বাঙালি সম্বন্ধে প্রশ্ন চলবে?
প্রশ্ন চলতেই পারে, বা একটু বেশি রকমের প্রশ্ন করা যেতেই পারে। কিন্তু উত্তরের আর দরকার নেই। উত্তর নিজেদের মাথায় সেট করা আছে, এবং উত্তরের অপেক্ষা না করে কী পদক্ষেপ করা হবে তাও । বাঙালি জাহান্নামে যাক! বিশ্বায়নের যুগে এতটা প্রবেশ করেও যে এখনও মন্দির-মসজিদ, হিন্দু- মুসলিম, বঙালি-বিহারি ইত্যাদি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে - এই বিষয়টি খুবই পীড়াদায়ক! কোথায় আমরা এসবের ঊর্ধ্বে উঠে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে একসঙ্গে কাজ করবো, সমগ্র পৃথিবীর মানুষ আমার ভাই, বোন, বন্ধু হবে - সেই ভাবনা মাথায় না এনে আমরা এখন নানা বিভেদ ও ভাঙন বিষয়ে চর্চা করছি, যদিও এই চর্চা অনিচ্ছাকৃত। কিছুটা হলেও বাধ্য হয়েই এই চর্চা করতে হচ্ছে, করে যেতে হচ্ছে… কারণ বাঙালিই এখন কিছু নির্দিষ্ট মানুষের লক্ষ্য বা টার্গেট। বাঙালিকে নিয়ে প্রশ্ন যখন উঠছে - তখন উত্তর দেবার দায় আমাদের থাকে বৈকি!
সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ মনে পড়ছে। বিশেষ করে চিত্রনাট্য ও ছবির কথা বলছি… সেই রোমহর্ষক পরিস্থিতিতে লালমোহনবাবুর কাটা কাটা উচ্চারণে ফেলুদাকে করা প্রশ্নগুলো, - যা বিখ্যাত মজাদার সংলাপ হিসেবে এখনও প্রায় আমাদের সবার মুখে মুখে ফেরে!
উট সম্বন্ধে প্রশ্ন চলবে?
চলবে।
এগুলো কি বন্য উট?
সম্ভবত না।
ওদের খাদ্য কী?
প্রধানত কাঁটা ঝোপ।
কাঁটা কি ওরা বেছে খায়?
না।
আমি প্রশ্ন করবো না, শুধু একটি কথা বলব, পারি?
বলুন।
আপনাদেরও যদি বিপদের আশঙ্কা থাকে তবে আশা করবো আত্মরক্ষার উপযুক্ত অস্ত্র আপনাদের আছে।
হ্যাঁ। ভীষণভাবে হঠাৎ করেই মনে পড়ে যাচ্ছে এই প্রসঙ্গ। আর বিপদ মানে সমুহ বিপদ! আত্মরক্ষার উপযুক্ত অস্ত্র প্রয়োগের আগেই তো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। যেখানে-সেখানে, যখন-তখন বাঙালি সম্পর্কে নানা মন্তব্য ইচ্ছে-অনিচ্ছেয়, অজ্ঞতায়, অসভ্যতায়, না-জেনে বা জেনে, অত্যন্ত সতর্কভাবে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উট কাঁটা বেছে খায় কি না খায় - এই প্রশ্ন থেকে খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে এদের খুঁজে খুঁজে বাঙালিকে টার্গেট করার প্রসঙ্গ...এদের ক্যাকটাসের কাঁটা এখন বাঙালি ! এরা এখন বাঙালি বাছতে বসেছে …না হলে বৃথা সর্বভারতীয় রাজনীতি!
শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, নোবেল, স্বাধীনতা সংগ্রাম, উদারমনস্কতা সব দিকে বাংলাকে এককালে এতটাই উচ্চতায় রাখা হয়েছিল যে গোপাল কৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন - ‘What Bengal thinks today, India thinks tomorrow’…কিন্তু এখন সে গুড়ে বালি। গুজরাট যা ভাববে, সমগ্র ভারতকে তাই ভাবতে হবে… এখন তাই বাঙালির প্রতি যত আক্রোশ, লাঞ্ছনা ও বিষোদ্গার!
কালজয়ী বাংলা গানকে সিনেমা বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বিকৃত করার প্রয়াস তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। এছাড়াও এক সর্বভারতীয় অভিনেতা, কমেডিয়ান, ফিল্ম প্রডিউসার এবং রাজনৈতিক কর্মী একটি দলীয় রাজনৈতিক প্রচার মঞ্চে গরম গরম বক্তৃতায় বলতে পারেন - “গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বেড়েছে তো কী হয়েছে? বেড়েছে, কমে যাবে। কিন্তু তোমার বাড়ির পাশে যদি রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি আসে, তবে কী করবে? তুমি কি আলতু ফালতু বাঙালিদের জন্য মাছ ভাজতে বসবে?” সেই বাঙালি তথা বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে আক্রমণ! সেই উট সম্বন্ধীয় প্রশ্নে ছিল - ওদের খাদ্য কী? উট কি কাঁটা ঝোপের কাঁটা বেছে খায়? এখন বাঙালি মাছের কাঁটা চিবিয়ে খায় না বেছে খায় না গিলে খায় থেকে অবস্থা এমন দাঁড়াচ্ছে যে বাঙালিকে ওপেন প্ল্যাটফর্মে বাছা হচ্ছে…!
জবরদস্তি হয়েছে দিল্লির বাঙালি-অধ্যুষিত অঞ্চলের মাছের বাজারে। মাছের দোকান বন্ধ করে দিতে হবে, যদিও তা করা সম্ভব হয়নি। তবে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে। এগুলো টেস্ট চেকিং। কলকাতায় আগে কিছু নার্সিং হোমে নিরামিষ ও আমিষ উভয় ধরনের খাবার থাকত ডায়েটে, এখন সেই সব সেবা কেন্দ্রে শুধুই নিরামিষ, শাক-পাতা-সবজি । অসুখ ইত্যাদি নিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তির সময় এই তথ্য জিজ্ঞেস করার কথা রোগি বা পরিবার মাথায় রাখেন না। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পর দেখা যায়...নিরামিষ থালি, তাতে নিরামিষ সবজির তথৈবচ রান্না। যে বাঙালি সাত পদ নিরামিষ ছেড়ে একটি পদের মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েও খুশি, সে অসুখের মধ্যে এই খাবার দেখে আরও ডিপ্রেশনে চলে যায়...তারপর ভাবে ক’টা তো দিন, চালিয়ে দিই । অসুখে সে তেল মশলার রগরগে খাবার না চাইলেও ন্যূনতম খাদ্যাভ্যাস যদি বজায় রাখতে না পারে তবে সেও আর একটি অসুখই বটে! এই বাঙালিকে, মাছকে নিশানা করে বাঙালি-বাতিল ও আমিষ-বাতিলের কাজটি বেশ অলক্ষ্যে হয়ে যাচ্ছে...। এরমধ্যে উড়িষ্যাতেও বাঙালি নিগ্রহ হয়েছে …কয়েকদিন আগে রাজস্থানের ভিওয়াড়িতে বাংলা বলার অপরাধে ৪০০ জন শ্রমিককে আটক করা হয়। এরা সবাই ইটাহারের বাসিন্দা। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বাতিল করা হয়েছে! চারদিকে সূক্ষ্ম পরিকল্পনায় এসব সংকীর্ণতা চলছে! নানা ভাষা নানা মতের দেশে এ কী অনাচার! এ যদি দেশদ্রোহিতা না হয় তবে দেশদ্রোহিতা কী?
খুব সম্প্রতি বাঙালি-বাতিলের বা বাঙালি-লাঞ্ছনার যে চিত্র সামনে এল তা ভয়াবহ! পাখির কোনও আকাশের সীমানা নেই কিন্তু পশুদের আছে। পশুর ভাষা মানুষ বোঝে না। কিন্তু মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা ৩৭ বছর বয়সী মেহবুব শেখ? নাজিমুদ্দিন মণ্ডল? মিনারুল শেখ? তাঁরা মুম্বাইতে কাজ করতে গিয়েছিল। তাঁদের ভাষা তো মুম্বাই পুলিশ চেষ্টা করলে বুঝতেই পারতো । তাঁরা ভারতের নাগরিক, তাঁদের বৈধ কাগজপত্র সব ছিল, কিন্তু সেগুলো কেড়ে নিয়ে, মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে যৎপরোনাস্তি প্রহারেণ ধনঞ্জয় করে বাংলাদেশি তকমা দিয়ে কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ ব্লকের রতনপুর চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হল। অপরাধ? তাঁরা বাংলায় কথা বলে। মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা থানার মহিশাথালি পঞ্চায়েতের বাসিন্দা এরা। মুম্বাই পুলিশ ভেবেছিল ডকুমেন্ট কেড়ে নেওয়া গেছে, সুতরাং আপদ শান্তি! কিন্তু ভাবেনি এভাবেও ফিরে আসা যায়!
গ্রেফতারের পর মেহবুবের বাড়ি থেকে সব কাগজপত্র মুম্বাই পুলিশকে পাঠানো হয়। কিন্তু কোন রকম কিছু না দেখেই তাঁদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনা ভাইরাল হয়। মুর্শিদাবাদ পুলিশের শীর্ষকর্তারা সক্রিয় হন, সমস্ত বৈধ কাগজপত্র ও ভারতের নাগরিকত্বের প্রমাণ দ্রুত বি এস এফ-এর কাছে জমা পড়ে। বি এস এফ জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের সঙ্গে ফ্ল্যাগ মিটিং করে দেশে চারজনকেই ফেরত নিয়ে আসে।
এক্ষেত্রে যে শারীরিক ও মানসিক হেনস্থা মেহেবুবদের হতে হয় তার খেসারত কি মিলবে?
এভাবে বাঙালিকে হেনস্থা করতে এলে শেষরক্ষা কিন্তু হবে না। সুতরাং মাছে-ভাতে বাঙালিকে হেনস্থা করতে এসো না বাপু! বাঙালি রোহিতে-বোয়ালে, ইলিশে-চিতলে এমনকি পুঁটি খেয়েও কামাল করে দিতে পারে! বাঙালিকে ঘাঁটাতে এলে পরিণাম বুমেরাং হবে!
পুঁটিমাছ ও বাঙালির গপ্পোটা বলে আলোচনায় ইতি টানব। সে ছিল বাঙালির সুদিনের সময় । বাঙালি মধ্যবিত্ত রায়বাবু হাওড়া থেকে সন্ধ্যায় দিল্লিগামী ট্রেনে উঠলেন। তাঁর সঙ্গে উঠলেন আর একজন অবাঙালি ভদ্রলোক। মিস্টার সিং। রাতে শুয়ে পরার আগে দুজনে টিফিন বাক্স খুলে খাবার বের করলেন। সিংজী বের করলেন খাঁটি ঘিয়ে ভাজা পরোটা আর কষা মাংস। সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল কামরাময়। রায়বাবু বের করলেন ভাত, ডাল আর পুঁটিমাছ ভাজা। দু-জন যখন খেতে যাবেন …
সিংজী বলে বসলেন - এক বাত পুঁছু, আপ লোগ কাম করতা, হাম লোগ ভি কাম করতা, মগর আপ লোগ উপর জিতনা পৌঁছতা ...উহ্ হাম লোগোসে নেহি হোতা, কিঁউ?
রায়বাবু খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন - আপলোগোকা বুদ্ধি কম হ্যাঁয় ইসি লিয়ে ।
মিস্টার সিং বললেন - বুদ্ধি কেয়া হোতা, আউর কাঁহা মিলতা?
রায়বাবু পুঁটিমাছ দেখিয়ে বললেন - এই মছলি খানেসে বুদ্ধি হোতা।
সিংজী বললেন - দাদা, আপকি এ বুদ্ধিবালা খানা হামকো দিজিয়ে, অউর হামারা খানা আপ লিজিয়ে…
রায়বাবুর মনে আনন্দ হলেও মুখে না করে দিলেন। বললেন - নেহি নেহি, হামারা বুদ্ধি কম হো জায়েগা।
আরে দাদা, আপলোগ বছপন সে ইয়ে বুদ্ধিবালা খানা খাতা হ্যায়...একদিন নেহি খানেসে কুছ নেহি হোগা…
রায়বাবু তখন খুব বদান্যতা করে নিজের খাবার দিয়ে সিংজীর পরোটা মাংস তৃপ্তি করে খেলেন। সিংজী রায়বাবুর ডালভাত আর পুঁটিমাছ ভাজা খেলেন। পরদিন সকালে সিংজী রায়বাবুকে বললেন - দাদা ইয়ে কাম আপ ঠিক নেহি কিয়া। হামারা কিমতি-বালা খানা লেকর ক্যা বুদ্ধি-শুদ্ধি বোলকে হামকো পুঁটি মাছ খিলায়া।
রায়বাবু বললেন - হাম নেহি খিলায়া, তুমনে খুদ চাহা। আউর জারা সোঁচিয়ে - ইয়ে বুদ্ধি কাল তুমহারা কাঁহা থা? অউর আজ কাঁহাসে আয়া?
সুতরাং … আমরা সেই বাঙালি, যারা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মতে - ‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল/ ধান্যে ভরা ভূমি আর মাছে ভরা জল’… কিংবা ‘কুড়ি দরে কিনে লই দেখে তাজা তাজা / টপাটপ খেয়ে ফেলি ছাঁকা তেলে ভাজা!’
সাবধান! বাঙালিদের বাছতে এসো না!