ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন(১৮৫৭)-এর প্রধান নেত্রী হজরত মহলের মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে ১৪০ বছর। বেগম হজরত মহল ছিলেন অবধের শেষ বাদশা ওয়াজিদ আলি শাহ-র ত্রয়োদশ পত্নী মহক পরি ওরফে ইফতিকার-উন-নিসা বেগম হজরত মহল সাহিবা। তাঁর পিতার নাম মীর গুলাম হুসেন। লখনউর কায়জারবাগের নাগিনা-ওয়ালি বারাহদারিতে তিনি যে পুত্রসন্তান প্রসব করেছিলেন, সেই রমজান আলি বাহাদুর ওরফে ব্রিজিস কদর সিপাহী বিদ্রোহের সময় লখনউর নবাব হয়েছিলেন। বিদ্রোহীরা রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ-র পুত্র ব্রিজিস কদরকে রাজমুকুট পরিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে নতুন রাজা ঘোষণা করেছিল। ব্রিজিসের তখন ছিল নাবালক। মাত্র ১১ বছর বয়স। তাই তার রাজপ্রতিনিধি হলেন মা বেগম হজরত মহল। চিনহাট যুদ্ধের বীর বরকত আহমেদ পাথরওয়ালি-বারাদারিতে ব্রিজিস কদরের মাথায় রাজমুকুট পরালেন। সারা শহরে উড়তে লাগল সবুজ আর গেরুয়া পতাকা। রাজমাতা হজরত মহল অবধ শাসন করতে লাগলেন। এক বছর।
হজরত মহলকে সাহায্য করার জন্য একটি বিশেষ দল গঠন করা হল। শরাফ-উদ-দৌলা হলেন নায়েব অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী। ওয়াজিদ আলি শাহ-র বিশ্বস্ত রাজা বালকৃষ্ণ হলেন অর্থমন্ত্রী। সেনাপতির দায়িত্ব দেওয়া হল রাজা জয়লাল সিংহকে। বিদ্রোহী সৈন্যদের যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উমরাও সিংহ, রঘুনাথ সিংহ, রাজমুণ্ড তেওয়ারি ও ঘামাণ্ডি সিংহকে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখার প্রধান করা হল। রাজা ব্রিজিস কদর মুঘল বাদশা বাহাদুর শাহ জাফরকে তাঁর সম্রাট বলে মেনে নিলেন। তীরন্দাজ গুরু বখশ, নবাব আলি খানদের নিয়ে পরিকল্পনায় বসলেন তিন মূর্তি—রাজা জয়লাল সিংহ, মৌলবি আহমদুল্লাহ শাহ ও মাম্মু খান।
রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ তখন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়মে বন্দি। বেশ কিছু কাল অতিবাহিত হওয়ার পর হজরত মহল এবং তাঁর সঙ্গীদের অবস্থা খারাপ হতে লাগল। লখনউ শহরের তিন দিকে তখন ব্রিটিশ ফৌজ। সেই তিন বাহিনীর নেতৃত্বে ক্যাম্পবেল, জেনারেল ফ্রাঙ্কস ও আউট্রাম। দক্ষিণ দিক দিয়ে ঢুকল জঙ্গ বাহাদুর থাপার গোর্খা বাহিনী। নগরী জুড়ে যুদ্ধের সাজো সাজো রব। কোম্পানির সৈন্যসংখ্যা ৫৭ হাজার, বিদ্রোহীরা সংখ্যায় ৩৬ হাজার। তালুকদাররা অর্থাভাবে নিজের নিজের এলাকায় চলে গিয়েছেন। এমন অবস্থায় বিদ্রোহীদের কৌশল অবলম্বন করতে হল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না।
বেগম কোঠির ভয়াবহ যুদ্ধের তিন চার দিন পর হজরত মহল ও তাঁর পুত্র রাজা ব্রিজিস কদর কায়জারবাগ ছেড়ে পালালেন। তাঁরা প্রথমে গেলেন উজির শরাফ-উদ-দৌলার বাড়ি। সেখানে কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে চলে গেলেন হুসাইনাবাদের দৌলতখানায়। ওদিকে গোটা লখনউ ব্রিটিশ বাহিনীর কবজায়। তারা হন্যে হয়ে হজরত মহল ও ব্রিজিস কদরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হুলিয়া জারি করা হল, বেগম ও তাঁর পুত্র যদি আত্মসমর্পণ করেন তবে তাঁদের সঙ্গে সম্মানজনক সন্ধি স্থাপন করা হবে। ঠিক তার পর দিন বড় ইমামবাড়ার মুসাফিরখানা বোমা মেরে উড়িয়ে দিল ফিরিঙ্গিরা। হজরত আব্বাসের দরগা থেকে ফেরার সময় উজির শরাফ-উদ-দৌলাকে গুলি করে হত্যা করা হল। রাজা জয়লাল ও রাণা বেণী মাধোকে খুন করা হল। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করল ব্রিটিশ ফৌজ।
হজরত মহল পুত্রকে নিয়ে চললেন নেপাল, সঙ্গে কয়েক জন বিশ্বস্ত অনুচর, আর রয়েছেন মাম্মু জান— দুর্দিনের বন্ধু ও আপনজন। সেখানে তাঁদের আশ্রয় দিলেন নেপালের রাজা জঙ্গ বাহাদুর রাণা। ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময় হজরত মহলের বাহিনীর দমনে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছিলেন জঙ্গ বাহাদুর রাণা। তবু হজরত মহলকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দিলেন তিনি। বাকি জীবন সেখানেই কাটে বেগমের। পুত্র ব্রিজিসের বিবাহ দেন তিনি। পাত্রী মাহতাব আরা মুঘল বাদশা বাহাদুর শাহ জাফরের নাতনি!
হজরত মহলকে ইংরেজরা নেপালের জঙ্গ বাহাদুরের মাধ্যমে চাপ দিয়েছিল কিন্তু হজরত মহল জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি আত্মসমর্পণ করবেন না এবং নেপাল থেকে চলেও যাবেন না। অনেক টালবাহানার পর জঙ্গ বাহাদুর সপুত্র হজরত মহলকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বিনিময়ে পেয়েছিলেন অমূল্য সব হিরে জহরত আর গহনা। ওদিকে হজরত মহলকে হত্যা করার জন্য ইংরেজরা ঘাতক পাঠিয়েছিল নেপালে। কিন্তু যে কোনও ভাবেই হোক তারা সফল হয়নি। জঙ্গ বাহাদুর মা ও ছেলেকে কাঠমুণ্ডুতে আশ্রয় দিল। ইংরেজ ভাবল, তারা তো এটাই চেয়েছিল। হজরত মহল আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে মাসোহারা দিতে হত। জঙ্গ বাহাদুরের সঙ্গে গোপনে বোঝাপড়া করে ভীম সেন নামক এক নেপালি মন্ত্রীর পরিত্যক্ত বাড়িতে হজরত মহল ও ব্রিজিস কদরের থাকার ব্যবস্থা হল। তাঁকে মাসিক ৫০০ টাকা ভাতা দেওয়া হল। লোকে বলে, এই টাকা জঙ্গ বাহাদুর নয়, আসলে জোগাতো ইংরেজ। জঙ্গ বাহাদুর ছিলেন নেহাতই মধ্যস্থতাকারী।
কালের নিয়মে ইন্তেকাল করেছিলেন হজরত মহল। তাঁকে কাঠমুণ্ডুর জামা মসজিদ চত্ত্বরে সমাহিত করা হয়েছিল। ওয়াজিদ আলি শাহ কলকাতায় প্রয়াত হলে হজরত মহল ও ওয়াজিদ আলির পুত্র ব্রিজিস কদর কলকাতায় আসেন।