সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে, জাতীয় স্তরে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকেই সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার সব রকমের চেষ্টা করেছিল শাসক বিজেপি, ঠিক তেমনিই পশ্চিমবঙ্গে নিরিখেও এই ভোট যাতে ধর্মের ভিত্তিতে, জাতপাতের ভিত্তিতে, ভাষার ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে যায়, তার জন্য বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে একটা বড় রকমের প্রতিদ্বন্দিতা কিন্তু সব সময় কাজ করেছে। এই বিভাজনের রাজনীতি যে ধর্মান্ধ সম্প্রদায়িক শক্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি উভয়কেই ভোট বাক্সে সাফল্য এনে দিয়েছে, একথা অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই ।
এই বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে ভোট প্রক্রিয়ায় আগেও যেমন বামপন্থীরা সক্রিয় ছিল, তেমনিই ভোটের গোটা প্রচারে তাঁরা বিশেষ রকমের সক্রিয়তার পরিচয় দিয়েছেন বিভাজনের রাজনীতির বিরোধিতার প্রশ্নে। প্রচারের কৌশল হিসেবে বামপন্থীরা প্রথম দফার ভোট গুলিতে কোনো অবস্থাতেই বিজেপি আর তৃণমূলের দুই ধারার বিভাজনের যে রাজনীতি, সেই রাজনীতির ফাঁদে পা না দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। তাঁদের কাছে মনে হয়েছিল, বিজেপির আর তৃণমূলের এই বাইনারি ভাঙবার লক্ষ্যে, ভয়াবহ দুর্নীতি, দেশের গভীর অর্থনৈতিক সংকট, ব্যাপক বেকারত্ব, বেরোজগারি, স্বাস্থ্য-শিক্ষা সমস্ত ক্ষেত্রেই পশ্চিমবঙ্গের বেলাগাম অব্যবস্থা, সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি --এই বিষয়গুলিকেই তাঁরা প্রচারের কাজে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেবেন।
কৌশলগতভাবে বামেদের এই রাজনৈতিক অবস্থান সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। কিন্তু কেন্দ্র এবং রাজ্য, উভয় শাসকগোষ্ঠীই যেকোন অবস্থাতেই রাজনীতির ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক প্রচারকে গুরুত্ব না দিয়ে, অরাজনৈতিক বিষয়গুলিকেই সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, সেই জায়গাটিতে আদর্শগত কারণেই বামপন্থীরা একবারের জন্য হাঁটেন নি। এই যে ভোটে হেরে যাবার পর কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী প্রকাশ্যে বলেছিলেন আমি না হতে পারলাম হিন্দু, না হতে পারলাম মুসলিম সেই কথাটি কিন্তু বিগত লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
বামপন্থীদের যে ধর্ম নিরপেক্ষ অবস্থান, যে অবস্থান থেকেই তাঁরা ধর্ম-ভাষা- সম্প্রদায় -জাতপাত- লিঙ্গ-- সমস্ত ধরনের সংখ্যালঘুদের পাশে থাকবার অঙ্গীকার করেছেন এবং থাকেনও ,সেই জায়গাটি কিন্তু সংখ্যালঘু মানুষদের মধ্যে একটা বড় রকমের সাম্প্রদায়িকতার বিপদ সম্পর্কে, বিজেপির বিপদ সম্পর্কে প্রভাব ফেলেছে।একক গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি কেন্দ্রে আবার ক্ষমতায় ফিরে এলে কিভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে, রাজনৈতিক হিন্দু ভারতের রূপান্তরিত করে, আমাদের দেশকে সংখ্যালঘুশূন্য করবে বিজেপি, এ সম্পর্কে একটা পরিপূর্ণ সচেতনতা অর্জন করিয়েছে। সেই অর্জনের জায়গা থেকেই পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব অংশের সংখ্যালঘু মানুষ, বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা অর্জন করেছেন। কিন্তু সেই সচেতনতা অর্জন করে বিজেপিকে রোখবার প্রশ্নে, দীর্ঘদিন রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে থাকা বামপন্থী শক্তিদের উপর সম্পূর্ণ ভরসা করতে পারেন নি। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলেও এটা সত্যি যে, সংখ্যালঘু সমাজ, ধর্মান্ধ সম্প্রদায়িক শক্তির বিপদ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ,সার্বিকভাবে তার মোকাবিলা করবার প্রশ্নে, যেহেতু প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে রাজ্যের শাসন ক্ষমতা আছে, তাই তাঁদের হাতে পুলিশ আছে। সেই কারণে বিজেপি যদি রাজ্যে সংখ্যালঘু সমাজ, বিশেষ করে সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের ওপর সামাজিক, আর্থিক, শারীরিক --কোনো রকমের জুলুম চালায়, তৃণমূল কংগ্রেস তাঁদের পুলিশের মাধ্যমে সংখ্যালঘু সমাজকে নিরাপত্তা দেবে ।
মজার কথা হলো, নির্বাচনী প্রচারে কিন্তু সংখ্যালঘু সমাজের আর্থ- সামাজিক সংকট এবং সেই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার উপায়, এগুলি একবারও উচ্চারণ করেনি রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। এই সমস্ত বিষয়গুলি কিন্তু বারবার বাম- কংগ্রেস জোট নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে তুলে ধরেছেন, বিশেষ করে বামপন্থীরা তুলে ধরেছেন। বামপন্থীদের এই রাজনৈতিক কর্মসূচির ফলে সংখ্যালঘু সমাজের মধ্যে বিজেপির বিপদ সম্পর্কে একটা বড় রকমের সচেতনতা তৈরি হয়েছে । সেই সচেতনতার জায়গা থেকে তাঁরা বিজেপিকে ২০১৯ এর আঙ্গিকে কখনো ভোটের কথা ভাবতে পারেনি। কিন্তু বিজেপির বিপদ আটকানোর ক্ষেত্রে, দীর্ঘদিন ক্ষমতার অলিন্দের বাইরে থাকা বামপন্থীদের উপরও নির্ভরশীল হতে পারেন নি। নির্ভরশীল হয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের ওপর। তৃণমূল কংগ্রেসের যাবতীয় দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়গুলি জানা সত্ত্বেও তাঁদের ধর্মভিত্তিক নানা ধরনের সুবিধাবাদী অবস্থান গুলি জানা সত্ত্বেও, ভোটটা তাঁদেরই দিয়েছেন। কারণ সংখ্যালঘু সমাজ মনে করেছেন, বিজেপি ভোটে জিতে গত ২০১৯ সালে যেভাবে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর অত্যাচার করেছিল বা প্রতি বছর যেভাবে রামনবমীকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর অত্যাচার করে, তার নিরিখে যে রাজনৈতিক দলের হাতে পুলিশ আছে, রাষ্ট্রক্ষমতা আছে, সেই রাজনৈতিক দলকে ভোট দিলেই তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। সেই কারণেই বামপন্থীদের মন থেকে পছন্দ করেও ভোট দেবার ক্ষেত্রে তাঁরা বেছে নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসকেই।
সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজ সম্পর্কে বামপন্থীদের খাতায়-কলমে যে ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান, প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটা ছোট অংশের বামপন্থীদের মধ্যে কিন্তু সেই অবস্থানের থেকে ফারাকটা দুঃখজনক বিষয় হলেও দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা যে ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্তরে সাম্প্রতিক অতীতে বামপন্থী আন্দোলনের কোনো না কোনো নেতৃত্বে এসেছেন ,তাঁদের একটা বড় অংশের ভেতরে সুক্ষভাবে মুসলমান সমাজ সম্পর্কে অপরিচয়- অজ্ঞতা থেকেই একটা দূরত্বের মানসিকতা তৈরি হয়েছে।
একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই প্রসঙ্গে না বলে পারছি না ।একবার একটা বৃদ্ধাশ্রমে, খানিকটা নিজেদের ছাত্র জীবনের হোস্টেলজনিত অভিজ্ঞতার নিরিখে বৃদ্ধাদের চৌকিতে ,তোষক গুটিয়ে , কাঠের উপরে খবরে কাগজ বিছিয়ে, বৃদ্ধাদেরই তৈরি লুচি আর সোয়াবিনের তরকারি খাচ্ছিলাম। সিপিআই(এমে)র এক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যা, বর্তমানে প্রয়াত, এটা দেখে মন্তব্য করেছিলেন ; মুসলমানদের মত কি খাটে বসে খাচ্ছো?
খাটে বসে খাওয়ার মধ্যে পরিচ্ছন্নতা ঘিরে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিছানা নোংরা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি উঠে আসতে পারে। কিন্তু হিন্দু-- মুসলমানের প্রশ্ন কি করে ওঠে? এই যে ঘটনাটির উল্লেখ করা হলো, এটি কিন্তু কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। দীর্ঘদিন বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় কালেও হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক মিলন, এই প্রশ্নটি কিন্তু একেবারেই অন টাচ থেকে গেছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বুকে মুসলমান সমাজের বিভিন্ন ধর্মীয় রীতিনীতি, সেগুলি নিয়ে সাধারণ বাঙালি জীবনে, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি জীবনে চর্চা এবং চর্যা বামফ্রন্টের শাসনকালে সেভাবে অনুশীলন করা হয়নি।
দলীয় কমিটি গুলি বা নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়া-- এইসব প্রশ্নে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বের জায়গায় বামপন্থীরা সঠিক ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েই সব সময় চলেছেন। কিন্তু একেবারে কর্মী সমর্থকদের মধ্যে, সহ নাগরিক মুসলমানদের সম্পর্কে যে ধরনের সদর্থক ধারণা থাকা উচিত, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষদের, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতি দায়িত্ববোধের যে জায়গাটা থাকা দরকার, সেই জায়গায় একটা সমস্যা কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে থেকেই গেছে।
যেমন ধরা যাক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রীত্ব কালে সরকার উন্নয়নের নামে মুসলমানদের জমি কেড়ে নিচ্ছে--মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচার সেগুলির মোকাবিলা করবার প্রশ্নে বামপন্থীরা সার্বিক ভাবে যদি সংখ্যালঘুদের হয়ে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করত, তখন কিন্তু তাদেরই নানা নানা ধরনের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে একটা বেসুরও কথা শুরু হয়ে যেত। সংখ্যালঘু একজন নেতা, তিনি যদি সংখ্যালঘু সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য কোনো সরকারি প্রকল্পকে ত্বরান্বিত করবার চেষ্টা করতেন, তাহলে সেই নেতাকে ও আড়ালে আবডালে 'সাম্প্রদায়িক' বলবার একটা প্রবণতা, দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও, এটা স্বীকার করতে হয় যে,একটা বড় অংশ বামপন্থীদের মধ্যে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল ।
সংখ্যালঘুর কণ্ঠস্বর হিসেবে অল্প কয়েক বছর হল সিপিআই(এম) একটি সংগঠন ' আওয়াজ' তৈরি করেছে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে এই সংগঠনটি সামাজিক স্তরে সক্রিয় রয়েছে । কিন্তু এই সংগঠনটিকে সার্বিকভাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ আয়োজন, তপশিলি জাতি উপজাতিভুক্ত মানুষদের জন্য যেসব সংগঠন রয়েছে, সেইসব সংগঠনগুলোকে নিয়ে করা হয়, দুঃখজনক হলেও স্বীকার করতে হয় যে, আজকে তেমন সক্রিয়তা, সর্বস্তরের বামপন্থী নেতা দের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় না। অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে যে, একাংশের বামপন্থী নেতারা, আড়ালে আবডালে 'আওয়াজ' এর মত সংগঠনকে সিপিআই(এমে) র 'মুসলিম লীগ' বলেও উপহাস করতে ছাড়েন না। যাঁরা এই ধরনের কথা বেশি বলেন ,তাঁরা সিপিআই(এম) নেতা হলেও জন্মসূত্রে কিন্তু বর্ণহিন্দু। তপশিলি জাতি -উপজাতি ভুক্ত মানুষদের ক্ষেত্রে ,অন্তত লোক দেখানো ভাবে হলেও যে সংকীর্ণতা টা তারা দেখারনোর ভান করেন, সেই সংকীর্ণতা তাঁদের কিছুতেই গোপন থাকে না ।
মুসলমান সমাজকে নিয়ে কোন কথা বললে, প্রকাশ্যে তাঁরা কখনো ‘স্পর্শ বাঁচায়ে পুন্যের পথে হাঁটা'র ( সংগতি- অমিয় চক্রবর্তী), এমন ধরনের খাতায়-কলমে সাম্প্রদায়িকদের মত অবস্থান নেন না। কিন্তু মন মানসিকতায় ,সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে যে একটা বড় অংশের বামপন্থী নেতাকর্মীরা নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও, বাস্তব সত্য এই যে এটা বলতে পারা যায় না। বহু ক্ষেত্রে ভোট রাজনীতির বিন্যাস ঘিরে আলাপ-আলোচনার সময়ও মুসলমান এলাকায় হিন্দু প্রার্থী দেওয়া-- এসব নিয়ে কাউকে কাউকে গর্ববোধ পর্যন্ত করতে দেখা যায়। একজন বামপন্থী মানসিকতার মানুষের কাছে ভোট রাজনীতির নিরিখেও যে হিন্দু মুসলমান কখনোই আলাদা করে বিবেচ্য হতে পারে না --সেটা কি কেউ কেউ গোটা দেশের এই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক আবর্তের খোঁয়ারিতে ভুলে গেছে বসেছেন?
'সামাজিক ন্যায়বিচার মঞ্চে' র মতো সংগঠনকে যথোচিত কারনেই সিপিআই(এম) যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সংগঠনটিকে এ ধরনের গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে প্রশংসা করতে হয় নেতৃবৃন্দের ভাবনাচিন্তাকে। কিন্তু সেই একই ধরনের গুরুত্ব যদি 'আওয়াজ' সংগঠনটিকে ঘিরে আরোপ করা হতো, তাহলে ভোট রাজনীতির নিরিখে, হঠাৎ করে মুসলমান সমাজের কথা, সাম্প্রদায়িকতার বিপদের কথা, জনমানসে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পেরেছে, তার থেকে অনেক বেশি ক্রিয়াশীল হতে পারত, গোটা বাংলা জুড়ে এই 'আওয়াজ' সংগঠনটি কর্মকাণ্ড। সংখ্যালঘু সমাজের মধ্যে, মর্যাদার প্রশ্নে, যে দুঃখ বেদনা ক্রিয়াশীল থাকে, সেগুলো দূর করবার ক্ষেত্রে বামপন্থীদের আন্তরিক উদ্যোগের জায়গাটা অনেক বেশি প্রভাব ফেলতে পারত ‘আওয়াজ’।