পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

এই মায়াবী স্বপ্নের অপমৃত্যু কখনই কাম্য নয়

  • 17 December, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1457 view(s)
  • লিখেছেন : রুদ্র সান্যাল
আবার একটা সংশয় তৈরি হয়েছে, করোনার আরও একটি নতুন রূপ 'ওমিক্রন' এসে যাওয়ার কারণে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন এই রূপটি হয়তো আরও ভয়াবহ, আবার নাও হতে পারে। যদিও এই ভয়াবহ বাক্যবন্ধটি শুনতে শুনতে পৃথিবীর সব কৃষ্টিশীল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র গুলি আজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম! বিদ্যালয়গুলি তার অন্যতম নিদর্শন।

দীর্ঘদিন করোনা অতিমারির পর এখন বিদ্যালয় গুলি খুলেছে। আবার ছেলে মেয়েদের উচ্ছসিত কৈশোরের শব্দ গুঞ্জনে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ভরে উঠেছে। মাঝে দুইমাস বাদ দিয়ে,শুধু মিড ডে মিল দেওয়া ছাড়া প্রায় পৌনে দুই বছর বিদ্যালয় গুলি বন্ধ ছিল। যা সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক চূড়ান্ত আঘাত বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

তবুও আবার একটা সংশয় তৈরি হয়েছে, করোনার আরও একটি নতুন রূপ 'ওমিক্রন' এসে যাওয়ার কারণে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন এই রূপটি হয়তো আরও ভয়াবহ, আবার নাও হতে পারে। যদিও এই ভয়াবহ বাক্যবন্ধটি শুনতে শুনতে পৃথিবীর সব কৃষ্টিশীল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র গুলি আজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম! বিদ্যালয় গুলি তার অন্যতম নিদর্শন।

কিন্তু সত্যি বলতে বিদ্যালয়কে ছাড়া শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজেরাও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। সামাজিক ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষের কাছে কেমন যেন অচ্ছুৎ হয়ে পড়েছিলেন সবাই। কেমন তির্যক মন্তব্যের মাঝে নিজেদের এক অসহায় অবস্থায় থাকতে হচ্ছিল। যেকোন জায়গায় কথায় কথায় "বসে বসে মাইনে নিচ্ছেন" এই কথা শুনতে হচ্ছিল তাঁদের। অথচ তাঁরা কি দোষ করলেন? এমন একটা ভয়ানক অতিমারি এই প্রজন্মের শিক্ষক- শিক্ষিকা বা শিক্ষার্থীরা কেউ দেখেনি। একদিকে বিদ্যালয় খুললেও বিপদ। আবার না খুললেও সমাজব্যবস্থায় একটা প্রজন্মের চূড়ান্ত বিপর্যয়। সত্যিই এক অসহনীয় অবস্থা চলছিল। এখন ও পুরোপুরি পরীক্ষিত নয় এমন ভ্যাকসিনের সহায়তায় আমরা এখন ও অবধি বেঁচে রয়েছি। তবে অল্প বয়সী শিক্ষার্থীদের কেও ভ্যাকসিন দেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। না হলে পরবর্তী ক্ষেত্রে কি হবে তা বলা যায় না। যাক তবুও বিদ্যালয় খোলাটা খুবই দরকার ছিল।

এই পৌনে দুই বছরে যদি সত্যি কারের হিসেব করা যায়, তাহলে দেখা যাবে প্রচুর প্রান্তিক অঞ্চলের আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর ছেলে মেয়েরা সংসার চালানোর তাগিদে বিদ্যালয় ছুট হয়ে গিয়েছে। হয়তো বিভিন্ন রাজ্যে চলে গিয়েছে শিশু শ্রমিক হিসেবে। যতই আমরা শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে সেমিনার বা প্রচার, যাই করিনা কেন, শেষ পর্যন্ত কিন্তু শিশু শ্রমকে আটকাতে কিন্তু পারিনি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। স্বাধীনতার প্রায় পঁচাত্তর বছর পরেও এই দুর্ভাগ্যের শিকার আমাদের দেশ। অথচ সংবিধানে লিখিত আকারে কত ভালো ভালো কথা বলা ছিল, এক স্বচ্ছ ভারতবর্ষ তৈরি করার কথা! রাজনৈতিক নেতৃত্বের ও স্বদিচ্ছা ছিল বলেই সাধারণ মানুষ ভেবেছিল, ইংরেজ শাসনের পর এক নতুন ভারতবর্ষ তৈরি হবে। কিন্তু কোথায় কি? সব যেন শুধু সংবিধান নামক এক বইয়ের পাতায় মধ্যে তা রয়ে গেছে। বাস্তব বড়ই কঠিন!

করোনা কালে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এক ভয়াবহ বিপর্যয় এসে গেছে। অনলাইন ক্লাসের উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকার কারণে প্রান্তিক অঞ্চলের মেধাবী প্রান্তিক এবং আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্র ছাত্রীরা ইচ্ছে থাকলেও সেই পড়ার থেকে বঞ্চিত। ফলে একটা জাতির মেরুদন্ড তৈরি হয় প্রাথমিক শিক্ষার সময় থেকে। সেই অবস্থাই এখন ভয়াবহ রকম ভঙ্গুর। উন্নত বিশ্বে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমরা যদিও শিক্ষা নীতিতে এই কথা গুলো বলি ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন কতটা হয়, তা প্রশ্ন স্বাপেক্ষ। একদিকে অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো অন্যদিকে জাতীয় শিক্ষা নীতিতে যেসব কথা বলা হয় তা বাস্তবায়ন করা অনেকটা যেন সোনার পাথরবাটির মতন। অনেক স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে যায় শিশু শ্রমের মাধ্যমে। এত দিন যা রাখঢাক করে ছিল, তা এখন এই করোনা কালে প্রকট ভাবে সামনে পরিলক্ষিত হচ্ছে। মিড ডে মিল দেওয়ার সময় ও প্রান্তিক অঞ্চলের বিদ্যালয় গুলির অভিভাবকরা রীতিমত অসহায় ভাবে জানান কবে বিদ্যালয় খুলবে? অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে যান শিক্ষক- শিক্ষিকারা। অথচ সব দিক থেকেই খুবই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি। কিছুই কি করার ছিল না কেন্দ্র রাজ্য কোন সরকারের? যেভাবে অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে ক্লাস করার কথা বলা হয়েছিল, তা কিছু ছাত্র ছাত্রীরা ক্ষেত্রে হয়তো সুবিধা হয়েছিল। কিন্তু বিপুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে তা খুবই কম শতাংশ মাত্র। বেসরকারি বিদ্যালয় গুলির আর্থিক ভাবে মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবার গুলির ছেলে- মেয়েরা কিছুটা সুবিধা করতে পেরেছিল। এটা অস্বীকার করা যায় না। তবুও ছাত্র- শিক্ষক মুখোমুখি শিক্ষাদানের বিকল্প তা কোনদিনই হতে পারে না। হয়তো সব সরকারেরই সদিচ্ছা ছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোথাও একটা খামতি থেকে গেছে। এর ফল হলো, বেশ কিছু ছাত্র ছাত্রীরা মায়াবী স্বপ্নের অপমৃত্যু। যা একেবারেই কাম্য ছিল না।

সরকার বিদ্যালয় পরিকাঠামোর উন্নয়ন করার জন্যে টাকা দিচ্ছেন। সেই টাকা কতটা সঠিক ভাবে খরচ করা হয়, তা লক্ষ্য করার জন্যে একটা মনিটরিং টিম তৈরি করছেন। কিন্তু তাতে সেই সব বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের ও স্বক্রিয় ভাবে যুক্ত করা উচিত। যাতে তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন কি খরচ তাঁদের দরকার বিদ্যালয় পরিকাঠামোর পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে। প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ভালো। কিন্তু প্রধানশিক্ষকদের ও একটা ভূমিকা থাকা উচিত।

উন্নত বিশ্বে জাপানের বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থা সবচেয়ে ভালো বলে শোনা যায়। সেখানে কয়েক বছর অন্তর অন্তর সরকার, অভিভাবক এবং শিক্ষাবিদ দের সাথে নিয়মিত আলোচনা করে শিক্ষার উন্নতিকল্পে নীতি নির্ধারণ করে। স্বাভাবিক ভাবেই তাতে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশের অভিভাবকদেরকেও জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরির ক্ষেত্রে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করালে হয়তো অনেকটাই বাস্তব সম্মত ভাবে শিক্ষানীতি রূপায়ণ করা যেতে পারতো। হয়তো অনেকেই বলবেন, যে দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের অধিকাংশ অভিভাবক নিজেরাই শিক্ষার আলোতে বিকশিত হতে পারেন নি, তারা এই ক্ষেত্রে কি ভূমিকা নেবেন? তবুও একটা চেষ্টা তো করা যেতে পারে।

সর্বক্ষেত্রেই রাজনীতিকরণ আমাদের দেশে যেভাবে ছাত্র সমাজকে গ্রাস করে ফেলছে তাতে শিক্ষাব্যবস্থার হাল ফেরাতে গেলে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে আশু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

পরিশেষে একটা কথাই বলার, ওমিক্রন আসছে ঠিকই, কিন্তু এটাই যে শেষ করোনার রূপ হবে, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই প্রতিবার যদি বিদ্যালয়গুলি করোনার এই বিভিন্ন রূপের কারণে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এক ভয়াবহ ধাক্কা লাগবে। এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড এই কথাটি কেবলমাত্র পুঁথিগত ক্ষেত্রেই আবদ্ধ থাকবে। বাস্তবে নয়। তাই এখন থেকেই সুষ্ঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে বিদ্যালয় গুলিকে খুলে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে এরকম অতিমারিতে অনেক মায়াবী স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটবে। যা কাম্য নয় কখনই।
-------------------

0 Comments

Post Comment