পুরাণ অনুসারে, শিব ও দক্ষকন্যা সতীর মধ্যে দাম্পত্য কলহ হয় এবং তার ফলে উদ্ভূত হয় এই দশ মহাবিদ্যার। তবে ওই দাম্পত্য কলহ আসলে প্রকৃতি ও পুরুষের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া। দক্ষযজ্ঞে সতীকে যেতে নিষেধ করেন শিব। কিন্তু পিতার যজ্ঞে সতী বিনা নিমন্ত্রণেও যেতে চান। শিব সম্মত না হলে সতীর তৃতীয় আঁখি থেকে নির্গত হতে থাকে বহ্নি--তাই দশ মহাবিদ্যা। তাইই আলোক আর আতসবাজির উৎসব। ওই মহাবিদ্যা প্রত্যক্ষ করে শিব সতীর কথা মেনে নিলেন।
শাক্ত মত অনুযায়ী, কালী পরব্রহ্ম। সেই পরম চৈতন্য লিঙ্গরহিত। তিনি এক, অদ্বিতীয় ও একমাত্র সৎ। বাকি সব দেবদেবী ওই আদ্যাশক্তির বিভিন্ন প্রকাশ। ভারতে শাক্ত ধর্মের সঙ্গে শৈব মতের নিবিড় যোগাযোগ আছে। ভারতের আদি দর্শন সাংখ্য-এ প্রকৃতি বা শক্তিকেই জগতের মূল কারণ বলা হয়েছে। এই মূলা প্রকৃতি কারোর বিকার নন, বরং বাকি সব কিছু তাঁর বিকার। শিব বা পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগ হলে জগতের সৃষ্টি হয়। পুরুষ ক্রিয়ারহিত। প্রকৃতি-পুরুষের প্রথম অভিব্যক্তি হল মহৎ বা বুদ্ধি। এখানে দশ মহাবিদ্যার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। মনে পড়তে পারে, শিব ও সতীর দাম্পত্য কলহ।
সাধক বামাচরণ চট্টোপাধ্যায় ওরফে বামা ক্ষ্যাপা বলেছিলেন, নিগমে প্রকৃতি বা শক্তিরূপী দেবী হলেন গুরু আর শিব হলেন শিষ্য আর আগমে শিব গুরু ও দেবী শিষ্য। বামাচারীদের শাস্ত্র হল নিগম আর দক্ষিণাচারীদের আগম। সেই লড়াই চলে। নিগম তো আসলে ওরাল টেক্সট। ওই মৌখিক দর্শনে অভিভূত হয়ে সাধক নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, "শ্যামা নামে লাগল আগুন/আমার দেহের ধূপকাঠিতে।" মানুষের অন্তরে যে আদ্যাশক্তি বাস করেন, তাঁকে শিবযুক্ত করতে পারলেই জগতের হিত হয়। আলো ছড়িয়ে পড়ে ঘোর অমাবস্যায়। সেই আলোর নাম শ্রীরামকৃষ্ণ।
আমরা এখন সরাসরি প্রবেশ করব ‘মহাভারতে মাতৃবন্দনা’-র প্রসঙ্গে। প্রথমেই আসা যাক দেবী দুর্গার প্রসঙ্গে।
‘দুর্গা’ কথাটি ‘দুর্গ’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। দুর্গ বলতে আমরা বুঝি এমন জায়গা যেখানে সহজে শত্রুরা প্রবেশ করতে পারে না। সেই হেতু দুর্গ অনেকখানি নিরাপদ জায়গা। এই ‘দুর্গ’ কথাটি এসেছে ‘গম্’ ধাতু থেকে। ‘গম্’ ধাতুর অর্থ গতি, গমন, প্রাপ্তি, জ্ঞান, অতিক্রম। সেই জন্য ‘দুর্গ’ কথার প্রাথমিক মানে হল অশক্যগমন বা অসাধ্যগমন। সেখানে সহজে ঢোকা সম্ভব নয়। দুর্গ আবার রাষ্ট্রের সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের অন্যতম। এই সব কথা আমরা প্রসিদ্ধি থেকে জানি। এই ক্ষেত্রে শব্দের অবয়বশক্তি থেকে যে অর্থ আমরা পাই, তা প্রসিদ্ধি থেকে প্রাপ্ত অর্থের অনুরূপ। এমনই এক অপরাজেয় দৈত্য ছিলেন দুর্গ, যাকে নাশ করেছিলেন এক দেবী। সেই দেবীই দুর্গা। দুর্গা হলেন দুঃখে প্রাপ্যা। এই দুঃখ, কষ্ট, জরা মানুষের প্রধান শত্রু, সে অপরাজেয়ও বটে। তাকে জয় করতে পারেন যিনি সেই মহাবিঘ্নাদিনাশিনী দেবী হলেন দুর্গা। দ-কারে তিনি দৈত্য ধ্বংস করেন, উ-কারে নাশ করেন বিঘ্ন, র-কারে তিনি রোগজরা থেকে মুক্তি দেন, গ-কারে হয় পাপনাশ এবং আ-কারে নাশ হয় ভয়শত্রু। কখনও তিনি নববর্ষা কুমারী, কখনও নীলী, আবার অপরাজিতা। দৈত্য কে? সে অসুরপ্রকৃতি জন—কৃষ্ণ নাহি মানে, তাতে ‘দৈত্য’ করি মানি। চৈতন্য না মানিলে তৈছে ‘দৈত্য’ তারে জানি। এই কথা চৈতন্যচরিতামৃতে আছে।
দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।
(পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৪ থেকে উদ্ধৃত)
এই জগতে নানা প্রকারের দুঃখ। সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের সাম্যাবস্থা হল প্রকৃতি। রজোগুণ বড়ই চঞ্চল, তার এক পরিণাম হল দুঃখ। এই দুঃখের আবার তিনটি ভাগ—আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক। ইন্দ্রিয়, মন ও দেহ থেকে উৎপন্ন দুঃখ হল আধ্যাত্মিক; ভূত থেকে জাত—মানুষ, পশুপাখি, সরীসৃপ থেকে উৎপন্ন দুঃখ হল আধিভৌতিক; আধিদৈবিক দুঃখ হল অধিদেবভব—দেবযোনী প্রভৃতি থেকে সংঘটিত। এই দুঃখ হল সকল বন্ধনের মূল। তা থেকে জীব মুক্তি পেতে চায়। এই যন্ত্রণার রাজ্যই দুর্গ নামক অসুর বা দৈত্য, তাকে যিনি বিনাশ করেন তিনি মুক্তি বা দুর্গা।
-------------------------------------------------------------------------------
ছবি আঁকলেন - আনখ সমুদ্দুর।
মাতৃবন্দনা প্রথম পর্ব পড়ুন এই সুত্রে--- https://www.sahomon.com/welcome/singlepost/worshipping-the-mother-part-1
মাতৃবন্দনা দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন এই সুত্রে---https://www.sahomon.com/welcome/singlepost/worshipping-the-mother-part-2
মাতৃবন্দনা চতুর্থ পর্ব পড়ুন এই সুত্রে---https://www.sahomon.com/welcome/singlepost/worshipping-the-mother-part-4