পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গন্দোয়ানাল্যান্ডের হাসদেও আরানিয়া

  • 01 May, 2019
  • 0 Comment(s)
  • 6033 view(s)
  • লিখেছেন : মলয় তেওয়ারি

ভারতে টিঁকে থাকা সর্ববৃহৎ অখন্ড অরণ্যভূমির অন্যতম হাসদেও আরানিয়া। ভারতের ঠিক বুকের মাঝে এর অবস্থান। এই গভীর অরণ্য হাতি চিতা ভাল্লুক সহ বহু বন্যপ্রাণীর আবাস। এখানে আছে বিপুল জল সম্পদ। এই নিবিড় অরণ্যভূমিকে ২০০৯ সালে ‘No-Go’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল কেন্দ্র সরকার। সম্প্রতি এই অরণ্যভূমিকে কয়লা খনির জন্য তুলে দেওয়া হল আদানি কোম্পানির হাতে।

কয়লা তোলা হবে খোলা মুখপদ্ধতিতে। ওপর থেকে গাছপালা, মাটি, পাথর সব সরিয়ে ফেলে মাটির নীচের কয়লা তোলা হবে। সমগ্র এলাকা তছনছ হয়ে যাবে। জলাশয়গুলি হাপিশ হয়ে যাবে। গভীর ও সুদূরপ্রসারী সংকটে পড়বে বন ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ।বিভিন্ন প্রজেক্টের চাপে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে ভারতের অরণ্যভূমি। টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়াই বন ও বন্যপ্রাণীর অস্তিত্বের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক। বনের ভেতর ভেতর আদিবাসীদের ছোট ছোট গ্রামগুলি বনেপ্রাণে একাকার হয়ে থাকে, বনকে টুকরো করেনা। পুঁজিবাদী প্রকল্পগুলি ভেঙে খানখান করে দেয় বনজীবন। ২০১৮র ডিসেম্বরে পার্লামেন্টে সরকার জানায় যে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মোট ২০,৩১৪.১২ হেক্টর বনভূমি কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে খনিজ উত্তোলনের জন্য। সর্বশেষ এই মার্চে আদানি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হল এক লক্ষ সত্তর হাজার হেক্টর। ১ হেক্টর = ০.০১ বর্গ কিলোমিটার। ১৭০,০০০ হেক্টর = ১৭০০ বর্গ কিলোমিটার। ৮ খানা কোলকাতার সাইজ! ভারতের মধ্যভাগের এই অঞ্চলকে ভূতাত্বিকেরা চিহ্নিত করেন গন্দোয়ানাল্যান্ড হিসেবে, পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের বহু আগে যে আদি মহাদেশ থেকে ভারত ভুখন্ড তৈরী হয়েছিল। ভারতের এই এলাকায় বসবাসকারী মানুষেরা দেশের অন্যতম আদি বাসিন্দা। তাঁরা নিজেদের বলেন গোন্দ। হাসদেও আরানিয়ার মধ্যে আছে তিনশর উপর গোন্দ গ্রাম। গভীর অরণ্যের নীরব উদ্ভিদকুল ও জীববৈচিত্র্যের সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যাবে এই গ্রামগুলিও।

অথচ এই অরণ্যের ওপর আদিবাসীদের অধিকার আছে। কেবল পরম্পরাগত, ঐতিহাসিক বা মানবিকতার অধিকার নয়। রীতিমত আইনী অধিকার আছে তাঁদের। অরণ্যের অধিকার আইন, ২০০৬অনুযায়ী আদিবাসী ও বনবাসীরা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে বনভূমি ও গৌণ বনজ সম্পদের ওপর তাঁদের মালিকানা কায়েম করতে পারেন। অরণ্য ভূমিকে কর্পোরেট প্রকল্পের জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম গ্রামসভার অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। হাসদেও আরন্ড বনভূমির গোন্দ গ্রামগুলি আইনী পথে এই সমস্টিগত অরণ্য অধিকার’-এর স্বীকৃতি আদায় করেছেন। ফলত, আইন অনুযায়ী, গ্রামসভার অনুমতি ছাড়া কোনওরকম প্রকল্পই ছাড়পত্র পেতে পারেনা। ২০০৬-৭ সালে রাজস্থান সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থার বকলমে আদানি গোষ্ঠিকে এখানে কয়লা তোলার বরাত দিয়েছিল কেন্দ্র সরকার। কিন্তু অরণ্যের অধিকার আইনে বলীয়ান গ্রামসভাগুলি এই প্রকল্প আটকে রেখেছিল। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টও এক ঐতিহাসিক রায়ে গ্রামসভার এই অধিকারকে উর্ধে তুলে ধরেছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এসবকে নস্যাৎ করে দিতে উদ্যোগ নেন। মোদি সরকারের পরিবেশ মন্ত্রক ২০১৫ সালে সার্কুলার জারি করে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয় যে অরণ্যের অধিকার আইনের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ কোনও অনুমতি ছাড়াও নীতিগত ছাড়পত্র দেওয়া যেতে পারে। সেই সময় কেন্দ্র সরকারের আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রকের পক্ষ থেকে পরিবেশ মন্ত্রকের এই নির্দেশের বিরোধিতা করা হয়েছিল, কিন্তু নির্দেশটি সরকারের সর্বোচ্চ স্তরথেকে এসেছে বলে শেষ পর্যন্ত সেই বিরোধিতা চুপসে যায়। কর্পোরেট কোম্পানিগুলি তাদের পেটোয়া এনজিওর মাধ্যমে বনাধিকার আইন বাতিল করার আবেদন জানিয়ে আগেই মামলা করেছিল সুপ্রিম কোর্টে। সেই মামলায় কেন্দ্র সরকার নিজেকে ডিফেন্ড না করায় এবছর ১৩ ফেব্রুয়ারী এক কুখ্যাত রায় এসেছে, যে রায়ে ২০ লক্ষের ওপর আদিবাসী বনবাসীকে উচ্ছেদ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি কেন্দ্র সরকার যে নতুন ফরেস্ট অ্যাক্ট’-এর প্রস্তাবনা এনেছে তা অরণ্যের অধিকার আইনকে পুরোপুরিই নস্যাত করে দেবে!


0 Comments

Post Comment