ঋষিক নামের একটি ছেলে আত্মহত্যা করেছে।সে লিখে গিয়েছে তার বয়ানও। ঋষিক বাংলা মাধ্যমের ছাত্র ছিল। ইংরেজি আয়ত্ত করার চাপ , কী ভাষা, কী আদব, তাকে এমন অন্ধকারের বৃত্তে নিয়ে চলে গেল যে সে বিদায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো এই পৃথিবী থেকে। কিন্তু ঋষিকের এই আত্মহত্যা কি হত্যা নয় এক রকম? অনেকেই বলছেন, ঋষিক ভালো ছাত্র ছিল, সে কেন যথেষ্ট চেষ্টা করলো না লড়ার। কেন সে আয়ত্ত করলো না ইংরেজি ভাষা। সে তো সহজেই পারত ভাষাটি শিখে নিতে, কেননা সে ভালো ছাত্র। কেউ কেউ বলছেন,ভাষাকে ভালোবাসলে সব ভাষাই শেখা সম্ভব। ইংরেজি তো বটেই। সত্যিই কি তাই? ইংরেজি শিখে নেওয়া এত সহজ? আদৌ সম্ভব নিজে নিজে ইংরেজি শেখা, একটি নামী কলেজে অন্য একটি বিষয় পড়তে পড়তে?
না। সম্ভব নয়। শুধু ভালোবাসা দিয়ে কিছু হয় না। পরিকাঠামো লাগে। যে কোনো পরিসরে ভাষা আয়ত্ত করার জন্য শুধু ব্যক্তিমানুষের নয়, সরকারের সদিচ্ছা লাগে। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগের উদাহরণ হয়ে বলছেন, আমি তো পেরেছি। ও কেন পারলো না? যাঁরা এমন বলছেন, তাঁরা আশাবাদী, যে সকলে, প্রত্যেকে, স্ব-ইচ্ছায় ইংরেজি শিখে নিতে পারবে, যদি তারা যথেষ্ট উদ্যোগী এবং পরিশ্রমী হয়। তাঁদের কাছে প্রশ্ন, আপনি কি নিজের ক্ষেত্রে সত্যিই দেখেছন যে নিজে নিজে ইংরেজি খুব সাবলীলভাবে শেখা যায়? শুধু ভালোবাসার তাগিদে সত্যিই কেউ শিখেছেন ইংরেজি? সত্যিই কি শুধু ভালবাসার জোরে বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করতে পেরেছেন? কেউ কেউ বলছেন,আজকাল ছেলে- মেয়েদের অধ্যাবসায় কম।কিন্তু এটি বোঝা আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য যে সকলে অধ্যবসায়ী হবে, এ এক অমূলক ধারণা। অধ্যাবসায় না থাকা অপরাধ নয়। সকলের থাকবে, এমন আশা করাও অন্যায়। বোপদেব পেরেছেন, তাই সকলেই পারবে, এও অবাস্তব প্রস্তাবনা।এবং শুধু নিজে নিজে চেষ্টা করে গেলেও হয়না সব সময়ে। তার জন্যেও aptitude লাগে। অনুকূল পরিবেশ লাগে। কেউ কেউ পারে। একশো জন্যে হয়তো দশজন।নিজের কুড়ি বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, একেকজনকে, কঠোর পরিশ্রমে অসাধ্যসাধন করতে। দেখেছি, বাক্যগঠন ব্যাকরণ কিছুই জানত না এমন মেয়েও পরিপাটি ইংরেজি আয়ত্ত করেছে, অনায়াসে বুঝতে লিখতে পেরেছে পথটি দেখিয়েছি যেমন সেভাবে চলে। শিখতে গিয়ে আত্মবিশ্বাস পেয়েছে, বলাই বাহুল্য। তবে নিরলস চেষ্টা করাও অত্যন্ত কঠিন, এটি নির্মম সত্য। সকলে পারে না, এই সত্য কঠিনতর। এমন করে শিখতে পারা খুব শক্ত।সরকারের শেখানোর দায় নেই, কাজেই শেখার দায়িত্ব ব্যক্তি মানুষের, এ বড় অন্যায় ধারণা। সব দায় যদি ব্যক্তির হয়, তবে সরকার কী করবে?
দায় ব্যক্তির, এককের, এই ধারণা আমাদের দেখতে দেয়না প্রকৃত সত্যকে। সত্য এই যে ভাষার রাজনীতির কাছে আমরা হেরে গেছি আসলে। কেননা আমার ভাষা আমাকে বলীয়ান করেনি। এ তো মূলত পাওয়ার ডায়নামিক্স। রাজনীতি ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এমন করে, যে আজ আমি শুধু নিজের ভাষা জানলে, দুর্বল। আমি তখন নিজের প্রদেশেও এগিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বহিরাগত। ঋষিকের আত্মহত্যা তাই অত্যন্ত সিম্বলিক বলেই আমার মনে হয়। আমার সরকার যদি আমাকে গ্রাহ্য না করে, যদি বাংলা ভাষাকে প্রশাসনিক ও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে যথাযথ মর্যাদা না দেয়, বাংলা ভাষার রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি না হয়, তবে আরও অনেক ঋষিককে আমরা হারাবো। নিরাশাব্যঞ্জক হলেও এ কথা সত্য।
ইংরেজি শেখার দাবী আমাদের ক্রমে নিঃস্ব করেছে। ইংরেজি শেখা হয়ত ইতিবাচক, কিন্তু ইংরেজি শেখার চাপ কেন নিতে হবে পড়ুয়াকে? কেন এমন হবে, যে নিজের প্রদেশেও আমি শুধু বাংলা জানলে কাজ চালাতে পারবো না? কেন ইংরেজি না জানলে এমন অবস্থার শিকার হতে হবে যে অবসাদে গ্রস্ত হয়ে আমি আত্মহত্যাই শ্রেয় মনে করবো?
হয়তো বেশী ভালো ছাত্র বলেই ঋষিক ছিল আরও বেশী সংবেদনশীল। সংবেদী মানুষের মনের মধ্যে অন্ধকার নেমে এলে তা ঘনীভূত হয় আরও তাড়াতাড়ি। আর হঠাৎ কারো এমন করে অকালে হারিয়ে যাওয়ার খবর আসে যখন আমরা ভাবি, ভাবার চেষ্টা করি, কোনখানে কী ঘটলে এমনটা হতোনা। হয়তো ঋষিকের ছিল অবসাদের অসুখ। হয়তো সেও জানতো না। বুঝতে পারেনি। হতে পারে এই পরিবেশ, এই হীনমন্যতার বোধ একটি trigger। এবং, যাকে সে জয় তো দূরের কথা অগ্রাহ্যও করতে পারলো না।
তবু এই একাকী, একক মৃত্যু তো শুধু একটি অবসাদগ্রস্ত এককের মৃত্যু নয়। যা কিছু ব্যক্তিগত, তা তো রাজনৈতিকও বটে। সে দিক দিয়ে ঋষিকের মৃত্যু তো একটি ব্যক্তিগত সমাপতন শুধু নয়। বরং একটি ভয়াবহতার সূচক। এই মৃত্যু আমাদের আবার মনে করিয়ে দিল যে ইংরেজি জানার গরিমা এবং ইংরেজি না জানার দ্বৈরথ আদতে ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাহীনের যুদ্ধ, যেখানে ক্ষমতাহীনের হার অনিবার্য।