আধার সংশোধনী বিল পাশ হয়ে গেছে লোকসভায়। বেশ কিছু বিরোধী দলের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও পাশ হল। অনেক সাংসদ প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে এটি রাজ্যসভায় পাঠানোর জন্য কিন্তু সরকারের যেন তর সইছিল না। ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর দেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি রায় দেয়। সেই রায়ে বলা হয়েছিল যে সরকারী সুযোগ সুবিধা পেতে গেলে যে কোনও মানুষকে তাঁর আধার নম্বর জমা করতে হবে। ঝাড়খণ্ডে সন্তোষী বলে একটি ১১ বছরের মেয়ে “ভাত ভাত” করতে করতে মারা যাওয়ার ঘটনা হয়তো আজকে অনেকেরই স্মরণে নেই, কিন্তু তাও এই ঘটনার প্রায় ১ বছর পর এই রায়ে আদৌ কোনও গরিব মানুষের অধিকার সুরক্ষিত হল কিনা সেটা ভিন্নতর বিতর্ক। কিন্তু এই ১১২৬ পাতার রায়ে পরিষ্কার বলা হয়েছিল কোনও বেসরকারি ফোনের কোম্পানি বা ব্যাঙ্ক কোনও মানুষের থেকে আর আধার চাইতে পারবেন না। যদিও সেই রায়ে উল্লেখ ছিল না কিভাবে একজন অনিচ্ছুক ব্যক্তি এই আধারের জাঁতাকল থেকে বেরিয়ে আসবেন। এই রায়ের কিছুদিন আগে পর্যন্তও সাধারণ মানুষের উপর এই বলে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল যে, আধার না দিলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাবে ।সেই চাপটা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু যেহেতু আধার মূলত বেসরকারি কোম্পানির সুবিধার্থে চালু হওয়া একটি আইন তাই কেন্দ্রীয় সরকার আবার একটি সংশোধনী আনে ওই বিলে। সেটার নাম দেওয়া হয়“আধার সংশোধনী বিল”। কিন্তু কেন এই বিলটি আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো সরকার? এর পিছনে কী আছে? এই বিষয়টা নিয়ে বলতে গেলে আবার একটু পিছনে ফিরতে হবে।
আধার কী? কেন আধার গোপনীয়তার কোনও বিষয় নয়, কেন আধারের সঙ্গে সমস্ত কিছু সংযোগ করতে চাইছে সরকার ?--এই সমস্ত বিষয় নিয়ে কথা বলাটা খুব জরুরী।প্রথমে প্রশ্ন করতে হবে আধার কি কোনও পরিচয়পত্র? উত্তর হবে না। কে আধার করতে পারে ? যে কোনো মানুষ যিনি ১৮০ দিন এই দেশে থাকবেন তিনিই আধার করতে পারবেন। এর সঙ্গে নাগরিত্বের কোনও যোগাযোগ নেই। সুতরাং এটা নাগরিকত্বের কোনও পরিচয় নয়। সুতরাং যে বা যাঁরা বলেন আধার একটি অভিনব নাগরিত্বের পরিচায়ক তাঁদের জন্য ‘আধার অ্যাক্ট’ একটি জরুরী পাঠ্য। যাতে প্রথমেই বলা আছে একজন মানুষ ‘স্বেচ্ছায়’ আধার নিতে পারেন। যেখানে প্রথম শব্দটিই হচ্ছে ‘স্বেচ্ছায়’ তাহলে তা নিয়ে এতো জোরাজুরি কেন? এখানেই আসল রহস্য। যদি খেয়াল করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে গতবারের কেন্দ্রীয় সরকার একটি প্রকল্প চালু করেছিল যার নাম ছিল জন ধন যোজনা অর্থাৎ যে কোনও মানুষ আধার দিয়ে একটি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে আর কোনও পরিচয়পত্রের প্রয়োজন নেই। সঙ্গে তাঁর ফোন নম্বরটি যুক্ত থাকলেই হবে। এই জন ধন অ্যাকাউন্টগুলোর সঙ্গে যদি আধার যুক্ত থাকে তাহলে এই অ্যাকাউন্টগুলো হয়ে দাঁড়ায় টাকা ট্র্যান্সফার করার মাধ্যম, যেহেতু আধার ছাড়া অন্য কোনও পরিচয়পত্র লাগে না এই অ্যাকাউন্ট খুলতে।
গতকাল আবার আধার শিরোনামে এসেছে। তামিলনাডু হাইকোর্টে একটি পিটিশনের শুনানির সময়ে অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে ভেনুগোপাল প্রস্তাব দিয়েছেন যে ফেক নিউজ আটকানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে আধারকে যোগ করতে হবে। এটা শুনে অনেকের হয়তো মনে হতে পারে সত্যি এতদিনে একটা ভাল পদক্ষেপ নেওয়া হল। তাঁদের জন্য একটি পরিসংখ্যান দেওয়া জরুরী। মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন ৪৯০০০ আধার এনরোলমেন্ট সেন্টার বাতিল করা হয়েছে বিভিন্ন কারণে। কিন্তু এটা তিনি বলেননি সেই এনরোলমেন্ট সেন্টারের করা আধারগুলো বাতিল হয়েছে কিনা ? যদি ধরে নেওয়া যায় প্রতিটি সেন্টার গড়ে দিনে ৫টা ভুল আধার করেছে তাহলে কত ভুল আধার এই আধারের ডেটাবেসে আছে বলুন তো ? ৪৪৭,১২৫,০০০ ন্যূনতম ভুল আধার থাকতে পারে। সেগুলো দিয়ে যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা ট্যুইটারের প্রোফাইলে যোগ করে ফেক নিউজ ছড়ানো হয় প্রশাসন ধরবে কি করে? এছাড়াও জানা গেছে যে বিজেপি মন্ত্রীসভার গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন তারা জানেন যে কি করে একটা খবরকে ভাইরাল করতে হয়, তাহলে একজন সাধারণ মানুষ কোনটা বিশ্বাস করবেন? যেটা খুব জোরের সঙ্গে সবাই বলছেন না খুব ক্ষীণ কণ্ঠে যেটা শোনা যাচ্ছে? আসলে সেই গ্যালিলিওর সময় থেকেই সত্যিটা খুব কম লোকের কাছেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। অনেকে শুনতে না চাইলেও পৃথিবীটাই সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করছে, যদিও সেই সময়ে বেশীরভাগ মানুষ অন্যরকমটাই বলেছিল।
সুতরাং এরপরের ধাপটা কল্পনা করা কি খুব কঠিন কাজ? এরপর ভোটার কার্ডের সঙ্গে আধার যুক্ত হবে, তারপর আমার আপনার সোশ্যাল মিডিয়ার চলন দেখে বোঝা যাবে যে আমরা সরকারের সমালোচক কিনা? তারপর ভোটের দিন আমি আপনি যারাই সরকার বিরোধী পোস্ট দিয়ে রাস্তায় না নেমে নিশ্চিন্তে ঘুম দিচ্ছি একটা লাইক, বা শেয়ার করে তাঁরাও এবার নজরদারির আওতায় পড়বেন। ভেবে দেখার কি সময় হয়নি যে এবার সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামতে হবে? না হলে আজকে কিংবা কালকে আমি আপনি সবাই বাদ পড়বো কারণ শেষবিচারে আধার একটি সংখ্যা ছাড়া কিছু নয়। যদিও সুপ্রিম কোর্টে আধার নিয়ে আবার রিভিউ পিটিশন দাখিল হয়েছে তবুও আমরা নাগরিকেরা কি আশাবাদী হতে পারি? নাকি এবারের নির্বাচনের পর ভারতের নাগরিকেরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে একটি নজরদারি রাষ্ট্রে পৌঁছে যাবে ? যেখানে প্রতিটি মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপ মাপা হবে আর প্রতিটি নাগরিক মানুষ থেকে পরিণত হবে সংখ্যায় ? কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের ওপর ভরসা কি রাখা যায়, যেখানে তাঁরা নিজেরাই বলেছেন আধার সাংবিধানিক ভাবে বৈধ? নাকি রাস্তায় নেমে আধারের বিরোধিতা করার সময় হয়েছে নাগরিক সমাজের?