আবারও একটা কার্ড!
খানিকটা হতভম্বই হয়ে পড়ে অনিমেশ। রাতে বাড়ি ফেরার পর ডলি তাকে বলে, পুরসভার লোকেরা এসেছিল। বলে গেছে নতুন কার্ড লাগবে আরেকটা। শুধু ডান হাতের তালুর একটা ছবি তোলাতে হবে। পুরানো কার্ড সমস্তই নাকি বাতিল।
কবে থেকে বাতিল?
তা ওরা বলেনি। তবে বলেছে হাতের ছবি তোলা পরের মাসের প্রথম শনিবার। ও দিন গার্লস স্কুলে যেতে হবে।
কিন্তু এই যে সে দিন ‘আধার’ হল। এত খেটেখুটে করালাম। ডেট পার হয়ে যাওয়ায় কমিশনারের লোককে টাকা দিয়ে নতুন ডেট আনালাম। এর মধ্যে ‘আধার’ অচল!
কী আর করা যাবে বলো। আমাকে যা বলে গেল তাই তোমাকে বললাম। ওরা বলল সরকারের নতুন আইন।
এ বারে কার্ডের নাম কী হবে?
ডলি বলে, তা ওরা বলেনি। কিংবা আমি বুঝতে পারিনি। পরে তুমি শুনে দেখ।
অনিমেশ অবাক হয়ে হাত-পা ধুলো। রাতে টিভি দেখল খানিক। তারপর খেয়েদেয়ে শুতে চলে গেল।
তবে দু-এক দিনের ভেতরেই নতুন কার্ডের কথা শুনে ফেলল ও। ট্রেনে যাদের সঙ্গে যায় তারাও সবাই জেনে গেছে। তাদেরও সবার বাড়িতে জানিয়ে দিয়ে গেছে। এ ছাড়া টিভিতে দেখাল। কাগজে বের হল। পুরসভা থেকে মাইকে ঘোষণা করল দু দিন। নতুন কার্ড চালু করতে চলেছে সরকার। পাম কার্ড। হাতের তালুর কার্ড। ভারতীয় নাগরিকত্বের এক মাত্র পরিচয় পত্র। ছ মাস পর থেকে কার্যকর হবে। না থাকলে নাকি দেশের বাইরে।
ট্রেনের ঘোষদা বলল, ভালো কথা, ডান হাতের তালুর ছবি থাকবে। কিন্তু যাদের ডান হাত নেই তাদের কী হবে! যেমন হাত-কাটা কার্তিক।
অভিজিৎ কলকাতায় বেসরকারি সেক্টরে কাজ করতে যায়। ট্রেনে সবার সঙ্গে কল্যাণী থেকে যাতায়াত। খুব তাড়াতাড়ি বউ নিয়ে কেষ্টপুরের ফ্ল্যাটে চলে যাবে। ওর কাছে সব সময়ই অ্যাডভান্স খবর। ও বলল, পাম কার্ডের আইডিয়াটা অদ্ভুত। বিদেশে অনেক আগেই চালু হয়ে গেছে। পৃথিবীর প্রতিটি লোকের হাতের তালুর কাটাকুটির ছাপ আলাদা। বেস্ট প্রমাণ অব আইডেন্টিফিকেশন।
তবে হাত-কাটা কার্তিক?
অভিজিৎ বলল, ও ব্যাপারেও গভ-ডট-ইনে ডিটেলস লেখা আছে। ঢুকে পড়ে নিন। যার ডান হাত থাকবে না তার বাঁ হাতের তালু। দু হাত না থাকলে বাঁ পায়ের তলা। বাঁ পাও না থাকলে ডান পা।
আর যার তাও নেই? তেমন যদি কেউ হয়! ভারতের নাগরিক।
অভিজিৎ বলল, না সে ব্যাপারে আর বলা নেই। তবে এর মধ্যে আশা করি সবাই এসে যাবেন।দু-এক জন এক্সেপশানাল থাকলে তাদের হয়ত হবে না।
কিন্তু এত দিনের এত রকম কার্ড! এত ঘটা, এত ছবি তোলা। এর ছবি ওর ঘাড়ে, তিন বার হেঁটে সংশোধন। এ সব যে করা হল তা আর থাকছে না?
পাম কার্ড ইজ পাম কার্ড। অভিজিৎ জানাল। উগান্ডায় দু বছর আগে চালু হয়ে গেছে। এটা থাকলে আর কিছু লাগে না।
কিন্তু অনিমেশের খটকা অন্য জায়গায়। ও ভালো করে পড়ে দেখল পুরানো সব কার্ড তো লাগবেই, সঙ্গে আবার সেই বার্থ সার্টিফিকেট। যেটা ওর নেই। কোনও কালেই ছিল না।
পঞ্চাশ বছর বয়সে পৌঁছে ও মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিল জন্ম-সার্টিফিকেট ছাড়াই একটা জীবন চালিয়ে নেওয়া গেল। অন্যান্য কার্ডে কাজ মিটে গেল। কিন্তু ফের জন্ম-সার্টিফিকেট চাইলে কার কাছে যাওয়া যাবে এখন!
নানা রকম গোলমালে ওদিকের দেশ ছেড়ে যখন চলে আসা তার তখন এত টুকু বয়স। বাবা-কাকা-জ্যাঠারা মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুই শুধু করতে পেরেছিলেন। তারপরই এল বাপ-কাকাদের রেশন কার্ড জোগাড়ের প্রশ্ন। রেশন কার্ড ছাড়া সরকারি রেশন মেলে না। এ দেশে কেউ যেন সে ভাবে পাত্তাও দিতে চায় না। ইস্কুলে বাজারেও কেমন কেমন চোখে দেখে। তখন জোগাড় হল রেশন কার্ড। তখন কংগ্রেসি আমল। এলাকার কংগ্রেসের নেতা তখন বৈকুন্ঠ রায়। ধুতি পাঞ্জাবি। বাবা-জ্যাঠাকে বলেছিলেন, এসে যখন পড়া হয়েছে তখন তো দেখতেই হবে। মিসেস গান্ধীও পুনর্বাসন নিয়ে নানা রকম ভাবছেন। রেশন কার্ডের ব্যাপার দলের হয়ে যারা দেখাশুনা করে তাদের বলে দেবখন।
দলের তরফে দেখত অশোক বলে এক জন। কম বয়স, রোগা চেহারা। পাজামা, পাঞ্জাবি। দেখা করায় বলেছিল, হয়ে যাবে, তবে অল্প টাকাপয়সা কিন্তু দিতে হবে। বৈকুন্ঠদার কাছেই যাবে সেটা। আপনারা কিছু বলবেন না।
হয়ে যাওয়ার পর কংগ্রেসি নেতা বৈকুন্ঠ রায় বলেছিলেন, ভোটটা কিন্তু ঠিক সময় ঠিক জায়গায় দিও। সব কিছু বুঝে উঠতে না পারলে এ বারে যেয়ো না। দলের হয়ে অশোকরাই যেখানে যেমন দেওয়ার দিয়ে দেয়।
রেশন কার্ড বেরিয়ে গিয়েছিল। তাই দিয়ে চলল অনেকগুলো বছর। রেশন তোলা হল। লেখাপড়া হল। কোনও রকমে একটা ঠাঁই হল এ দেশের মাটিতে। তারপর অনেক বছর পর অন্য কথা, আবার অন্য গল্প। ভোটার আই-ডি। সেটাই নাকি সব। সব ভারতীয় নাগরিককে ভোটার কার্ড জোগাড় করে ফেলতে হবে।
অনিমেশ তখন ছোটখাটো একটা কাজ করে। কলকাতায় মাঝেমাঝে যাতায়াত। বাবা জ্যাঠারা নেই। কাগজে পড়ে আর সাদাকালো টিভিতে দেখে জানল ভোটার কার্ডের জন্য প্রথমে ডকুমেন্ট নিয়ে ছবি তোলাতে যেতে হবে এলাকার কোথাও। তার জন্য ডেট দেওয়া হবে। ছবি তোলার পর কার্ড বেরিয়ে যাবে।
ছবি তোলার ব্যাপারে ভোটার তালিকয় নাম থাকতে হবে। যা অনিমেশের ছিল। রেশন কার্ড নিয়ে যেতে হবে। তাও ছিল। আর নিয়ে যেতে হবে জন্ম-সার্টিফিকেট। যা তার নেই। কী হবে!
তখন কংগ্রেস জমানা শেষ। এলসিএস-দের আমল এসে গেছে। পার্টি অফিসে এমএলএ বসেন ঠিকই কিন্তু এলাকা চালায় লোকাল সেক্রেটারি। লোকাল সেক্রেটারি মন্টু দেব। এক সময় নাকি শ্রমিক সংগঠন করত। পার্টি ক্ষমতায় আসার পর বড় মাপের নেতা। এম-এইট্টি চালিয়ে পার্টি অফিসে আসে। লাল কালিতে সই করে দিলে বাস-লরির পারমিট বেরিয়ে যায়।
জন্ম সার্টিফিকেট ছাড়া ভোটার আইডি বার করার ব্যাপারে এক সকালে অনিমেশ তার বাড়ি গেল। লিকার চায়ে চুমুক দিয়ে মন্টু দেব বলেছিল, ব্রিগেড যাওয়ার দিন তো দেখিনি। এলাকার মিটিং মিছিলে এসেছেন কখনও?
অনিমেশ আমতা-আমতা করছিল। তখন মন্টু দেব বলল, ঠিক আছে, ছবি তোলার ঘরে তো আমাদের কমরেডরাই বসবে। ওদের বলে রাখবখন। তবে গণশক্তির লাইফ মেম্বারশিপটা এ বার নিয়ে নিতে হবে। সঙ্গে পার্টি ফাণ্ডে সামান্য কিছু ডোনেশন।
অনিমেশ রাজি। ভোটার কার্ড বেরিয়ে গেল। সংসার হল। কলকাতায় মোটামুটি একটা কাজ হল। বউয়ের কোলে একটা মেয়ে। জীবন চলে যাচ্ছিল। তারপর এল পরিবর্তনের ঢেউ। ঢেউ বা সুনামি। সুনামি বা আয়লা।
ঠিক আছে। এ সব দেখেদেখেই তো জীবন কেটে যাবে। কিন্তু গোল বাঁধল অন্য জায়গায়। কেন্দ্র সরকারের আবার ঘোষণা। আধার কার্ড। ‘আধার’ই নাকি সব। আধার ছাড়া ভবিষ্যৎ আঁধার। তার জন্য আবার এক দিন সেই ছবি তোলাতে যেতে হবে। এবং সঙ্গে অবশ্যই বার্থ সার্টিফিকেট অরিজিনাল।
নেই। ফলে কাকে ধরে কার কাছে যায়। কার্ডের চক্করেই জীবন চলতে থাকবে নাকি! এলাকায় তখন নতুন নেতা, নতুন দল, দলীয় অফিস। অফিসের সামনে এলোমেল চেয়ার। অনিমেশ যে দিন হাজির হল তখন ব্লক যুবর সম্পাদক দলীয় অফিসে। কোনও ক্রমে অনিমেশ বলতে পারল সমস্যাটা। যুব সম্পাদক পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে বলল, ওরা আপনাকে জম্ম সাট্টিফিকেট বানিয়ে দেয়নি? আপনাকে দেয়নি, আরও অনেককে দেয়নি। তবে কী করল ওরা চৌত্রিশ বছর! অবশ্য দেবেই বা কী ভাবে, ওদের পার্টিরই তো ও সবের ঠিক নেই।
অনিমেশ কাঁচুমাচু। তখন পাশের এক জনকে ডেকে যুবদা বলল, দাদার কেসটা দেখবি। দাদা ভালো লোক। সন্ধের পর তোদের খাইয়ে দেবে এক দিন।
ক্যামেরায় চোখ ঠেসে আধারের ছবি তোলা হয়ে গেল। কার্ড এল। নিশ্চিন্তে থাকা গেল বেশ কিছু দিন। তারপর আবার এখন এই নতুন ঘোষণা। হাতের তালুর ছবি। কী ভাবে কী হবে কে জানে...!
যদিও টিভিতে-কাগজে জানা গেল পাম কার্ড তোলাতে বার্থ সার্টিফিকেট চাওয়া হচ্ছে না। রেশন, ভোটার, আধার সঙ্গে করে নিয়ে গেলেই চলবে। পাশাপাশি ভোটার তালিকায় নাম থাকা চাই। তা হলেই হবে।
খানিকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল অনিমেশ। এত দিনে সরকার তবে মুখ তুলে চেয়েছে। সবার কথা ভেবেছে। বাধ্য হয়ে যারা এক দিন এ দেশে চলে এসেছিল, এত কাল ভোট দিল, তাদের ছেলেপুলের কথাও ভেবেছে।
ট্রেনের সবজান্তা আই-টি সেক্টর অভিজিৎ বলল, বেসিক্যালি গভমেন্ট এই আইডিয়াটা নিল স্টেটস্ থেকে। ওদের গ্রিন কার্ড। সেটা অনেকটাই কমপ্লিট আইডেন্টিটি। তবে ওরা তো এখন মাইগ্রেশন আটকাতে গোটা দেশের জেনেটিক ম্যাপিং করবে ভাবছে। সেই সঙ্গে পারসোনাল জিন কার্ড।
ঘোষদা বললেন, এই যে সে দিন বললে উগান্ডার আইডিয়া!
অভিজিৎ বলল, স্টেটস্ থেকে প্রথম নিয়েছে উগান্ডা। তারপর ইণ্ডিয়া।
ঘোষদা এদিক-ওদিক দেখে বলেন, আমাদের এখানে অবশ্য একটা অন্য ব্যাপার আছে। সরকার বদলালে কার্ড বদলে যায়। এর পর নতুন কেউ এলে তারা বলবে আগের সব কিছু বাতিল। সব কার্ড অচল। শুধু মাত্র বাঁ দিকের বগলের একটা ছবি তুলে ল্যামিনেট করিয়ে রাখতে হবে। বগল কার্ড। ন্যাও, তখন সবাই সেই ছবি তোলাও।
অনিমেশ ট্রেনের জানালার পাশ থেকে বলল, সে ছবি তোলাতেও কি জন্ম সার্টিফিকেট লাগবে দাদা?
ঘোষদা বললেন, কিচ্ছু বলা যায় না। এ জন্মের না হোক গত জন্মের সার্টিফিকেট চেয়ে বসতেই পারে।
যদিও হাতের তালুর ছবি তোলানোর ডেট পাওয়া গেল এক দিন। অনিমেশ অফিস ছুটি করল। বউকে সঙ্গে নিয়ে গেল শশীবালা গার্লস-এ। গিয়ে লাইনে দাঁড়াল। জন্ম সার্টিফিকেট চাওয়া হচ্ছে না।
পরপর সবাই একটা ঘরে ঢুকছে। সেখানে বিডিও অফিসের লোক, ছবি তোলার লোক। আরও কারা কারা বসা। এক-এক জন করে একটা কাঁচের বাক্স মতো মেশিনের ওপর ডান হাতের তালু রাখতে হচ্ছে। পুক করে একটা শব্দ। তারপর পরের জন।
তার আগে অবশ্য বিডিও অফিসের ভোটার তালিকায় নাম মেলানো হচ্ছে। টিক দেওয়া হচ্ছে। যারা-যারা হাজির পাশে তাদের সই। সইয়ের টেবিলে শৌখিন সাজের এক ভদ্র মহিলা। অফিসিয়াল। সই মিলিয়ে নিচ্ছেন।
রিটায়ার্ড হেড-মাস্টার ভবেনবাবু এসেছেন ছাতা নিয়ে। সই করতে করতে বললেন, তা তালু কার্ড আমরা কবে নাগাদ পাচ্ছি? তার জন্য আবার আসতে হবে, নাকি বাড়ি পৌঁছে যাবে।
বিডিও অফিসের ভদ্রলোক বললেন, সে ব্যাপারে এখনও কোনও জিও বেরোয়নি। ফলে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।
অনিমেশের সামনে গৌরব দত্ত। এলাকার প্রোমোটার। গলায় সোনার চেন। বাইরে পালসার বাইক। বাক্সের কাঁচে হাত রাখতে বলায় বাঁ হাত দিয়ে কবজির ওপর থেকে স্টিলের বালাটা সরাল। বাক্সের ভেতরটা দেখল। তারপর চড় মারার মতো ধপ করে ডান হাতের তালুখানা রাখল কাঁচের ওপর।
সবাই ঘুরে দেখল। বিডিও অফিসের লোকের লাফিয়ে ওঠার মতো অবস্থা। সইয়ের ভদ্রমহিলা আতঙ্কিত। তবে পুক শব্দটা হওয়ায় কেউ কিছু বলল না।
এর পর অনিমেশ। সই-টই আগেই সারা। তবু অল্প-অল্প ঘাম হচ্ছিল তার। সে এগিয়ে ডান হাতের তালু বাক্সের কাঁচে নামাল।
ভেতরে নীলচে একটা আলো। আলোর নিচে আবছা অশোক স্তম্ভের ছাপ। অনিমেশ অবাক হয়ে ভেতরটা দেখল।
হাত ছুঁইয়ে আছে সে। ছুঁইয়েই আছে। শব্দ তো হয় না। কারও তো এত ক্ষণ লাগেনি। অশোক স্তম্ভের ছাপে প্রোমোটারেরর চড় পড়ায় মেশিন বিকল হয়ে গেল নাকি। অশ্বস্তি হয় অনিমেশের।
ছবির দায়িত্বে থাকা এক জন উঠে আসে তখন। ভেতরটা দেখে। পাশের একটা স্যুইচ অফ অন করে। অনিমেশকে বলল হাতটা তুলুন তো। অনিমেশ হাত সরিয়ে নিল। আবার রাখুন। অনিমেশ আবার হাত রাখল। শব্দ কিন্তু হল না।
পরের কেউ আসুন তো। পেছনে অনিমেশের বউ ডলি। খানিকটা ঘাবড়ে গেছে সে-ও। ভয়েভয়ে এগিয়ে হাত রাখল মেসিনের কাঁচে। বাক্স শব্দ করে উঠল।
মেশিন ঠিক হয়ে গেছে তা হলে। আবার অনিমেশ। বিডিও অফিসের লোক পাশে দাঁড়িয়ে। পাশে ডলি। এ বারও কোনও শব্দ হল না।
অনিমেশ ঘাবড়ে একাকার। তার থেকেও ভ্যাবাচ্যাকা ছবি তলার লোক, অফিসের লোকেরা। লাইন আটকে গেছে। অনিমেশকে দেখছে সবাই। আবার স্যুইচ অন অফ। আবার হাত রাখা। শব্দ নেই।
বিডিও অফিস বলল, আপনার অন্য কার্ড-ফার্ড সব আছে? প্যান-ফ্যান সব?
সব আছে স্যার।
ছবি তোলা বলল, দেখি হাতের পাতা ওল্টান। তালু দেখান তো।
অনিমেশ দু হাতের পাতা ওল্টাল।
ছবি তোলা তখন একেবারে অবাক। বিডিও অফিসকে বলল, দেখুন স্যার দেখুন, একটা লোক যার হাতের তালুতে কোনও রেখা নেই, দাগ নেই। একবারে সমান। মেসিন রিড করবে কোত্থেকে!
তখন পাশ থেকে লাইন চালু করে অন্যদের ছাপ নেওয়া চলতে থাকল। টেবিল সরিয়ে এনে রীতিমতো গবেষণা চলতে থাকল অনিমেশকে নিয়ে। ওর হাতের তালু নিয়ে।
আগে খেয়াল করেছেন? কত দিন ধরে এ রকম? জন্ম থেকেই নেই না কি পরে এমন হয়েছে? সই নেওয়া ভদ্রমহিলা সরু হয়ে গিয়ে বললেন, বাবা, দেখলেও কেমন ভয় করে। গা শিরশির করে ওঠে। একটা লোকের কোনও ভাগ্য রেখা নেই?
অনিমেশ বলে, ছেলেবেলায় ছিল। পরে ধীরেধীরে হালকা হয়ে গেছে। গত প্রায় চল্লিশ বছর এ রকম।
চল্লিশ বছর...?
অনিমেশ বলল, তা তো হবেই।
ডলি চুপ হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে। অন্য দিকে লাইন চলছে। বিডিও অফিস বলল, আপনার পাম কার্ড হবে না। হাত থাকতে হাতের ছবি না উঠলে কী হবে তার জিও নেই।
তখন পাশের সেই সই করানো ভদ্রমহিলা নরম গলায় বলেন, ছোটবেলায় ছিল বলছেন, তখন থাকতেন কোথায়?
অনিমেশ ভাবল একটু। তারপর বলল, পাঁচমুড়া পাহাড়, শ্যামলী নদী... নাম শুনেছেন!
না, মানে এ দিকে তো অনেক জায়গায় শুনি আর্সেনিক। সে সবে তালুর চামড়া এমন হয়ে গেল কিনা। আগে কি অনেক দূরে থাকতেন?
অনিমেশ বলল, সে একটা অন্য জায়গা। অনেকই দূর। বহু দূর।
অনিমেশ তখন খানিকটা প্রকৃতিস্থ। বুঝে গেছে এ যাত্রা তালু কার্ড তার হচ্ছে না। ডলির হচ্ছে। সে বলল, ছোটবেলায় যখন এ দিকে আসি তখন আসার পথেই তালুর দাগ খানিকটা উঠে গেছিল। তারপর আরও কত রকম কার্ড। কত জনের পেছনে ঘুরলাম। এ-অফিস সে-অফিস। এ-দল, সে-দল। সে-সব করতে করতেই দেখেছি দাগ সব উঠে গেল।
পাশে লাইন চালু। শব্দ উঠছে বাক্স থেকে। বিডিও অফিস বলল, ছেড়ে দিন দিদি, ছেড়ে দিন।পরের লোকদের দেখুন। এ সব নিয়ে গভমেন্ট নতুন জিও পাঠালে তখন ভাবা যাবে। দাদা আপনি আসুন।