পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কে পড়াবেন ভালবাসার পাঠ?

  • 05 September, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 921 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন সেনগুপ্ত
মুজফফরনগরে একটি স্কুলের ঐ ভিডিও দেখে চমকে উঠেছে, সারা দেশ। যাঁরাই দেখেছেন, তাঁরাই, ছিঃ ছিঃ করেছেন। একজন শিশুর মনে এইভাবে ঘৃণার বিষ ঢোকানো নিয়ে সরব হয়েছেন সকলে। অনেকেই বলেছেন, এই যদি একজন শিক্ষকের আচরণ হয়, তাহলে, আজকের এই শিশুরা কি শিখছে? তারা কি এই শিক্ষককে সম্মান করতে শিখবে, না অন্য ধর্মের সহপাঠীকে ঘেন্না করতেই শিখবে?

 সালটা ২০১৩ সাল, তখনও নরেন্দ্র মোদী দিল্লির তখতে বসেননি। তখনও ‘গুজরাট মডেল’ নিয়ে প্রচার চলছে, পুরোদমে। ঠিক সেই সময়ে, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরে, এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায়, প্রাণ হারান প্রায় একশো জন সংখ্যালঘু মানুষ আর ঘর ছাড়া হন প্রায় দু হাজার মানুষ। ২০১৫ সালে এই দাঙ্গা নিয়ে, ‘মুজফফরনগর বাকি হ্যায়’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরী করেন, নকুল সিংহ সাহানে এবং আরো কয়েকজন। ঐ তথ্যচিত্রের শুরুতেই, পশ্চিম উঁত্তরপ্রদেশের, শামলি জেলার এই অঞ্চলের একটা ছোট ইতিহাস বলা হয়েছে, কীভাবে একসময়ে এখানে কৃষক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে, হিন্দু-মুসলমান মানুষদের মধ্যে একটা ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল। অনেকেই কেন এই মুজফফরনগরকে ‘মহব্বতনগর’ অবধি বলতেন, এই দাঙ্গার আগে অবধি, তাও দেখানো হয়েছে ঐ তথ্যচিত্রটিতে। ঐ দাঙ্গার পরে কেটে গেছে, আরো বেশ কিছু বছর। যে দাঙ্গা ওখানে সেই ২০১৩ সালে হয়েছিল, তার রেশ যে রয়ে গেছে, তা সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় আবার প্রমাণিত।

 

ভারতবর্ষের এখনকার শাসকেরা জানেন, যে কোনও ধরনের দাঙ্গা সংগঠিত করতে পারলে, তার যেমন একটা স্বল্পকালীন সুবিধা পাওয়া যায়, আবার তেমনই একটা দীর্ঘকালীন প্রভাব থেকে যায়। প্রাথমিকভাবে, যে অঞ্চলে দাঙ্গা সংগঠিত হয়, সেই অঞ্চল এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে যে মেরুকরণ তৈরী করা যায়, তাতে যেমন নির্বাচনকে প্রভাবিত করা যায় তেমনই যাঁরা সেই দাঙ্গা দেখেননি, তাঁদের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব। মুজফফরনগরে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ২০১৩ সালের দশ বছর পরে, স্কুলে যে কাজটি করলেন, তা দেখে এটা মনে হওয়া কি অস্বাভাবিক, যে এই ধরনের দাঙ্গা যে তাঁর মনে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ তৈরী করতে যথেষ্ট সক্ষম হয়েছে। না হলে, তিনি কেন তাঁর এক সংখ্যালঘু ছাত্রকে, ক্লাসের অন্য সংখ্যাগুরু হিন্দু সহপাঠীদের চড় মারতে বলবেন? শুধু তাই নয়, তিনি যে এই বিষয়ে আদৌ এতটুকুও অনুতপ্ত নন, তা তাঁর পরের দিনের আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে আবারও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, তাঁর বক্তব্যকে বিকৃত করা হয়েছে, তিনি কখনোই হিন্দু- মুসলমান বিভেদ করতে চান নি। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, পড়াশুনা না করে, যদি কোনও ছাত্র তার মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে চলে যায়, তাহলে তার এইরকম শাস্তিই প্রাপ্য।

সমাজমাধ্যমে,  ঐ ভিডিও দেখে চমকে উঠেছে, সারা দেশ। যাঁরাই দেখেছেন, তাঁরাই, ছিঃ ছিঃ করেছেন। একজন শিশুর মনে এইভাবে ঘৃণার বিষ ঢোকানো নিয়ে সরব হয়েছেন সকলে। অনেকেই বলেছেন, এই যদি একজন শিক্ষকের আচরণ হয়, তাহলে, আজকের এই শিশুরা কি শিখছে? তারা কি এই শিক্ষককে সম্মান করতে শিখবে, না অন্য ধর্মের সহপাঠীকে ঘেন্না করতেই শিখবে? অথচ তারপরেও ঐ শিক্ষিকার মধ্যে অনুতাপের লেশমাত্র নেই। যদি ধরেও নেওয়া যায়, কেউ বা কারা, তাঁর বক্তব্যকে সচেতনভাবে বিকৃত করেছেন, কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। আজকের পৃথিবীতে কোনও ছাত্রকেই, কোনও অপরাধের জন্যেই যে দৈহিক শাস্তি দেওয়া যায় না, তা কি ঐ স্কুলের অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষিকা, জানেন না? তাহলে তিনি কিসের জন্য শিক্ষকতা করছেন?

শিক্ষকতা প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলেই, সারা পৃথিবীর নানান বিখ্যাত মানুষদের কথা মনে আসে। মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক, তুর্কির প্রথম রাষ্ট্রপতির একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ভালো শিক্ষকেরা হচ্ছেন, অনেকটা মোমবাতির মতো, নিজেরা জ্বলে শেষ হয়ে গিয়েও, অন্যদের আলো প্রদর্শন করে থাকেন। ভারতবর্ষ, নানান সময়ে, এইরকম নানান শিক্ষক পেয়েছে, যাঁরা শুধুমাত্র তাঁদের ছাত্রদের শিক্ষাদান করেছেন, এমনটা নয়, তাঁরা দেশটাকেও শিক্ষিত করার চেষ্টা করে গেছেন। বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়া, সিস্টার নিবেদিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বহু মানুষদের কথা বলতে হয়, যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু আজকে মুজফফরনগরের ঐ শিক্ষিকা যে কাজটি করলেন, তাতে কি পুরো শিক্ষক সমাজের মুখ পুড়লো না? যদিও অনেকে বলছেন, আমাদের আশেপাশেই এই ধরনের মানুষেরা আছেন এবং তাঁরা এই একই ঘৃণা ছড়ানোর কাজ করে চলেছেন দিনরাত সামাজিক মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে। বাস্তবে যখন দেখা যাচ্ছে, এই শিক্ষিকা, তাঁর ছাত্রদের মধ্যে বিদ্বেষের পাঠ দিচ্ছেন, তখন আবারও মনে করতে হয় সাবিত্রীবাই ফুলের মতো শিক্ষকদের, যারা ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন আজ থেকে বহু বছর আগে। কারণ তাঁরা জানতেন, ব্রাহ্মণ্যবাদ বারংবার চায়, সমাজে তাঁদের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাক, সমাজের মধ্যে বিদ্বেষ থাকুক। তাই শিক্ষকদিবসে, দেশের প্রধানমন্ত্রী যতই মাথা নত করে দেশের শিক্ষকদের সম্মান প্রদর্শন করুন না কেন, আদপে তিনিও চান না, মহিলারা, বা দলিত, সংখ্যালঘু মানুষজন শিক্ষিত হোন, কারণ তিনি জানেন, প্রকৃত শিক্ষা প্রশ্ন করতে শেখায়।

হিটলারের নাজি জার্মানির এক স্কুলের প্রিন্সিপালের একটি চিঠির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, যেখানে তিনি তাঁর নাজি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফেরার পরের কিছু কথা লিখে গিয়েছিলেন। তাঁর বয়ান অনুযায়ী, জার্মান ইঞ্জিনিয়াররাই ঐ গ্যাস চেম্বারগুলো বানিয়েছিলেন, যার মধ্যে লক্ষ লক্ষ ইহুদিদের ঢুকিয়ে মারা হয়েছিল। জার্মান শিক্ষিত নার্সরা ইহুদী বাচ্চাদের কীভাবে মেরেছেন, কীভাবে শিক্ষিত মানুষজন, গুলি করে হত্যা করেছে, তাঁদেরই সহনাগরিকদের তাও তিনি নিজের চোখে দেখেছেন, সেই কথাগুলোই লিখে গিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য, শিক্ষা নিয়ে তিনি সন্দিহান, অঙ্ক, ইতিহাস, ভুগোল, বিজ্ঞান সব শেখা যাবে, কিন্তু তার আগে প্রয়োজন ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা পাওয়া, ভালো মানুষ তৈরী করার শিক্ষা দেওয়াটা বেশী জরুরী। মুজফফরনগরের ঐ শিক্ষিকাকে, কিংবা এই ধরনের মানুষ, যাঁরা শিক্ষকতার নামে ধর্মের মধ্যে বা জাতির মধ্যে বিদ্বেষ প্রবেশ করাচ্ছেন, কেউ কি তাঁদের এই পাঠটুকু পড়াতে পারবেন?

 

 

0 Comments

Post Comment