যেদিনে পাটনাতে বিরোধীদের বৈঠক হয়েছিল, তখনও নাম ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্স হয়নি, সেদিনই অনেকেই প্রশ্ন করেছিল, নীতিশের ওপর ভরসা করা যায় কি? কেবল তখন কেন? যেদিন নীতিশ কুমার ওরফে পালটু কুমার বিজেপির হাত ছেড়ে আর জে ডি র সঙ্গে সরকার তৈরি করলেন, সেদিনেই যাঁরা বিহার রাজনীতির সামান্য খবরাখবর রাখে সেই মানুষজন এই ভেঙে বেরিয়ে আসা নিয়ে কী বলেছিল? বলেছিল, ভারতীয় রাজনীতির এক জোকার নীতিশ কুমার বিজেপির হাত ছাড়লেন, কেবলমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর গদিটা বাঁচানোর জন্য। কিন্তু সেই তখন থেকেই তিনি বিরোধী দলগুলোর কাছে সেকুলার, আমরা বিলক্ষণ জানতাম কদিন পরেই দিল্লিতে কমিউনিস্ট কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি বা কমরেড ডি রাজার বা সি পি আই এম এল লিবারেশনের দীপঙ্কর ভট্টাচার্যদের সঙ্গে বৈঠকে দেখা যাবে ওনাকে। জোটে থাকলে ২০২৪ তে কেবল বিহার নয়, হিন্দীভাষী বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার করতে দেখা যাবে নীতিশ কুমার কে। তখন উলটোদিকে নরেন্দ্র মোদী তাঁর ভাষণে বলবেন বিরোধী দলগুলোর নেতাদের সততা নেই, তারা দেশপ্রেমিক নয়, তারা দেশের বিকাশের বিরুদ্ধে, উন্নয়ন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কাজ করছেন, যার মধ্যে এক ব্রাকেটেই থাকবেন নীতিশ কুমার। বিহারে গিয়ে মোদিজী বলবেন, পিছলা সরকার বিকাশ কা কাম রোক দিয়া থা, হাম ফির সে চালু করনা চাহতে হ্যাঁয়। এসবই আমরা জানতাম।
এ হল ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের মহিমা। এবং বামপন্থীরা, আবার সেই এক পুরনো খেলায়, আগেকার দিনে বিশেষ করে ব্রাহ্মণের ঘরের বিধবাদের মতই কেবল পেঁয়াজ আর রসুন পড়েনি বলে বলির পাঁঠার মাংস আর আমিষ নয় গোছের যুক্তি দিয়ে বিজেপির হাত ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নীতিশের এই পদক্ষেপ কে স্বাগত জানিয়েছিলেন, যদিও সরকারে অংশগ্রহণ করেন নি, সেটাও ছিল ঐ একই রকমের টগর বোষ্টমীপনা। কেবল ২০২২ এর আগস্ট মাসেই নয়, তার বহু আগে লালু যাদব বলেছেন এই মানুষটা আসলে পালটি কুমার, যে কোনও সময়েই পালটি খেতে পারেন। কিন্তু তিনিও কেবল ভোট বাড়ানোর তাগিদে স্বাগত জানিয়েছিলেন নীতিশের বিজেপি ছেড়ে আসাকে। তারপরে যেদিন কলকাতায় এসেছিলেন মমতার সঙ্গে দেখা করতে, সেদিনও আমরা অনেকেই একই কথাই বলেছিলাম, ওনার নিজস্ব এজেন্ডা আছে, সেই এজেন্ডা কোনও আদর্শের ভিত্তিতে নয়, সেই এজেন্ডা হল আরও বড় পদ, প্রধানমন্ত্রী না হলেও অন্তত রাষ্ট্রপতি। তো সেই নীতিশ কুমার আবার মহাগঠবন্ধন ছেড়ে বিজেপির হাত ধরলেন, আবার মূখ্যমন্ত্রী হলেন। আগস্ট ২০২২ এ কী বলেছিলেন, মরে যাবো কিন্তু বিজেপিতে যাবো না। কেবল কি উনি নাকি, উনকে লিয়ে সব দরওয়াজা হমেশা কে লিয়ে বন্ধ হো গয়া। কে বলেছিলেন? বিজেপির দুধু ভাতু সভাপতিকে বাদ দিলে বিজেপির দু নম্বর নেতা অমিত শাহ। তো সেটা তো জুমলা ছিল, এখন এটা প্রমাণিত। কিন্তু আজ এক অন্য আলোচনাতে আসা যাক। আচ্ছা আপনাদের কী মনে হয়? দেশের মধ্যে আমরাই কিছু মানুষ সর্বজ্ঞানী? আমরাই কেবল জানতাম যে নীতিশ কুমার পালটি বাজ নেতা, যে কোনও সময় পালটি মারতে পারেন? না তেমন তো নয়। উলটে আমি বলবো রাজনীতি সচেতন প্রত্যেক মানুষ, প্রত্যেক নেতা, প্রত্যেক দল জানতেন, জানেন যে আর যাই হোক নীতিশ কুমারের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা ছিলনা আজও নেই। তাহলে এই যে বার বার তাঁর শিবির বদল, সেটা জানা সত্ত্বেও তাঁকে কমিউনিস্ট, বামপন্থীরা সমেত বিভিন্ন শিবির বিভিন্ন সময়ে সঙ্গে নিয়েছেন, তাঁর দলের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন, তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করে রেখেছেন, এর কারণ কী? তিনি তো ভারতীয় রাজনীতির পরিচিত জোকার, কিন্তু খেলোয়াড় রিং মাস্টারেরা তাঁকে নিয়ে নেমেছেন কেন? একবার নয় বারবার।
প্রথমে আসুন নীতিশ কুমারের রাজনীতিটা বোঝা যাক। জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলন থেকে বিহারে যাঁরা উঠে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে তিনজনের নাম হল লালু প্রসাদ যাদব, নীতিশ কুমার আর সুশীল মোদী। জনসঙ্ঘের সুশীল মোদী তাঁর দলের জন্য, বেনিয়া, ব্রাহ্মণ রাজনীতির জন্যই পিছিয়ে পড়া রাজনীতির প্রতিনিধি কোনওদিনও হতে পারেন নি, তিনি বিহারের রাজনীতিতে হাইফেন হয়েই রয়ে গেছেন, এবারেও সেই হাইফেন, উপমূখ্যমন্ত্রী। অন্যদিকে শুরুয়াতি খেলায় লালু এগিয়ে গিয়েছিলেন, নীতিশ উচ্চ শিক্ষিত, নীতিশ লালুর মত মেঠো নয়, কিন্তু ঐ মেঠো রাজনীতির জন্যই লালু এগিয়ে গেলেন এবং নীতিশ সেই সময় থেকেই সুযোগসন্ধানী হয়ে ওঠার পাঠ নিতে থাকলেন। এরপর জনতা পার্টির ভাঙন, জনতা দল, সেও ভাঙলো, নীতিশ আর জর্জ ফার্নান্ডেজের সমতা পার্টি, বাজপেয়ীর মন্ত্রী সভা, এরপরে বিহারের মূখ্যমন্ত্রী পদ পিছলে পিছলে যাওয়া, প্রথমবারে তো মাত্র সাত দিনের মূখ্যমন্ত্রীত্ব, এরপরে ২০০৫ এ তিনি বিজেপির হাত ধরলেন, পাকাপোক্ত মূখ্যমন্ত্রী, তারপরে ২৯১৫ পর্যন্ত তিনিই শাসনে, মধ্যে জীতন রাম মাঞ্ঝির আট মাসের মূখ্যমন্ত্রীত্বের পরে তিনিই আবার, ২০১৫ তে মহাগঠবন্ধন, লালু নীতিশ, ২০১৭ র জুলাই জোট ভেঙে আবার বিজেপিতে, কিন্তু মূখ্যমন্ত্রী তিনিই। ২০২০ র নির্বাচনে তিনি ছোট দল, জনভিত্তি কমছে ১১৫, ৭৫ থেকে ৪৫ এ নেমে এসেছে তাঁর দল, কিন্তু তিনিই মূখ্যমন্ত্রী। ১০ আগস্ট ২০২২ এ বিজেপির হাত ছেড়ে লালু, কংগ্রেস বামেদের হাত ধরে আবার সেই মূখ্যমন্ত্রী, এবং আবার সেই জোট ছেড়ে বিজেপির হাত ধরলেন, এবং আবার সেই তিনিই মূখ্যমন্ত্রী। এক্কেবারে এইসময়েই এই ভাঙনের কারণ ও খুব পরিস্কার, নীতিশের দলের সাংসদেরা, বড় নেতারা নীতিশকে বুঝিয়েছেন রামমন্দির প্রাণপ্রতিষ্ঠার পরে বিহার রাম ময় হয়েই গেছে, এখন শিবির না বদলালে দল উঠে যাবে, হুমকিও এসেছে দল ভাঙার, ওদিকে নীতিশের এই নড়বড়ে অবস্থান কি লালু জানতেন না? সেখান থেকেও সম্ভবত নীতিশের দল ভাঙার একটা চেষ্টা চলছিল, কাজেই দল সামলাতে নীতিশ আবার শিবির বদল করলেন। কিছু বিধায়ক সকালে সন্ধ্যেতে দল ছেড়ে অন্য দলে গিয়ে পরের দিন আবার আরেক দলে গেছেন, আবার ধরুন চোখে আঙুল দাদা রুদ্রনীলের মতও তো লোকজন আছেন যাঁরা বাম থেকে তৃণমূল হয়ে আপাতত বিজেপিতে, কিন্তু এই মাপের একজন সর্বভারতীয় নেতার এতবার শিবির বদলের মত উদাহরণ আর একটাও নেই। জর্জ ফার্নান্ডেজ ছিলেন সমাজতন্ত্রী, তিনি বিজেপির সঙ্গে গেলেন, আর ফেরেন নি। নীতিশ কুমার সে দিকথেকে সত্যিই এক অনন্য রেকর্ডের অধিকারি, ২০০৫ থেকে মধ্যে আট মাস বাদ দিলে তিনিই মূখ্যমন্ত্রী কিন্তু বিহারের প্রত্যেক দলের মুখ্যমন্ত্রী তিনি হয়েছেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করেন আবার মুখ্যমন্ত্রী হবার জন্য। কিন্তু বাকিরা তা হতে দিল কেন? প্রথমে আসুন বিজেপির আলোচনায়। বিজেপি এ দেশের একমাত্র দল যাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক ফায়দার জন্য যা যা করার সব করতে পারেন, এবং এ দেশের বিভিন্ন রাজনীতির, বিভিন্ন পথের নেতাদের তাঁরা যে ভাবে ব্যবহার করেছেন তারও আবার কোনও তুলনা নেই।
বিহারের জাতিগত অবস্থানের দিক থেকেই ওখানে আর এস এস, জনসঙ্ঘ বা বিজেপির জমি বড্ড অনুর্বর। এখনও বিহারে বিজেপির ভোট ২০% এর নীচে, আর ২০% নিয়ে কোনও দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা আশা করতে পারে না, তাকে জোট করতে হয়, জোট ছাড়া বিজেপি ৪০ টা সাংসদ আসনের ৭/৮ টা ও পাবে না, বা বলা ভাল সেটা পেতেই প্রচুর ঘাম ঝরাতে হবে, ওদিকে লালু যাদব মুর্গি, গরুর খাবার সাবড়ে দিতেই পারে কিন্তু বিজেপির সঙ্গে জোটে যাবে না, না না ভুল বোঝার অবকাশ নেই, আদর্শ ইত্যাদি ছেঁদো কারণে নয়, এক বিরাট মুসলমান ভোট, বেনিয়া ব্রাহ্মণ বিরোধী যাদব কুলের ভোটে বলীয়ান লালুর পক্ষে সেটা আত্মহত্যার সামিল। কংগ্রেস বিজেপি বা বাম বিজেপি জোট হবে না, বাকি তো রয়েছে কেবল নীতিশ আর তার দল, কারণ ঐ পশুপতি বা চিরাগ পাশওয়ান আর দু টুকরো হওয়া লোক জনশক্তি পার্টি বা জীতন মাঞ্ঝির হিন্দুস্তানী আওয়াম মোর্চার ক্ষমতা সবার জানা, ওঁরা সাকুল্যে ৭/৮ % ভোট জুড়তে পারবেন, কাজেই নীতিশই ভরসা। এবং এই রামমন্দির প্রাণ প্রতিষ্ঠার পরে বিজেপির কাছে কিন্তু এক্কেবারে আলাদা ফিডব্যাক, তাঁদের সমীক্ষকেরা, তাঁদের দলের ভেতরের নির্বাচনী পন্ডিতেরা জানিয়েছেন ঠিক উল্টোটা, বিহার রামময় হয় নি, নীতিশ ছাড়া ভোটে লড়লে সাকুল্যে ৭/৮ টার বেশি আসন জুটবে না। কাজেই কাজে নেমে পড়েছিল বিজেপি, এক তো বিহারে অবস্থান একটু ভালো হবে, দুই, ইন্ডিয়া জোটকে ধাক্কা দেওয়া যাবে, এক তীর দো নিশানা। নীতিশকে ভাঙালো বিজেপি, অপারেশন লোটাস সাকসেশ। যদিও এটাও ঘটনা যে এই বিজেপি নীতিশ জোট টিঁকবে না, লোকসভা ভোটের পরেই মুখ্যমন্ত্রীত্বের প্রশ্নেই জোট ভাঙবে, যা খুশি তাই হতে পারে, কিন্তু একটা নিশ্চিত ঘটনা হবেই, নীতিশের রাজনীতির উপসংহার লেখা কিন্তু হয়ে গেলো, ওনার শেষ দিনগুলো না ঘর কা না ঘাটকা হয়েই থেকে যাবে। কিন্তু বিরোধী দলেরা, কংগ্রেস, লালু, বাম দলগুলো নীতিশের সঙ্গে জোটে রাজি হল কেন? বিরোধীদের ধারণা হয়েছিল বিজেপির গিলে খাবার চেষ্টার সামনে নীতিশের বিরোধী জোটে আসা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই, এবং পিছড়ে জাতির মানে নীতিশের কূর্মি, কৈরি জাতির ভোট যোগ হলে বিহারে বিজেপি ২/৩ টের বেশি আসন পাবে না, এই হিসেব মাথায় রেখেই এর আগেও নীতিশ লালু জোট হয়েছে, মহাগঠবন্ধন হয়েছে। এতক্ষণের আলোচনা থেকে একটা জিনিস তো পরিস্কার যে যে ধরণের জোটই হোক না কেন, তা কোনও আদর্শের ভিত্তিতে হয় নি, কোনও ধার থেকেই নয়, ছিল ভোটের ক্যালকুলেশন, বিভিন্ন জাতের ভোটের হিসেব নিকেশ, ছিল ধর্মের ভিত্তিতে ভোট ব্যাঙ্কের হিসেব নিকেশ। সংবিধান আদর্শ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, নিদেন পক্ষে বিকাশ উন্নয়ন এসবই কথার কথা, ওগুলো চটকদার বাহানা, রং চং এ মোড়ক মাত্র, আসলে সব্বাই তাদের নিজেদের ঘর গোছানোর জন্য, ক্ষমতা দখলের জন্য জোট বেঁধেছে। এমনকি আমরা যারা সত্যিই ধর্ম নিরপেক্ষ, সত্যিই আমাদের যাদের সংবিধানে আস্থা আছে, এক উদার গণতান্ত্রিক শাসন যাদের মাথায় আছে, সেই আমরাও যখন গত ১০ আগস্ট বিজেপি জোট ছেড়ে এই নীতিশ কুমারই বেরিয়ে এসে মহাগঠবন্ধনের সরকার তৈরি করেছিলেন, তখন আমরাও তো কোনও প্রশ্ন করিনি, আমরাও তো তখন মনে মনেই আনন্দিত হয়েছিলাম। আজ ঠিক উল্টোটা হবার পরে সেই আমরাই দুঃখিত, আমরাই পালটুরাম পালটুরাম বলে চিৎকার করছি সেই আমরাও তো তখনই জানতাম যে নীতিশ পালটুরাম। কেবল নির্বাচনী পাটিগণিত আর সরকার বানানোর, দখলে রাখার খেলেই যতদিন আমাদের রাজনীতির মূল বিষয় হয়ে থাকবে ততদিন এই নীতিশ কুমারেরা দল বদলাবেন। তবে আজ অন্তত একটা নিদান হাঁকার দিন এসেছে, মার্ক মাই ওয়ার্ড, নীতিশ কুমার এই লোকসভা নির্বাচনের পরে দল বদলানোর অবস্থাতেও থাকবেন না, তিনি দল বদলাতে চাইলেও আর বদলাতে পারবেন না, এইজন্য নয় যে দেশের রাজনৈতিক মূল্যবোধ হঠাৎ চাগাড় দিয়ে উঠবে, এইজন্য যে সব কিছুরই তো একটা এক্সপায়ারি ডেট থাকে, এই পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে নীতিশ কুমারের রাজনীতির পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে।