এনআরসি হোক, একথা বলার লোক বোধহয় বড়ই কম। এনআরসি ব্যাপারটা কী, সবাই ঠিকঠাক বুঝে বিরোধী, এমন নিশ্চয় নয়। তবে এতে নাগরিকত্বের সামনে অনড় প্রশ্নচিহ্ন খাড়া হয়ে আছে, এটা সবাই বোঝে। এতদিন মানুষ নাগরিক সমাজ বুঝেছে। নাগরিক অধিকার ভোগ করেছে।নাগরিক অধিকারে কমিটি-ফোরাম এসব হয়েছে। আজ মানুষকে জানতে হচ্ছে, মানবসমাজ, ব্যক্তিসত্তা, ব্যক্তির যাপিত সময়, দৈনন্দিন কর্মসূত্র, এসব নাকি কিছুই নয়। ব্যক্তিগত-বংশগত কাগজই সব। নাগরিক বাস্তবতা ও নাগরিকত্বের আজন্ম-লালিত বিশ্বাস খানখান ক'রে মানুষকে আজ জানতে হচ্ছে নাগরিকত্বের তত্ত্ব-তালাশ, শিখতে হচ্ছে এনআরসি'র গূঢ়তত্ত্ব।
পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি করা হবে না, বলেছে রাজ্যের সরকার। কিন্তু মানুষের আশঙ্কা যায় না। অনেকে উদ্বিগ্ন বোঝা-না বোঝা কাগজপত্রের মিল-অমিল নিয়ে। নিজের কাগজপত্র ঠিক থাকলেও অনেকে ক্ষুব্ধ পড়শির দুর্ভোগ-দুর্দশার কথা ভেবে। একরাশ উদ্বেগের মধ্যে এই সহানুভূতিটুকু সম্বল ক'রে অনেকেই কাগজপত্র সামলাতে সচকিত। কাগজপত্র বলতে বেশিরভাগ জনের কাছে ভোটার আইডি, রেশন কার্ড, আধার, স্কুল সার্টিফিকেট, জন্ম সার্টিফিকেট। এসবে নাম-ধাম-বয়স-সম্পর্ক মেলানো। গরমিল শোধরাতে স্কুল থেকে ফুড ইন্সপেক্টর থেকে পোস্ট অফিস থেকে বিএলও পর্যন্ত ছুটোছুটি। আর একটু ওয়াকিবহাল যারা, তারা পুরনো দলিলের হদিসে ব্যস্ত। যারা ব্যর্থকাম, অজানা ভবিতব্যের ভাবনায় বিমর্ষ তারা। আর আছে নানা রাজনৈতিক দল বা অরাজনৈতিক ফোরামের ফুরসতে এনআরসি বিরোধিতায় পা মেলানো। ইতিমধ্যে কাগজের ফেরে কিছু প্রাণ স্তব্ধ হ'ল। সমস্যা এমনই মারাত্মক।
এই যে কাগজপত্র নিয়ে হয়রানি -- কারা ভুক্তভোগী? উত্তরটা এতদিনে সবার জানা হয়ে গেছে। গরিব, নিম্নবিত্ত মানুষের কাগজপত্রের সমস্যা বেশি। তাদের বেশিরভাগ জনের লেখাপড়া কম বা জানা নেই। ফলে ভুলচুক বোঝার সমস্যা। এব্যপারে একার্ডে-সেকার্ডে সরকারি তুচ্ছতাচ্ছিল্যের নজির ভুরিভুরি। গরিবগুর্বোদের মধ্যে নথিপত্রের সংরক্ষণের সুযোগ কম। অনেকেরই জমি-জায়গা নেই বলে দলিলপত্র নেই। যাদের বাস্তু বা এক টুকরো চাষের জমির পাট্টা কাগজ হয়েছে, তা সাম্প্রতিক। এরা সব আতান্তরে পড়েছে। এরা বেশিরভাগই মুসলমান। মনে হয়, ষোলো আনায় বারো আনা। এমন নয় যে, অমুসলিম গরিব-নিম্নবিত্ত মানুষদের কমজনের এমন সমস্যা আছে। কিন্তু এদের মধ্যে পরিচয়, কাগজপত্র নিয়ে তেমন ছুটোছুটি দেখা যাচ্ছে না। এনআরসি নিয়ে উদ্বেগ, অস্থিরতা আছে কমজনেই।
গত লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গবাসী এখানে ব্যাপক অনুপ্রবেশের কথা শুনে আসছে। বিজেপি বলছে, অমুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা শরণার্থী। তারা স্বাগত। মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরা উইপোকা সমান। তাদের খুঁজে বের করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশ পাঠানো হবে। বাংলাদেশ থেকে দু'কোটি মুসলমান অনুপ্রবেশের গল্প ফাঁদা হয়েছে। সবাই জানে, জানে মুসলিমরাও, সংখ্যাটা তিলকে তাল করা। কিন্তু কাগজের ফেরে সংখ্যাটা দাঁড় করানো কঠিন কাজ নয়। মুসলিমরা তাই আতঙ্কিত। প্রায় দিশেহারা অবস্থা। বিজেপি বলছে, এনআরসি-তে হিন্দুদের কাগজপত্র লাগবে না। আর একথা ভাবতে অনেকেই সমস্যা দেখছে না যে, কোন কোন হিন্দু পাকেচক্রে এনআরসি-ছুট হলেও মুশকিল আসান সিএএ আছে। এদের অনেকেই এনআরসি'র পক্ষপাতী নয়। নিজের কথা ভেবে এনআরসি'তে বিচলিতও নয়। এনআরসি ও সিএএ --এই দুটি হাতিয়ারে ভর করে বিভেদপন্থীরা বৈপরীত্যের এই চোরাস্রোতটা বইয়ে দিতে পেরেছে। সরকারি ক্ষমতার সুবাদে খেলাটা তারা খেলেই চলেছে। রাজ্যে বিরোধী সরকার তার যোগ্য প্রত্যুত্তর দিতে পারেনি। এই বিষম সময়ে সিএএ'র মারাত্মক বিভেদপন্থায় বিচলিত মুসলিমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পথে নেমেছে। পাশে দাঁড়িয়েছে অমুসলিম নাগরিকদের একাংশ। জামিয়া-মিলিয়ায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিক্রিয়ায় দ্রুতই সারাদেশে প্রতিবাদের ছবিটা সমন্বিত নাগরিক রূপ নিয়েছে। এ বড় আশার কথা। রাজ্যে সরকারি বিরোধী ও অ-সরকারি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি পথ হাঁটছে। ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংখ্যালঘু স্বার্থ রক্ষায় রাজনৈতিক পন্থা গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতির নানা পন্থার মধ্যে অগ্রগণ্য পন্থা বুঝে নিতে মানুষের কিছু সময় দরকার।