গল্পটা শুরু করেছিলেন এদেশে মধ্যবিত্তের প্রিন্স চার্মিং তথা ইনফোসিসের কো ফাউন্ডার নারায়ণমূর্তি।গত বছর এক আলোচনাসভায় তিনি নিদান হেঁকেছিলেন যে ভারতকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন পেতে হলে সপ্তাহে সত্তর ঘন্টা কাজ করতে হবে। কদিন আগে নারায়নমূর্তির ফেলেোয় জুতোয় পা গলিয়ে লারসেন টুবরোর সর্বোচ্চ কর্তা এস এন সুব্রামনিয়ম প্রস্তাব দিয়েছেন শ্রমজীবী মানুষের সপ্তাহে কাজের সময় ৯০ ঘন্টা করা উচিত। এমনকি তার দুঃখ যে তিনি নিয়োগকর্তা হিসাবে কর্মচারীদের রবিবার কাজ করাতে পারছেন না। অবশ্য এর পাশাপাশি বিরুদ্ধ মতও রাখছেন বেশ কিছু কর্পোরেট শিল্পপতি যেমন মাহিন্দ্রা কর্তা। এই পারস্পরিক ' বিবাদ' আসলেে এক গটআপ খেলা কারণ মূল বিষয়টি আরো গভীরে।এই প্রস্তাব আদতে শ্রমিক শ্রেণির অর্জিত অধিকারের উপর এক নগ্ন আক্রমণ এবং দুর্ভাগ্য জনক হলেও এ কথা সত্যি যে দিনে দশ- বারো ঘন্টা কাজ করা আজ ভারতের শ্রমজীবী মানুষের ভবিতব্য ( বিশেষ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রে) হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ তাই শ্রমঘন্টা বাড়ানোর প্রস্তাবকে শ্রমিকশ্রেণির উপর মালিকপক্ষের আক্রমণের ধারাবাহিকতায় বিচার করতে হবে।
এই মুহূর্তে বাস্তবতা হল মালিক পক্ষের মুনাফা নিশ্চিত করতে প্রায় সব সেক্টরে ভারতের শ্রমজীবী মানুষ দৈনিক ১০-১২ ঘন্টা কাজ করছেন। এতে তাদের কি কোন লাভ হয়েছে? এক্ষেত্রে সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে ১৯৯০- ৯১ সালে নেট ভ্যালু অ্যাডিশনে শ্রমিকদের মাইনের পরিমাণ ছিল ২৭.৩৪% যা ২০২২-২৩ সালে কমে হয়েছে ১৫.৯৪%।এই একই সময় পর্বে মালিকপক্ষের মুনাফার হার ১৯.০৬% থেকে বেড়ে হয়েছে ৫১.৯২%। রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা সঠিক ভাবে দেখিয়েছেন যে এল অ্যান্ড টি বা এই ধরণের কোম্পানির সর্বোচ্চ স্তরের কর্তাদের মাইনে কোম্পানির কর্মচারিদের গড় মাইনের চেয়ে ৫০০ গুণ বেশি( পার্কসের হিসাব আলাদা)। আসলে কোম্পানির নিচের ও মাঝের তলার মানুষদের হাড় মাংস চুষে সুপার প্রফিট নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই শ্রম ঘন্টার প্রস্তাবনা। সুব্রামনিয়মের বক্তব্য একই সঙ্গে চূড়ান্ত ভাবে নারী বিদ্বেষী।এই আহাম্মক এটাও জানেন না যে গৃহে হোক বা বাইরে, ভারতে মহিলারা চূড়ান্ত পরিশ্রম করেন। আদতে নয়া উদারবাদের জমানায় এলন মাস্ক,জ্যাক মা রা একধরনের পাশবিক, পারিবারিক জীবন হীন উৎপাদন যন্ত্র হিসাবে শ্রমজীবী মানুষদের দেখতে চান। কখনো উন্নত দেশের তকমা, কখনো যৌবনের প্রতীক কখনো বা ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসাবে চিনকে হারিয়ে দেবার মত জাতীয়তাবাদী স্বপ্ন ফেরি করে নারায়ণমূর্তি বা সুব্রামনিয়মের মত কর্তারা নিজেদের মুনাফা নিশ্চিত করতে একই পরিকল্পনা এদেশে করছেন। আর যতই এল অ্যান্ড টি র মত কোম্পানিকে 'ইন্ডিয়ান মাল্টিন্যাশানাল' হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের দেশ গড়ার কারিগর ঘোষণা করা হোক না কেন, আদতে এল অ্যান্ড টির ৫০ শতাংশের মালিক বিদেশি পুঁজিপতিরা।প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ, পোর্টফোলিও ফান্ড ও মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণ বিদেশিদের হাতে গেছে।
১৮০০ পরবর্তী সময় ইংল্যান্ডের ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টারদের রিপোর্টে লেখা ছিল যে যতক্ষণ না পর্যন্ত শ্রমিকরা জ্ঞান হারাচ্ছেন ততক্ষণ তাদের কাজ করতে বাধ্য করা হত।অবশ্য তখনো শ্রমিকদের সেই বধ্যভূমিতে ' রবিবার' দিনটি সাপ্তাহান্তিক ছুটির দিন হিসাবে পালন করা হত।এরপর শ্রমিকদের গৌরবময় লড়াইয়ের কারণে প্রথমে ১৮ ঘন্টা,পরে ১০ ঘন্টা এবং শেষে ৮ ঘন্টার শ্রমঘন্টা চালু হয়( ৮ ঘন্টা কাজ ৮ ঘন্টা বিশ্রাম ৮ ঘন্টা পরিবারের সঙ্গে যাপন ও বিনোদন)। এটা কারোর দয়া নয়,এটা অধিকার, বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। সেই ধারাবাহিকতায় ভারতেও ফ্যাক্টরি আইন( ১৯৪৮),ন্যূনতম মজুরি আইন, মাতৃত্বকালীন সুবিধাও লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই অর্জিত হয়েছে।
ভারতে অবস্থার পরিবর্তন শুরু হল নব্বইয়ের দশকে যখন বিশ্ব ব্যাঙ্ক,আইএমএফ,এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক প্রভৃতি আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানগুলির অভিভাবকত্বে এদেশে 'উদারীকরণ - বেসরকারিকরণ- ভুবনায়নের' ব্যানারে আর্থিক সংস্কার পর্ব চালু হল। কর্পোরেট সংস্থাগুলো লগ্নির শর্ত হিসাবে প্রথম শর্ত রাখল শ্রম আইনের সংস্কার।এই সংস্কারের অর্থ ' হায়ার অ্যান্ড ফায়ার', অধিক শ্রমঘন্টা,অন্যান্য সুবিধার হ্রাস। এই বিষয়গুলোকে আরো সমন্বিত করা হয়েছে ২০২০ সালে মোদি সরকার কর্তৃক পাশ করা চারটে লেবার কোডের মাধ্যমে। এতে পরিষ্কার ভাবে ১২ ঘন্টা ( সপ্তাহে ৭২ ঘন্টা) কাজের সওয়াল করা হয়েছে। এখনো দেশ জুড়ে এই শ্রমকোড চালু না হলেও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে (বিজেপি শাসিত এবং অবিজেপি শাসিত) অধিক শ্রমঘন্টা কাজ করা( কোন ওভারটাইম) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।এর উদ্দেশ্য কোন নতুন নিয়োগ না করে,একই মাইনেতে বেশি কাজ করিয়ে নেওয়া এবং সুপার প্রফিটের রাস্তা পরিষ্কার করা।
নারায়ণমূর্তি তার বক্তব্যে জার্মানি ও জাপানের উদাহরণ দিয়েছেন যা অসত্য। মূর্তি দাবি করেছিলেন যে এই দুটো দেশের শ্রমজীবী মানুষ বেশি সময় কাজ করেন বলে সেগুলো উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। পরিসংখ্যানে কিন্তু এই দাবির সত্যতা মিলছে না।জার্মানিতে সাপ্তাহিক শ্রমসময় হল ২৮ ঘন্টা। জাপানে ১৯৬১ সালে শ্রমিকরা সপ্তাহে ৪৪ ঘন্টা কাজ করত কিন্তু ২০১৭ সালে তা ৩৫ ঘন্টা হয়েছে। এই মুহূর্তে ইন্টারন্যাশানাল লেবার অর্গানাইজেশনের হিসাব অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি শ্রম ঘন্টার দেশ হল ভুটান (৫৪.৪ঘন্টা/সপ্তাহ) এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহী (৫০.৯ঘন্টা/সপ্তাহ)।এই দুটো দেশ কিন্তু উন্নত দেশের তালিকায় পড়ে না। আজ সারা পৃথিবীতে কাজ ও বিশ্রামের মধ্যে সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে। এমনকি বেশিরভাগ দেশে সপ্তাহে কাজ করার কথা বলা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিককে মধ্যযুগীয় ক্রীতদাসে পরিণত করার জন্য এই আস্ফালন।
হু( WHO) তার সাম্প্রতিক সমীক্ষায় বলেছে যে সপ্তাহে ৫৫ ঘন্টা বা তার বেশি কাজ করলে স্ট্রোকের সম্ভাবনা ৩৫% এবং হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা ১৭% বৃদ্ধি পায়।হু এবং আইএলও কর্তৃক Environment International Journal এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে এই পৃথিবীতে ৪৮.৮০ কোটি লোক দীর্ঘ সময় কাজ করেন এবং ২০১৬-২০২১(৫ বছর) সময়পর্বে ৭,৪৫,০০০ মানুষ হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে মারা গেছেন। রিপোর্ট বলা হয়েছে অতিরিক্ত শ্রমঘন্টায় উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করার পরিবর্তে অসুখ বিসুখের হার বৃদ্ধি করে যা আবার কর্মক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে--" Physical and mental strain of the overworked people can start from acute physiological responses such as fatigue,stress,impaired sleep and unhealthy life style changes in response to the stress.In addition, overworking reduces work performance and results in productivity loss due to illness and occupational injuries"।
কিছুদিন আগে গ্লোবাল ব্র্যান্ড আর্নস্ট ইয়ং এর ভারতীয় শাখার চার্টাড অ্যাকাউন্টেট অ্যানা সেবেস্টিয়ানের কর্মক্ষেত্রে অসম্ভব চাপের কারণে আত্মহত্যা সোসাল মিডিয়ায় আলোড়ন তুলেছিল।আজ ভারতের শ্রমিক- কর্মচারীরা প্রতিকূল কাজের পরিবেশের কারণে বিপর্যস্ত। হু রিপোর্টে বলা হয়েছে প্রতিটি ভারতীয় শ্রমিক সপ্তাহে গড়ে ৪৬.৭ ঘন্টা কাজ করেন, এদের মধ্যে আবার ৫১% গড়ে ৪৯ ঘন্টা কাজ করেন। গ্লোবাল জব প্ল্যাটফর্ম 'ইনডিড' তাদের সমীক্ষায় দেখিয়েছে যে ৮৮% কর্মচারীকে তাদের নিয়োগকর্তারা অফিস ছুটির পর বা ছুটিতে থাকাকালীন কাজের কারণে যোগাযোগ করেন। এদের মধ্যে ৭৯% জানিয়েছেন এই ফোন কল না ধরলে তাদের কর্মজীবনে বিরুপ প্রভাব পড়বে।এক কথায় ভারতের শ্রমজীবি মানুষেরা কোন ওভারটাইম ছাড়াই অতিরিক্ত শ্রমদান করতে বাধ্য হন। একই পারিশ্রমিকে শ্রমঘন্টা বাড়ানোর নিদান সেই ব্যবস্থাকে আইনি বৈধতা দানের চক্রান্তের অংশ মাত্র। বিগত সময় শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার দুর্বলতা ও মূল ধারার শ্রমিক সংগঠনগুলোর আপোষকামী মনোভাব শ্রমিকদের দুর্বল করেছে। এই সময়ে সেই ব্যার্থতার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে না চাইলে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধই একমাত্র পথ।