আওয়াজ উঠেছে— নো ভোট টু বিজেপি। বিজেপিকে একটিও ভোট নয়। আর যাকেই ভোট দিন, বিজেপিকে মোটেই নয়। বিষয়টা পশ্চিমবঙ্গে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে অভিনব। রাজনৈতিক দল-নিরপেক্ষ এই শ্লোগান ভোট প্রচারের ভীড়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
সম্প্রতি কলকাতায় এক নাগরিক কনভেনশনের মধ্য দিয়ে ‘ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা’ নামে ফোরাম গড়ে ওঠে। এই ফোরাম থেকে বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ শ্লোগান উঠে আসে । এখন নির্বাচন পর্বে ফোরাম প্রচারে নেমে পড়েছে পুরোদমে। যুক্ত হয়েছেন সমাজকর্মী, অধ্যাপক, চাকরিজীবি, ব্যবহারজীবি, ছাত্র-যুবশক্তির একাংশ।
দিল্লির উপকণ্ঠে আন্দোলনরত কৃষক জনগণের প্রতিনিধি রাকেশ টিকায়েত সহ একদল কৃষকনেতা পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন। বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্র সরকারের আনা নতুন তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবির প্রতি কেন্দ্র সরকারের হিংস্রতা, শঠতা ও অনড় মনোভাব তাঁদের চিনিয়ে দিয়েছে বিজেপি কত বিপজ্জনক পার্টি। সেই ভাবনা তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে তুলে ধরতে বিভিন্ন স্থানে কৃষক মহাপঞ্চায়েতে শামিল হয়েছিলেন। তাঁরাও আওয়াজ তুলেছেন, আর যাকেই ভোট দিন, বিজেপিকে ভোট নয়।
আশার কথা যে, বর্তমান কেন্দ্র সরকার ও বিজেপির প্রশ্নে বাংলার সোচ্চার গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ও আন্দোলনরত কৃষক জনতার কণ্ঠস্বর মিলে গেছে। সুদূর দিল্লির পথে আলোড়িত কৃষক-চেতনা আর এই বাংলার গণতান্ত্রিক চেতনার যোগসূত্র যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সেইটাই এই নির্বাচনে বিজেপি বিরোধিতায় সবচেয়ে জরুরি প্রসঙ্গ। বিজেপিকে ফ্যাসিবাদী শক্তি হিসেবে বোঝা হোক, কিংবা ফ্যাসিবাদী অভিধা ব্যতিরেকে ভারতের গণতন্ত্র, আমজনতার অধিকারের সামনে চূড়ান্ত বিপজ্জনক শক্তি হিসেবে বোঝা হোক, বিজেপি বিরোধিতায় উভয় ভাবনা অন্তর্বস্তুতে এক। বিজেপির বিরুদ্ধে এমন সংহতি যত বিস্তৃত হবে, বিজেপির ততই বিপদ।
এই বাংলা বিজেপির কাছে কঠিন জায়গাই বটে। বাংলার আছে বড় বড় কৃষক আন্দোলনের ঐতিহ্য। কৃষক আন্দোলনের সুবাদে বামফ্রন্ট সরকার একটানা ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে। আবার কৃষিজমির অধিকার আন্দোলনের জেরে বামফ্রন্টকে সরকার থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। বাংলার ‘বিবিধের মাঝে মিলন’-এর ঐতিহ্যের ইতিহাস শতাব্দী-প্রাচীন। বিজেপি সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিদ্বেষ দিয়ে এই সাংকৃতিক বোঝাপড়াকে ভাঙতে চেষ্টা করেছে। ব্যর্থ হয়েছে বারবার। বিজেপি ১৮টি লোকসভা আসনে জয়ী হওয়ার পরও সিএএ-এনআরসি-র স্বরূপ অবশেষে মানুষ বুঝে নিতে পারল। এবারের নির্বাচনে বিষয়টি নিয়ে বিজেপি মুখে রা’ কাড়ছে না। বাংলার সংস্কৃতির শক্ত প্রাচীরে বিভেদ-বিদ্বেষের প্রশ্নে বিজেপি ঠোক্কর একটা খেল বৈকি। সেদিক থেকে বাংলায় গণতন্ত্র ও সংস্কৃতির প্রশ্নে বিজেপির হার তাৎপর্যপূর্ণ।
ভোটযুদ্ধে বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস, সিপিএম তথা বামফ্রন্ট, এই বড় দলগুলি নিজ নিজ জায়গা থেকে লড়ছে। ঝাঁঝ কারও কম নেই। বিরোধিতায় রাজ্য সরকারে থাকা ও সরকার বিরোধী দলগুলির মধ্যে দলগত ঐক্যের সুযোগ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে ঐক্যমত্যের প্রয়োজন ছিল। সে’ হল বিজেপির বীভৎস স্বরূপটা তুলে ধরার রাজনীতি। এটা জরুরি। কিন্তু মূলত দু’টি শিবিরে ভাগ হয়ে থাকা দুই পক্ষ তৃণমূল কংগ্রেস ও সংযুক্ত মোর্চা বিজেপি বিরোধিতা যেভাবে করছে, পরস্পরের বিরোধিতাও তার থেকে কিছু কম করছে না। উপরন্তু বিরোধিতার বহর এতদূর যে, একে অপরকে বিজেপির সঙ্গে মিলিয়ে বিরোধিতা করছে অনেক সময়। ফলে নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে যখন, তখন আসলে মানুষের কাছে এই বার্তাই পৌঁছচ্ছে যে, বিজেপি এদের মতোই একটা দল। বিজেপিকে আলাদা করে চিনিয়ে দেওয়ার কাজটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তখন তৃণমূল সরকারের উপর বিরক্ত যারা, অথচ সংযুক্ত মোর্চার মতো দলগুলির ওপর খুব একটা ভরসা রাখতে পারছে না, তাদের ভাবনা কোন্ খাতে বইবে? যদি সব দল ঠেস দেওয়া বিজেপির বিরোধিতা ছেড়ে সর্বতোভাবে বিরোধিতা করতে পারে, তাহলে এই সকল মানুষ পক্ষ বাছতে অন্তত বিজেপিকে স্থান দেবে না।
এইসব বিজেপি বিরোধী দলগুলির কাছে বিজেপির বিরোধিতা সরকারি ক্ষমতালাভের শর্তাধীন হয়ে আছে । রাজনৈতিক দলগুলির প্রাতিষ্ঠানিকতা ও সুবিধাবাদ বিজেপির রাজনৈতিক চরিত্র উদ্ঘাটনে বড় সমস্যা । বিজেপি এমনই এক শক্তি, তার রাজনৈতিক অ্যাজেণ্ডার পরিপন্থী হলে দেশের সংবিধানকেও অস্বীকার করা, বিচার ব্যবস্থাকে কব্জা করার প্রয়াস, হিন্দুত্বের রাজনীতির দাপাদাপি, গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ, কৃষি ও দেশের সম্পদের ওপর কোম্পানিরাজ কায়েম করার দিকে এগনো, সবকিছুতেই বেপরোয়া ও নজিরবিহীনভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এহেন বিজেপিকে মোকাবিলা করা এক প্রসারিত গণতান্ত্রিক প্রজ্ঞার বিষয়। সেখানে ‘আমাদের’ বা ‘ওদের’ সরকারের থেকেও বড় ব্যাপার হল রাজনৈতিক ঐক্যমত্য। সরকার তো একটা হবেই। সরকার যেমনই হোক, সেই সরকার বিজেপি বিরোধী সরকার হবে, এইটা নিশ্চিত করার জায়গাটা শক্তপোক্ত করা বিজেপি বিরোধী সব দলেরই আশু লক্ষ্য হওয়া উচিত।
https://twitter.com/No_Vote_To_BJP/status/1374974654163472385?s=20
বিহারে বিজেপিকে প্রধান টার্গেট করে এক মহাজোট গড়ে উঠেছিল। সেখানে বামপন্থী থেকে দক্ষিণপন্থী বহু দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। চিরাচরিত পরিস্থিতিতে এটা হওয়া অসম্ভব ছিল। বিজেপির চরম বিপজ্জনক উপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এই মহাজোট গড়ে ওঠা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। কারণ বিজেপিকে তার স্বরূপে চেনার ব্যাপারটা সেক্ষেত্রে ভালোভাবে হতে পেরেছিল। রাজ্যে এনডিএ-র হার প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। সেইসব দলগুলির মধ্যে কংগ্রেস, সিপিএম, সিপিআই ও সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কিন্তু এরাজ্যে বিজেপিকে প্রধান বিপদ ধরে সেরকম কোন ঐক্য হতে পারল না। সংযুক্ত মোর্চা বিজেপি ও তৃণমূল উভয়কেই সমান বিপদ ধরে ভোটযুদ্ধে নেমেছে। এই প্রশ্নেই লিবারেশন এই জোটে নেই। লিবারেশন বলছে, সারা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি প্রধান বিপদ। বিজেপিকে হারানোই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। বিহার বিহধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই এই কথা বলে আসছে।
পশ্চিমবঙ্গে এই নির্বাচনে ‘দিদি ভাই মোদি ভাই’ ও ‘জগাই-মাধাই-বিদায়’ বিধায় বিজেপি বিরোধিতা বড় জায়গা নিয়ে আছে। ভোটযুদ্ধে মন্দের ভালো হিসেবে লড়াইটা চলছে। ফলে এই নির্বাচনে বিজেপিকে হারাতে বিজেপিকে প্রধান বিপদ হিসেবে না-দেখা পার্টিগুলির প্রত্যক্ষ প্রভাবের বাইরে আমজনতার বিচার-বিবেচনা একটা বড় ফ্যাক্টর। তার সদর্থক নজির দেখা গেছে অনেক সময়। পাশাপাশি আছে পার্টি ও অ-পার্টি প্ল্যাটফর্ম থেকে উঠে আসা বিজেপিকে প্রধান বিপদ হিসেবে দেখার আওয়াজ ও চলমান কৃষক আন্দোলনের থেকে উঠে আসা আহ্বান। আর আছে বাংলার ‘বিবিধের মাঝে মিলন’-এর সংস্কৃতি। এইসব নিয়ে ২রা মে-র দিকে তাকিয়ে থাকা।