মুর্শিদাবাদের জলঙ্গীতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও নাগরিকপঞ্জির বিরুদ্ধে বনধ ডেকেছিল নবজাগরণ নামক একটা স্থানীয় সংগঠন। সেই বন্ধ ভাঙতে তৃণমূলের ব্লক সভাপতির নেতৃত্বে সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনী হামলা চালালো এনআরসি বিরোধী জমায়েতে। গুলির আঘাতে প্রাণ হারালেন ষাট বছর বয়সী এক প্রবীন ও ১৭ বছর বয়সী এক তরুণ মুসলিম যুবক। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বাংলার গ্রামাঞ্চলে গত চার মাস ধরেই তৃণমূল কংগ্রেস এনআরসি-ক্যা বিরোধী নাগরিক আন্দোলনকে নানাভাবে আটকানোর চেষ্টা করছে। কখনো প্রশাসনিক ভাবে সভা-সমাবেশের অনুমতি আটকে, কখনো পরোক্ষ ভাবে আন্দোলনরত কর্মীদের হুমকি দিয়ে। কারণ এই রাজ্যের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের যে ছবি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে, তাতে আমরা দেখছি আদিবাসী-দলিত-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আর স্রেফ ভোটব্যাংক হয়ে থাকতে রাজি নন। প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর দাপটের বদলে এই আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠে আসছেন সাধারণ মানুষ- ছাত্র যুব থেকে বর্ষীয়ান গণআন্দোলনের কর্মীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিচ্ছেন একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর পর্বেও সুশীল সমাজের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেবার সেলিব্রেটি বুদ্ধিজীবীদের দাপটে সাধারণ মানুষ কোথাও যেন হারিয়ে গিয়েছিল। ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে সেই আন্দোলনকে নিজের অনুকূলে টানতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। পালাবদলের পরে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই নানান সরকারি ভূষণে ভূষিত হয়ে নিজেদের নিরপেক্ষ স্বর হারিয়ে ফেলেন।
এবারের জনজাগরণের চরিত্রটা অনেকটাই আলাদা। ফ্যাসিবাদ বিরোধী যে ঝড় উঠেছে, তার স্বতঃস্ফূর্ততা রাজনৈতিক দলগুলোকে চমকে দিয়েছে। অর্থ আর পেশিশক্তির জোরে ভোটবাজারে জিততে অভ্যস্ত নেতা নেত্রীরা এই গণ উত্থানকে বিশ্লেষণ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। যে মুসলিম সমাজকে এতদিন তাঁরা দুধেল গাই হিসেবে ব্যবহার করেছেন, তারা হঠাৎ নাগরিকত্বের বুনিয়াদি অধিকারগুলো দাবি করে বসায় চেনা অঙ্কগুলো ঘেঁটে গেছে। ক্যা-এনআরসি বিরোধী সভা সমাবেশগুলো থেকে ধারাবাহিক ভাবে রুটি রুজির মৌলিক প্রশ্নগুলো উঠে আসছে। শ্রমিক-কৃষক-জনজাতি ওপর যে ভয়ঙ্কর আক্রমণ নেমে এসেছে গত ছয় বছরে, তার বিরুদ্ধে নাগরিক স্বর ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। উঠে আসছে দশকের পর দশক ধরে বিভিন্ন শাসকের আমলে জাতি-ধর্ম-ভাষাভিত্তিক বৈষম্যের কথাও। আর এতেই বিপাকে পড়েছে তৃণমূল-সিপিএম-কংগ্রেস সহ তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো। তাদের ভিতরেও বাসা বেঁধে আছে ব্রাহ্মন্যবাদের যে শিকড়, এই আন্দোলন তাকে নগ্ন করে দিয়েছে। আজাদীর সাথে সাথে জয় ভীম স্লোগানেও যখন উত্তাল হয়ে উঠছেন মিছিলে পা মেলানো জনতা, তখন বর্ণহিন্দু নেতারা অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগতে শুরু করেছেন। এমনকি তাদের কর্মীদের একটা বড়ো অংশ আজ নিজের নিজের দলের ওপর আস্থা হারিয়ে নাগরিক মঞ্চগুলোর পতাকার তলায় জড়ো হচ্ছেন। সেই নিরাপত্তাহীনতার জায়গা থেকেই হয়ত মুর্শিদাবাদের জলঙ্গীতে এনআরসি-ক্যা বিরোধী জমায়েতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী, গুলির আঘাতে প্রাণ যায় আন্দোলনকারী সাধারণ মানুষের। যে "প্রগতিশীল শহুরে বিপ্লবীরা" মোদীর বিরুদ্ধে লড়াইতে দিদির উপরে ভরসা করতে চাইছেন, এই ঘটনা তাদের চোখ খুলে দেবে কিনা তাতে সন্দেহ আছে। যে ব্যাপারে সন্দেহ নেই, তা হলো বিজেপি বিরোধী লড়াইতে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থান আজ সময়ের দাবি হয়ে উঠছে। বিভিন্ন মঞ্চে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষকে এবার সংগঠিত হয়ে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে হবে।
দেশব্যাপী এই আন্দোলনে সংখ্যালঘু মহিলাদের ব্যাপকহারে উপস্থিতি এতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে- ব্রাহ্মন্যবাদের সাথে সাথে পিতৃতন্ত্রের কাঠামোকেও চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছেন শাহীনবাগ-পার্ক সার্কাসের মা-বোনেরা। দাড়ি-টুপি-হিজাব এক ঝটকায় আত্মপরিচয়ের অস্ত্র হয়ে উঠেছে, আবার একই সাথে এই আন্দোলন মুসলমান মহিলাদের বহির্জগতের সাথে মেশার সুযোগ করে দিয়েছে। আমি নিশ্চিত, আজ যে হিজাব পরা মা শিশু কোলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন, আগামীদিনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিনি হিজাব খোলার স্বাধীনতা চেয়েও একইরকম ভাবে সরব হবেন। লিঙ্গসাম্যের লড়াইয়েও আমাদের এক ধাক্কায় অনেকখানি এগিয়ে দিলো এই আন্দোলন, বহু মানুষ যাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ বলে সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছেন।