১৩-১৪ জুন ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক ঘাঁটির ওপর নজিরবিহীন বিমান হামলা চালায় ইজরায়েল। বিভিন্ন অঞ্চলে অন্তত ২০০ যুদ্ধবিমান দিয়ে চালানো হামলায় ইরানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর পাঁচ শীর্ষ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। আবাসিক এলাকা ও বিমান বন্দরেও আঘাত হানে যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর সামরিক বাহিনী। ইরানের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ হামলায় প্রাণ গেছে ছয় পরমাণু বিজ্ঞানীরও। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরানের বেশ কয়েকটি পারমাণবিক স্থাপনা। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার সূত্রে, ইজরায়েলের ‘Operation Rising Lion’ হামলায় ইরানের তেহরান, ইসফাহান এবং ফরডো সহ পারমাণবিক ও সামরিক গঠনগুলোতে বোমাবর্ষণ হয়। যার ফলে ২২৪ জনের বেশি নিহত এবং ১,৪৮১ জন আহত হয়েছেন। এই হামলাকে ‘ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল’ বলে বর্ণনা করেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জাতিসংঘকে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, নিরাপত্তা কাউন্সিলের উচিত বিষয়টি নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসা।
এই ঘৃণ্য আক্রমণের জবাবে ইরান দেড় শতাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও একশোর বেশি ড্রোনের মাধ্যমে ইজরায়েল আক্রমণ করে। ইরানের ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ-৩’ নামের অভিযানে ইজরায়েলের তেলআবিব ও জেরুজালেম ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে। ইজরায়েলের কিছু শহরে ১৬ জন নিহত, শতাধিক আহত। যদিও হামলার আগেই সাইরেন বাজিয়ে বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার নির্দেশ দেয় ইজরায়েল প্রশাসন। আর একটি সংবাদ সংস্থা ‘ফার্স’ জানাচ্ছে, “Operation Severe Punishment” শেষ হয়নি। ভবিষ্যতে ইজরায়েলের মাটিতে আরও হামলা চালানো হবে। Reuters–এ প্রকাশিত প্রতিবেদন –“ইরান মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে যাবে। এবং যুক্তরাজ্য, এবং ফ্রান্সের ঘাঁটিসমূহও লক্ষ্য হতে পারে।”
আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণের ফলাফল :
মধ্যপ্রাচ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড ওয়েলের দাম একলাফে ৭% বেড়ে গেছে। আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ চলতেই থাকলে তেলের দাম নিশ্চিত করেই আরও বাড়বে। ভারতের মতো দেশগুলোর পেট্রোলিয়াম অয়েল আমদানির ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। ফলে পেট্রোল ডিজেলের দাম বাড়বে। সাধারণ মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি আকাশচুম্বি হবে। হামলার পরপরই দালাল স্ট্রিটের শেয়ার বাজারে ধ্বস নেমেছে। হুথি, হিজবুল্লাহ’র মতো ইরানের আঞ্চলিক মিত্ররা এগিয়ে আসতে পারে হামলায়। সেক্ষেত্রে পুরো মধ্যপ্রাচ্য বারুদের স্তুপে পরিণত হবে। ইরানের বিদেশমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, ইজরায়েলের হানার পর আমেরিকার সাথে আলোচনার আর কোন মানেই নেই। নিউক্লিয়ার চুক্তি থেকে ইরান বেরিয়ে গেলে আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। নেতানিয়াহুর ঘোষণা –“Path to Tehran is open”, অর্থাৎ তারা তেহরানের প্রতিটি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাবে। এই প্রসঙ্গে মার্কিন প্রশাসন কী বলছে দেখা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের আগামি সহযোগিতা ও পরামর্শে, ট্রাম্প সুপারিশ করেছেন –“সরাসরি হত্যাকাণ্ড (যেমন খামেনেই হত্যা) বাধা দেওয়া উচিত ছিল”। তিনি উল্লেখ করেছেন, আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মধ্যস্থতা করার এখনই সময় এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকেও এই প্রক্রিয়ায় অবদান রাখতে আহ্বান করেছেন। ট্রাম্প আশা প্রকাশ করেছেন –“Iran and Israel should make a deal, and will make a deal… We will have PEACE, soon, between Israel and Iran.”
যদিও এর সাথে ট্রাম্পের হুমকি –যদি ইরান মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত আমেরিকার সামরিক ঘাঁটির ওপর আক্রমণ করে, তবে “লেভেলস নেভার সীন বিফোর” পর্যায়ের কঠিন প্রতিক্রমা হবে। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, “এখনও পর্যন্ত আমরা এতে যুক্ত নই... তবে যুক্ত হতে পারি”।
কেন এই যুদ্ধ :
ইজরায়েলের দাবি, এটি “পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রকৃত হুমকি” আটকাতে আবশ্যক ছিল। আপাত সরল এই যুক্তির পিছনে এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ রাখছি।
১৯৫০-র দশক থেকে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের নামে ইরান পরমাণু প্রকল্প শুরু করে। ধীরে ধীরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধি (enrichment) ক্ষমতা বাড়তে থাকে তাদের। কিন্তু ইজরায়েল ও পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে, ইরান শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির আড়ালে পারমাণবিক বোমা বানাতে চায়। কারণ বোমা তৈরির জন্য ৯০% পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে হয়। এরমধ্যে ইরান ৬০% পর্যন্ত ইউরেনিয়াম এনরিচ করতে পেরেছে। আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো তাদের আগামী বিপদের আশঙ্কা করে ইরানের সাথে নিউক্লিয়ার ডিল করতে এগিয়ে আসে। ২০১৫ সালে ইরান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, চীন ও রাশিয়ার রাষ্ট্রনায়কগণ ‘Joint Comprehensive Plan of Action (JCPOA)’ স্বাক্ষর করেন। শর্ত চাপানো হল –ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধি কমাবে। পাশাপাশি পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে কঠোর আন্তর্জাতিক নজরদারি থাকবে। এর বদলে ইরানের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল হবে।
‘আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা’র মতে, ইরান শুরুর দিকে সমস্ত নিয়ম মেনে চলেছে। কিন্তু চুক্তি ভাঙার পয়লা নম্বরের মাস্টার পিস ট্রাম্প সাহেব ২০১৮ সালে একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর আবার কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে, ইরানও ধাপে ধাপে শর্ত ভাঙতে শুরু করে। বেশি মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধি, গোপন পরমাণু কেন্দ্র চালু ইত্যাদি পথে তারা হাঁটতে থাকে। শুরু হল নতুন করে উত্তেজনা। ইরানের বক্তব্য, তারা পারমাণবিক বোমা বানাবে না। তবে চুক্তিও মেনে চলবে না।
ইরান যেকোন সময় পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলতে পারে, এই আশঙ্কায় পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের নেতৃত্বের ওপর চাপ দিতে থাকে। নতুন করে চুক্তিতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও সাফল্য আসেনি। অন্যদিকে ইজরায়েলের মতে,
চুক্তি থাকুক বা না থাকুক, ইরান পারমাণবিক বোমা বানাবেই। তাই এখনই হামলা করে মূল কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করতে হবে। দীর্ঘ যুদ্ধে অভ্যস্ত নেতানিয়াহু মনে করেন –রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক চাপ দিয়ে কাজ হচ্ছে না। সামরিক শক্তিই শেষ ভরসা।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বার্থ ও ভূমিকা:
https://www.wsj.com/livecoverage/israel-iran-strike-conflict/card/trump-told-netanyahu : ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এই সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে –ইজরায়েলের হামলার ঠিক কয়েক দিন আগে নেতানিয়াহু ও ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর মধ্যে ফোনে ৪০ মিনিটের উত্তেজিত বার্তালাপ হয়। নেতানিয়াহুর বক্তব্য –ইরান কৌশলে সময় নষ্ট করতে চায়। তাই একটি বিশ্বাসযোগ্য সামরিক হুমকি দরকার। যদিও হামলার ব্যাপারে ট্রাম্প তৎক্ষণাৎ সহমত হতে পারেন নি। তিনি প্রধানত কূটনৈতিক পথে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করতে চাইছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইরান “স্টাবর্ন” (অযৌক্তিক ধরনের জেদী), তবে এখনও সিদ্ধান্তহীন পর্যায়ে। তাই আলোচনায় ফিরতে পারে। ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে অ্যাটাক না করতেও অনুরোধ করেছিলেন। অন্তত সাময়িক সময় দিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। তাই ইজরায়েলের একতরফা হামলার পর ট্রাম্প জানালেন – হামলার আগেই তিনি এখবর জানতেন। যদিও ইরানের ওপর হামলাকে তিনি ‘চমৎকার’ ও ‘অত্যন্ত সফল’ বলে অভিহিত করেন। একইসাথে ইরানকে ফের আলোচনার টেবিলে আসার আহ্বান জানান। বিশ্বের অন্যতম যুদ্ধবাজ এবং অস্ত্র উৎপাদন ও সরবরাহকারী মার্কিন সরকারের কি তাহলে যুদ্ধের ওপর ঘেন্না ধরে গেল?
আসলে স্বঘোষিত বিশ্বত্রাতা ধরণীর একচ্ছত্র অধিপতি হতে কৌশলী পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
আমেরিকার বিপুল অর্থ ও সামরিক সাহায্য এবং প্রত্যক্ষ মদতে বলিয়ান ইজরায়েল সামরিক বাহিনী দুই বছরের বেশি সময় ধরে গাজাভূখণ্ড সহ প্যালেস্তাইনের ওপর বিশ্বনিন্দিত অমানবিক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। বিধ্বস্ত গাজা আজ কার্যত শ্মশানে পরিণত। ফলে মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রনায়করা ইজরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর প্রচন্ড খাপ্পা। তাঁদেরকে ট্রাম্প আর নতুন করে চটাতে চাননা। বরং ওইসব অঞ্চলে নতুন নতুন বিনিয়োগ, সামরিক সাহায্য তথা অস্ত্র বিক্রি এবং বিনিময়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেল আমদানির ওপর জোর দিতে চান নরমে গরমে। তাই ট্রাম্পকে ছুটে যেতে হয় মধ্যপ্রাচ্যের নানান দেশে ২০২৫-এর মে মাসে।
https://www.indiatimes.com/news/donald-trump-concludes-gulf-tour-with-military-and-tech-deals-says-iran-has-proposal-and-must-act-quickly-on-nuclear-talks : এই সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে –ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সফর থেকে তিনি নানা ধরনের অর্থকরী সুবিধা অর্জন করেছেন।
বিশাল বিনিয়োগ ও চুক্তি : সৌদিতে ৬০০ বিলিয়ন, কাতারে প্রায় ১২০০ বিলিয়ন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২০০ বিলিয়ন থেকে ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যবসার চুক্তি করে এলেন। (এক বিলিয়ন =১০০ কোটি, আর এক ট্রিলিয়ন =১০০০ বিলিয়ন, কোটিতে কত হয় যেন?)
বিমান ব্যবসা: কাতার এয়ারওয়েজের জন্য ৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের Boeing বিমান কেনার অর্ডার হাতিয়ে এলেন।
প্রতিরক্ষা: সৌদিতে ১৪২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রচুক্তি; কাতারে ড্রোন ও র্যাডার বিক্রির ব্যবস্থাও সেরে ফেললেন। অন্যদিকে আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি। উদ্দ্যেশ্য, মার্কিন যুদ্ধপ্রস্তুতি ও কৌশলগত উপস্থিতি বাড়ানো। প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় আরও মজবুত ভিত্তি স্থাপন করলেন। ইরানের বিরূদ্ধে সামরিক ও গোয়েন্দা অংশীদারিত্ব জোরালো হল।
সিরিয়ায় নয়া নীতি: ইকোনমিক স্যাংকশন শিথিল করা এবং সিরিয়ার নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সমর্থন। এর পাশাপাশি ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি সম্পন্ন করার পথ খুলে এলেন।
প্রযুক্তি ও এআই : ইউনাইটেড আরব এমিরেটস (UAE)-এর সদস্য দেশ আবুধাবিতে G-42 নামক বৃহৎ এআই ও ক্লাউড কম্পিউটিং মার্কিন কোম্পানির সাথে আমেরিকার চুক্তি অনুসারে আবুধাবিতে বিশ্বের বড় এআই ডেটা সেন্টার গড়ার পরিকল্পনা ফাঁদা হল। এবং UAE-র জন্য 500 K Nvidia চিপের অনুমোদনের মধ্য দিয়ে ছয়টি আরব দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোট (গাল্ফ কোঅপারেশন কাউন্সিল) অঞ্চলকে এআই পরিকাঠামোতে যুক্ত করে দেওয়া হল। উল্লেখ্য Nvidia হল আমেরিকার এক বিখ্যাত প্রযুক্তি সংস্থা। যাদের চিপ বৃহৎ ডেটা সেন্টার, সুপার কম্পিউটার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তিতে বহুল ব্যবহৃত হয়। এসবের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অবস্থান মার্কিন প্রশাসনের কাছে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি:
সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার ছয়টি সামরিক ঘাঁটি আছে। মোতায়েন হাজারো সৈন্য। ইরানের হুমকির পর এই ঘাঁটিগুলোতে ‘হাই অ্যালার্ট’ জারির পাশাপাশি বাড়তি সৈন্য পাঠানোর ঘোষণা করেছে পেন্টাগন। বাগদাদের কূটনৈতিক এলাকা এবং আল আসাদ বিমান ঘাঁটিতে বর্তমানে আমেরিকার আনুমানিক ছয় হাজার সেনাসদস্য রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র কুয়েত এবং তাদের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটিটি রয়েছে কাতারের আল উদিদে। এর আধুনিকীকরণে ২০১৮ সালে ১৮০ কোটি ডলারে একটি প্রকল্প ঘোষণা করেছে কাতার। বর্তমানে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ হাজার সৈন্য নিযুক্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য রয়েছে তুরস্কেও। দেশটির ইনজিরলিক বিমান ঘাঁটিসহ বেশ কিছু জায়গায় ২,৫০০ মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। সৌদি আরবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৩,০০০ সেনা রয়েছে। অক্টোবরে সৌদি তেলক্ষেত্রে হামলার পর ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সংঘাতের শঙ্কায় সেখানে আরও সৈন্য পাঠানো হয়েছে। বাহরাইনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি নৌঘাঁটি রয়েছে। দ্বীপ রাষ্ট্রটি বরাবরই সৌদি আরবের মিত্র৷ ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের পদক্ষেপের সমর্থকও তারা। বর্তমানে সেখানে ৭,০০০ মার্কিন সৈন্য রয়েছে। ওমানের অবস্থান হরমুজ প্রণালীর কাছে আরব উপকূলে, যা জ্বালানি পরিবহনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ। গত বছরের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রেকে বিমান ও সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয় ওমান। হরমুজ প্রণালীর পাশে থাকা আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। তাদেরও যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সাথে ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেখানে ৫,০০০ সৈন্য পাঠিয়েছে পেন্টাগন।
অন্যদিকে ইরাক, সিরিয়া, ইসরায়েল, আর সৌদি আরবের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে জডার্নের। কৌশলগত দিক থেকে তাই মধ্যপ্রাচ্য যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থান। এইসব অঞ্চলের বিমান ঘাঁটি থেকেই সিরিয়ায় আইএস বিরোধী হামলা চালিয়েছিল মার্কিন সামরিক বাহিনী। ট্রাম্প ইরানের সাথে নিগোসিয়েশন করে, সামরিক ঘাঁটিগুলিকে ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে নিয়ে আসতে চাইছে চীনকে সামরিক ঘাঁটি দিয়ে ঘিরে ফেরার জন্য। কারণ আজকের দ্বিমেরু বিশ্বে আমেরিকার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। এদিকে ইজরায়েল চাইছে আমেরিকার সাথে ইরানের যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া, যাতে নিগোসিয়েসন না হয়। সেই হিসাবে ইরানের সাথে আলোচনা প্রক্রিয়াকে ভেঙে দিতে পেরে খুশি ইজরায়েল। আমেরিকা ওখান থেকে উঠেও আসতে পারছে না, আবার সরাসরি যুদ্ধও করতে পারছে না।
একেই বলে ‘ইকোনমিক রিয়ালিজম’ বা কৌশলগত রূপনীতি (Trump Doctrine)। সরাসরি যুদ্ধ না করেও নতুন বিনিয়োগ, ব্যবসা বাণিজ্য, আমেরিকার আধুনিক প্রযুক্তির বিস্তার ঘটানোর অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ। তার সাথে ভূ-রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব অঞ্চলে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটির বিস্তার ও শক্তিশালী করা। মুক্ত বাতাবরণ যার কেন্দ্রীয় নীতি। আমেরিকা সহ সব দেশের বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও আজ এটাই চাইছে। তারা চায়, বিশ্বজুড়ে তাদের বিনিয়োগ, ব্যবসা ও মুনাফার ক্ষেত্র গড়ে তোলা। তাই ট্রাম্পের অভিবাসন বা নয়া শুল্কনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ইলন মাস্ক সহ অন্যান্য ধনকুবেররা। বাধ্য হয়ে কূটনৈতিক-ব্যবসায়িক পথকে ফোকাসে রেখে এগোতে চাইছে ট্রাম্প অ্যান্ড কোম্পানি।
অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকেও থামাতে চাইছেন ট্রাম্প। এখানে মার্কিন প্রশাসনের অন্য একটি ভয় কাজ করছে। চীন ও রাশিয়া মিলে ইউরোপের কিছু দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে একটি বিকল্প জোট তৈরি করলে আমেরিকার ডলার সম্রাজ্য সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়বে। যার কিছু ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। তাই জেলেনস্কিকে হাতে এনে যুদ্ধ থামানোর পাশাপাশি ইউক্রেনের বিরল খনিজ সম্পদ দখলে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প সাহেব। একই কারণে তাঁর গ্রিনল্যান্ড দখলের বাসনা। এভাবেই ট্রাম্প বিরল খনিজ ভান্ডারের ওপর চীনের একচেটিয়া আধিপত্যকে মোকাবিলা করতে চান। অর্থনৈতিক যুদ্ধের এই নয়া পথ সম্পর্কে আমাদের সম্যক অবহিত থাকা দরকার অবশ্যই।
ওই শোনো মুক্তির দিশা:
ধ্বংস, বিপর্যয়, অসংখ্য প্রাণহানি ও মানবিকতার চূড়ান্ত অপমৃত্যুর পাশাপাশি যুদ্ধ ডেকে আনে প্রাণী ও উদ্ভিদকূল সহ প্রকৃতি পরিবেশের ভয়ানক বিপর্যয়। এইসব যুদ্ধে আম জনতার ভয়ঙ্কর ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ নেই। তার প্রমাণ বিশ্ববাসী পেয়েছেন দু’ দুটি বিশ্বযুদ্ধ সহ আমেরিকার ভিয়েতনাম আক্রমণ, ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের ওপর আক্রমণ সহ মধ্যপ্রাচ্যের নানান যুদ্ধে। আর দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার ও গাজা ভূখণ্ডের ওপর ইজরায়েল সামরিক আক্রমণ যেন ক্ষয়ক্ষতি ও বিপর্যয়ের সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছে। সমস্ত যুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি করে আক্রান্ত হয়ে থাকে শিশু ও মহিলারা। সামরিক গুন্ডাদের বিকৃত যৌন লালসা মেটানোর সহজ শিকার দখলীকৃত দেশ বা অঞ্চলের নাবালিকা সহ নারীরা। এইসব যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর এক বড় অংশ সবসময় বিক্ষোভ প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। রাগ দুঃখ ক্ষোভে ফেটে পড়েছে বিশ্বের নারী শক্তি।
বর্তমানে বিশ্ব মানবিকতার পক্ষে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে এবং প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশের সংরক্ষণ ও সুরক্ষার দাবিতে ফ্রান্স সহ ইউরোপের নানান দেশে, এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষজন বিক্ষোভ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। যেখানে নারী ও বর্তমান প্রজন্মের যুবা বাহিনীর অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। গ্রেটা থানবার্গের মতো তরুণ তরুণীরা অসীম সাহসে ভর করে ভীষণ উদ্যমে ইজরায়েলের মতো শক্তিশালী যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। আমাদের রাজ্য সহ দেশের নানান প্রান্তের নবীন প্রজন্ম ও প্রকৃতি পরিবেশ আন্দোলনের সাথীরা পথে নামছেন এই নয়া দিশাকে আঁকড়ে ধরে। জঙ্গল বাঁচানোর জন্য আদিবাসী মানুষদের লড়াই একটা মাত্রায় সাফল্যও পাচ্ছে দেশ জুড়েই। কর্পোরেটের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধই আসলে আগামীর পথ –প্রকৃতির মুক্তি, নারীর মুক্তি তথা সমগ্র মানব সভ্যতার মুক্তির পথ। এই যুদ্ধেই পা মেলাতে হবে আমাদের। দলগত ভেদাভেদ ভুলে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পথে নামতে হবে আমাদের।