন। এটি সত্য। তেমনি এটাও সত্য যে, আমি এখানে সুপ্রিম কোর্টের রায় বা অরণ্য সংরক্ষণের সঠিক পন্থা নির্ধারণ করতে চাই না। আমার উদ্দেশ্য অরণ্য থেকে বঞ্চিত হলে কী কী জ্ঞান হারাতে পারে, তার একটা সাধারণ খসড়া তৈরি করা। জ্ঞাতব্য যে, এর প্রতিটি দিক দীর্ঘ ও সবিস্তর আলোচনার অপেক্ষা রাখে।
যে সকল জাতি জীবনধারণের জন্য সরাসরিভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল, তাঁদের আত্মপরিচিতি বোধ ও প্রকৃতি থেকে বিযুক্ত নয়। সেই পরিচিতির অন্তর্গত থাকে:
১। তাঁর গ্রামের ইতিহাস, এলাকার ইতিহাস, কৌমের ইতিহাস, গোত্রের ইতিহাস ও ব্যক্তির ইতিহাস। এই ইতিহাস মৌখিক। এই ইতিহাসের ভিত্তি মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থানের ও বোঝাপড়ার। না মানুষ অক্ষম না চারপাশের জীবন ধারা। তেমন ভাবে না গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ একক ও প্রশ্নাতীত ক্ষমতার অধিকারী নয়।
২। জীবনদর্শন, যা সৃষ্টিতত্ব ও জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে যুক্ত অনুষ্ঠান, এবং বাৎসরিক পালাপার্বণের মধ্য দিয়ে যাপন করা হয়। এই জীবন-দর্শনের মূল ভাব হল: পৃথিবী শুধু মানুষের জন্য তৈরি হয় নি। তাই সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলাটাই জীবনের ধর্ম।
৩। বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সামগ্রী, খাদ্যাভ্যাস ও ওষধির পুরুষানুক্রমিক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা-নির্ভর জ্ঞান।এটা আদিবাসী সমাজের আত্ম-নির্ভরতার অন্যতম কারণ, যা স্থানিক ও বিবর্ধমান।
এর সবকটি দিকই বিকল্প জ্ঞানের ক্ষেত্র এবং জীবন্ত। প্রাকৃতিক উপাদানের ভাণ্ডারকে বাঁচাতে যে পরিমিতি বোধ প্রয়োজন, তা কি ভাবে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করতে হয়, তা দীর্ঘদিনের সঞ্চিত সম্পদ। আর এটি মাটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছাড়া সম্ভব নয়। এছাড়া, প্রাত্যহিক জ্ঞান প্রাত্যহিকের ভাষাতেই সংগৃহীত হয়। অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রের নিজস্ব জ্ঞানের আকর আছে এবং তাতে সংরক্ষনের নিজস্ব পদ্ধতি আছে। উক্ত পরিবেশ থেকে বিচ্যুত হয়ে তাদের বেঁচে থাকা দুঃসাধ্য। বন-সংরক্ষনের মতো এই বিকল্প জ্ঞানের ভাণ্ডারগুলিকেও সংরক্ষণ করা বাঞ্ছনীয়। সামগ্রিক সহাবস্থানের ধারণায় বহুর অন্তর্ভুক্তি না হলে প্রতিস্পর্ধী চিন্তার জায়গা তৈরি হবে না।
তথ্যসূত্র:
Munda Ram Dayal. Adi-dharam: Religious beliefs of the Adivasis of India. BIRSA, Adivaani, Sarini .Kolkata 2014
Tuti Sonika & Parveen Kumar (ed). Munda Jan-Itihaas :SangskritikItihasKhuntkatti Gaon Ka. Janmadhyam.Ranchi.2013
What’s worrying about the SC order on FRA?- Down To Earth https;//www.downtoearth.org.in