পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সবই তো হলো, পড়াশুনা কি আর হবে?

  • 26 January, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 957 view(s)
  • লিখেছেন : রাণা আলম
আজ প্রজাতন্ত্র দিবস, স্কুলের শিশুরাও তো প্রজাই। তাঁদের শিক্ষা নিয়ে কি ভাবছে সরকার? আদৌ কি এই বিষয় নিয়ে চিন্তিত তাঁরা? আজ আবার সরস্বতী পুজোও বটে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজো হচ্ছে, কিন্তু তাতেও কি বিদ্যার কাজ এগোচ্ছে, না কি শিক্ষকদের দিয়ে নন অ্যাকাদেমিক কাজ করিয়ে নেওয়াটাই এখন সরকারের কাজ?

সম্প্রতি, রাজ্যের  একটি হাইস্কুলে চুক্তি ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক চলছে। অতি সামান্য বেতনে চুক্তি ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপনে রাজ্যজুড়ে সচেতন মানুষজনের ভিতরে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে যা অত্যন্ত সঙ্গত। আমরা রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার হাল হকিকত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি, এটাও খুব আশাজনক সংবাদ। স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেন, এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাম্প্রতিক রিপোর্ট নিয়েও সংবাদমাধ্যমে বেশ আলোচনা হচ্ছে। সব মিলিয়ে খুব সু পবন বইছে বলা যায় আরকি।

প্রশ্ন একটাই, রুগী যখন ভেন্টিলেশনে যাওয়ার পথে, তখন হাতপাখার বাতাস দিয়ে খুব কাজের কাজ কিছু হবে কি???

গত এক দশক ধরে রাজ্যে স্কুল শিক্ষায় কোনো নিয়োগ হয়নি। সরকারী স্কুলে কিছু নিয়োগ হয়েছে, তাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বহু সরকারী স্কুল চুক্তি ভিত্তিক শিক্ষকদের নিয়ে চলছে। উৎসশ্রী পোর্টালের মাধ্যমে লাগামছাড়া বদলির ফলে গ্রামের স্কুলগুলো কার্যত ধুঁকছে। লাগামছাড়া শব্দটা ব্যবহার করলাম কারণ বদলির ক্ষেত্রে একদমই ভাবা হয়নি যে তারা চলে গেলে স্কুলগুলোর কি দশা হবে। ফলে বহু স্কুলে এগারো-বারো ক্লাসে বিজ্ঞান শাখায় পড়াবার টিচার নেই। জেলার কিছু স্কুলের এমন দশা হয়েছে যে তাঁদের মোট ছাত্রসংখ্যার সত্তর শতাংশ এলেই তাঁরা সব ক্লাসে শিক্ষক পাঠাতে হিমশিম খাবেন।  জেলার একটি একদা নামকরা স্কুলের কথা জানি যারা বাধ্য হয়েছেন শিফটে স্কুল চালাবার জন্য। কারণ, একবারে সব ছাত্রছাত্রী এলে তাঁরা ক্লাস চালাতে পারবেন না। 

আর গোটা রাজ্যে আরও এক প্রজাতির স্কুল রয়েছে যেগুলো নিয়ে খুব একটা কথা হয় না, সেটা হল নিউ সেটআপ জুনিয়র হাইস্কুল। ফাইভ থেকে এইট অব্দি পড়ানো হয়।  গড়ে তিন থেকে চার জন শিক্ষক-শিক্ষিকা থাকার কথা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেই। কোথাও অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক শিক্ষিকা দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে, কোথাও বা নামকেওয়াস্তে একজন মাত্র শিক্ষক স্কুল চালাচ্ছেন। করণিকের কোনো পোস্ট নেই। শারীর শিক্ষা বা কর্মশিক্ষার কোনো শিক্ষক নেই। তৃতীয় ভাষা পড়াবার জন্যও কোনো শিক্ষক নেই। অথচ, অধিকাংশ স্কুলেই ছাত্রছাত্রী সংখ্যা যথেষ্ট ভালো।

সব শেষে প্রাইমারী স্কুল।  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরটি আমাদের দেশে বরাবরই অবহেলিত। পরিকাঠামো পর্যাপ্ত নয়। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিস্তর অসঙ্গতি ধরা পড়ছে। শিশু শিক্ষার হাল হকিকত মোটেই উজ্জ্বল নয়।

যদিও, আপনি সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখতে পাবেন যে সরকারী স্কুল গুলিতে ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু তা একদমই কোভিড পরবর্তী সময়ের কথা। কোভিডে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। পরিবারগুলি আর্থিক সংকটে ভুগছে। এটা একটা বড় কারণ সরকারী স্কুলে ভর্তি বৃদ্ধি হওয়ার।  কিন্তু, কলকাতা ছাড়াও গ্রাম, মফঃস্বল, জেলা শহরের দিকে বেসরকারী স্কুলের রমরমা এখনও যথেষ্টই।

অসুখটা তাহলে কোথায়?

প্রথমত, স্কুলগুলো আর নেহাতই স্কুল নেই। শিক্ষকদের ঘাড়ে অসংখ্য নন অ্যাকাদেমিক কাজের ভার। সরকার বাহাদুরের শিক্ষাদপ্তর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রিপোর্ট চেয়ে পাঠান। সব রিপোর্টই অতি ‘তুরন্ত’ পাঠাতে হয়। বিন্দুমাত্র দেরী করা চলেনা। এবং সে রিপোর্টের বিবিধ বিষয় হতে পারে, আপনার স্কুলের ছারপোকারা কি আজকাল কাঠের বেঞ্চে বসছে থেকে শুরু করে দুবছর আগে যে চাল পাঠানো হয়েছিল, সেই চালের বস্তার খবর কি, তাদের শরীরটরীর ভালো আছে কিনা পর্যন্ত। ফলে, সরকারী স্কুলের অফিসের মুখ্য কাজ হচ্ছে রিপোর্ট পাঠানো এবং এই রিপোর্ট পাঠানোর চাপ কি মারাত্মক হতে পারে তা সম্প্রতি যাঁরা স্কুল শিক্ষা পোর্টালে ডেটা বা তথ্য আপলোড করেছেন, তাঁদের জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। একজন শিক্ষকের মুখ্য কাজটাই অ্যাকাদেমিক। সেখানে এতগুলো কাজের ভার চাপালে কি লেখাপড়া ব্যহত হবে না?

তারাপদ রায় একবার তার লেখাতে ডিপার্টমেন্ট অফ মাঙ্কি ডিপোর্টেশন দপ্তরের কথা উল্লেখ করেছিলেন। যেখানে জনৈক সরকারী কর্মচারীকে প্রতিমাসে কত বাঁদর তাড়ানো হল তার রিপোর্ট পাঠাতে হত। বাঁদর তাড়ানো বহুকাল আগেই বন্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও রিপোর্ট পাঠানো বন্ধ করা যায়নি। বর্তমান সরকার বাহাদুরের কর্তাব্যক্তিদের ও রিপোর্ট চাওয়ার বহর  অনেকখানি সেরকমই। ধরা যাক, ঠান্ডি ঘরে থাকা কর্তা ব্যক্তি বৈকালিক চিনি ছাড়া কফি পানের সময় জানালা দিয়ে উড়ন্ত শঙ্খচিল দেখে জীবনানন্দের কাফকায়িত মেটামরফোসিসের কথা ভেবে তৎক্ষণাৎ তুড়ি মেরে অর্ডার দিলেন দিলেন স্কুলের আলসেতে দৈনিক কত শঙ্খচিল বসে তার হিসেব পাঠাবার। কর্তার আদেশে কর্ম। বড়কর্তা মেজোকর্তাকে বললেন। মেজোকর্তা সেজোকর্তাকে। আর নিরূপায় সেজোকর্তা আদেশ করলেন ছোটকর্তাদের। ছোটকর্তা এবার হুকুমনামা জারী করবেন স্কুল হেডমাস্টারদের । অতএব তোতাপাখির সাথে পাল্লা দিয়ে রিপোর্টের পর রিপোর্ট জমা হল। কাজের কাজ কি হল সেটা অবশ্যি ‘দেবানাজানন্তি’।

দ্বিতীয়ত, স্কুল শিক্ষার মান পড়েছে। বিপুল নিয়োগ দুর্নীতি একটা বড় ঘা দিয়েছে এই সেক্টরে। তাছাড়াও কেন্দ্র বা রাজ্য, কেউই সরকারী খরচে স্কুল শিক্ষা চালাতে খুব একটা উৎসাহী নয়। এক ধাক্কায় তুলে দিলে গুচ্ছের সমালোচনা আসবে। তাই, ধাপে ধাপে বেসরকারীকরণের প্রক্রিয়া চলছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০  বোধহয় অধিকাংশ শিক্ষকই পড়ে দেখার সময় পাননি। সেখানে উচ্চশিক্ষায় বেসরকারীকরণের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। আর স্কুল শিক্ষা বেসরকারীকরণের ইচ্ছে কেন্দ্র সরকারের বহুকালের। ২০১৫ সালেই তাদের নীতি আয়োগের প্রধান অমিতাভ কান্ত কয়েছিলেন যে স্কুল, কলেজ চালানো সরকারের কাজ নয়। আমাদের রাজ্য  ইতিমধ্যেই জাতীয় শিক্ষানীতি বিনা বাক্যব্যায়ে মেনে নিয়েছে। স্কুলের শিক্ষার মান পড়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল , আমাদের শিক্ষকেরা অধিকাংশই তাঁদের সন্তানদের আজকাল সরকারী স্কুলে বাধ্য না হলে পড়ান না। কেউ অবশ্যই তর্কের খাতিরে , নিজস্ব পছন্দ, নির্বাচন ইত্যাদির কথা নিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু, একবার ভেবে দেখবেন, একজন সরকারী স্কুল শিক্ষক যখন নিজের সন্তানকে সরকারী স্কুলে ভর্তি করেন না, তখন তা আদপে সেই ব্যবস্থার প্রতি তাঁদের অনাস্থাকে প্রকাশ করে। এবং সরকার যখন বেসরকারীকরণের পথে হাঁটবেন, তখন এই অনাস্থার উদাহরণটাকেই অন্যতম প্রেক্ষাপট হিসেবে ব্যবহার করবেন।

তৃতীয়ত, এটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ,  যাঁরা এই ফর্মাল এডুকেশন সেক্টরে পড়াতে আসছেন, তাঁদেরও যথেষ্ট দায় আছে। আমরা, শিক্ষকরা, অধিকাংশই নিজস্ব কর্মক্ষেত্রের মানোন্নয়ন বিন্দুমাত্র নিয়ে চিন্তিত নই। এবং, শিক্ষকতার পেশা যে আর পাঁচটা পেশার মত নয়, সেটাও বোঝার দরকার আছে। মুশকিল হচ্ছে আমরা ধরেই নিয়েছি আমাদের কিস্যু হবে না। চোখের সামনে একের পর এক সরকারী সংস্থার বিলগ্নিকরণ দেখেও বালিতে মুখ গুঁজে দিব্য ঘুমে আছি।

প্রশ্নটা হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে ঢালাও বেসরকারীকরণ হলে হবেটা কি? মধ্যবিত্ত তো ইতিমধ্যেই টাকাপয়সা খরচা করে বেসরকারী স্কুলে নাম লিখিয়ে বসে আছেন। নিম্ন মধ্যবিত্তরাও একই পথে হাঁটছে।

ভুগবেন মূলত নিম্ন আর্থিকবর্গের মানুষেরা। শিক্ষা যে আদতে একটি মৌলিক অধিকার সেটা আমরা এরমধ্যেই ভুলতে বসেছি। পানীয়জল যেভাবে কিনে খাচ্ছি, এই একইভাবে শিক্ষাও কিনে নিতে হবে। এটাও হয়েছে, ওটাও হবে। এ আর নতুন কি?

কোনো গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোতে যখন স্বৈরতন্ত্র চলে তখন তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হয় শিক্ষাব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করা। যাতে বিরুদ্ধ স্বর তৈরী না হয়। আমরা, শিক্ষিত মধ্যবিত্তেরা নিজেদের মেরুদন্ড আগেই বিকিয়ে দিয়েছি। এবার নতুন প্রজন্ম যাতে মুখ বন্ধ রাখতেই শেখে, তার ব্যবস্থা শুরু হয়েছে জোরকদমে।

আমরা, বরং নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রিপশনে খেয়াল রাখি। এরচেয়ে বেশি মুরোদ আমাদের তো আছে বলে মনে হয় না।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment