পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আপ ও অরবিন্দ কেজরিওয়ালঃএন জি ও রাজনীতির সফল রসায়ন

  • 09 June, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1510 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন কল্যাণ মৌলিক
আপ সম্পর্কে যে কথাটা প্রথমেই বলে নেওয়া প্রয়োজন যে আপের সেই অর্থে কোন নির্দিষ্ট মতাদর্শ না থাকলেও অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট কর্মসূচি আছে। দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন ও তারও আগে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের এন জি ও নিয়ন্ত্রিত নাগরিক উদ্যোগ ( যার জন্য কেজরিওয়াল ম্যাগসাসাই পুরষ্কার পান) ছাড়া সেই অর্থে আপের কোন রাজনৈতিক অতীত নেই।এটা তার পক্ষে প্রাথমিক সুবিধার জায়গা কারণ রাজনীতিতে মুখোশের যে প্রয়োজন থাকে তা আপের নেই।

আজকের ভারতবর্ষের সংসদীয় রাজনীতির চালচিত্রে আম আদমি পার্টি ( আপ) ও তার প্রধান মুখ অরবিন্দ কেজরিওয়াল এক অতি চর্চিত নাম।দিল্লি বিধানসভায় উপুর্যুপরি সাফল্য ও অতি সম্প্রতি পাঞ্জাবে ক্ষমতাসীন হওয়া অতি অবশ্যই এক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী সাফল্য।আজ একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ২০১১ সালে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনকে ভর করে সিভিল সোসাইটি সক্রিয়তাকে একটি রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করার যে প্রক্রিয়া অরবিন্দ কেজরিওয়াল শুরু করেছিলেন তা আজ এক দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। বৃহত্তর দিল্লির বাইরে আপের কোন ভবিষ্যৎ নেই,এই বহুল প্রচারিত ভবিষ্যত বাণীটি আজ অসত্য প্রমাণিত হয়েছে।এর ফলে যে কোন রাজনৈতিক প্রতর্কে আপের এক অনিবার্য উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এখন আপ নিয়ে আলোচনার বহুমাত্রিকতাটি লক্ষ্য করার মত।শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটা বড়ো অংশ দিল্লিতে আপের ' জনকল্যাণ কর্মসূচির ' ( একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, উন্নত মানের সরকারি স্কুল,মহল্লা স্বাস্থ্য ক্লিনিক প্রভৃতি) সাফল্য নিয়ে দারুণ মুগ্ধ। বিরোধী দল হিসাবে কংগ্রেসের ধারাবাহিক ব্যর্থতা, আঞ্চলিক দলগুলোর সীমাবদ্ধতা ও দুর্নীতির কারণে অনেকেই বিজেপির একাধিপত্য ভাঙতে আপকে একটি রাজনৈতিক বিকল্প হিসাবে ভাবতে শুরু করেছেন। আবার একইসঙ্গে দেশের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি যেমন উগ্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন,দিল্লি দাঙ্গা,সম্প্রতি জাহাঙ্গীরপুরীতে বুলডোজার অভিযান প্রসঙ্গে আপের হিরন্ময় নীরবতা আপের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আপের মতাদর্শ ও রাজনৈতিক প্রশ্নটিকে বিচার করার।

কোন রাজনৈতিক দলের এক নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক মতাদর্শ থাকবে,এই আপ্তবাক্যটি উত্তর আধুনিক সময়ে বাধ্যতামূলক নয়-- এই ধরণের প্রতর্ক ইদানীং সমাজ বিজ্ঞানের আলোচনায় বহুশ্রুত। আপ সম্বন্ধে আলোচনায় এই কথাটাই প্রথম মনে আসে।এই প্রতর্কের এক অন্যতম কুশীলব আমেরিকান সমাজতত্ত্ববিদ ড্যানিয়েল বেল ( যিনি নিজের পরিচয়ে লিখেছিলেন socialist in economics,a liberal in politics, a conservative in culture) বলেছিলেন ' মতাদর্শের দিন শেষ হইয়াছে'।ফুকুয়ামা বর্ণিত ' ইতিহাস শেষ হইয়াছে' মত বেলের বক্তব্য এতটা বিতর্ক সৃষ্টি না করলেও উত্তর আধুনিক বিদ্বৎজনেরা এই মূল্যায়নে যথেষ্ট সন্তুষ্ট হন।বেল বলেছিলেন মতাদর্শ বিহীন রাজনৈতিক দল এক বাস্তবতা হিসাবে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হবে।এখন এই মতাদর্শহীনতা কি এক নিরালম্ব শূন্যতা না কি সেটাও এক নির্দিষ্ট মতাদর্শ, তাও আলোচনার বৃত্তে আসতে পারে।

আপ সম্পর্কে যে কথাটা প্রথমেই বলে নেওয়া প্রয়োজন যে আপের সেই অর্থে কোন নির্দিষ্ট মতাদর্শ না থাকলেও অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট কর্মসূচি আছে। দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন ও তারও আগে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের এন জি ও নিয়ন্ত্রিত নাগরিক উদ্যোগ ( যার জন্য কেজরিওয়াল ম্যাগসাসাই পুরষ্কার পান) ছাড়া সেই অর্থে আপের কোন রাজনৈতিক অতীত নেই।এটা তার পক্ষে প্রাথমিক সুবিধার জায়গা কারণ রাজনীতিতে মুখোশের যে প্রয়োজন থাকে তা আপের নেই। এক্ষেত্রে আরেকটা কথা উল্লেখযোগ্য। আপের আচরিত রাজনীতিতে শ্রেণি বা সমাজের কথা নেই,যা আছে তা হল নাগরিক ইস্যুর প্রশাসনিক সমাধান ( রাজনৈতিক সমাধান নয়)।

আপের ক্ষেত্রে যেটা প্রাথমিক সুবিধা, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে সেটাই আবার সমস্যা,আপকে কোন নির্দিষ্ট গোত্র ভুক্ত না করতে পারার সমস্যা। সাধারণভাবে আপ দক্ষিণপন্থী অর্থনীতির দল( যারা খোলামেলা শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করা,হায়ার অ্যান্ড ফায়ার নীতি,নয়া উদারবাদের পক্ষে কথা বলে) যেমন ব্রিটিশ টোরি,আমেরিকান রিপাবলিকানদের মত নয়।আবার মানবিক মুখ সহ সংস্কারের ধ্বজাধারী সোসাল বা লিবেরাল ডেমোক্র্যাট দলও নয়।বিজেপির মত উগ্র সাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদ বা ইউকে ইন্ডিপেনডেন্ট, ফ্রান্সের ন্যাশানাল রেলির মত খন্ডিত জাতীয়তাবাদেরও সে পূজারী নয়।আবার কংগ্রেসের মত মধ্যপন্থী দল হওয়াটাও তার লক্ষ্য নয়।অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তার দল কখনো শাহিনবাগের ঘটনার সমর্থনে পথে নামে নি আবার ঘোষিত ভাবে এন আর সি ও সি এ এ পক্ষাবলম্বন করে নি।সে নয়া কৃষি বিল ও শ্রমকোডের যেমন বিরোধিতা করে নি তেমনি কখনো রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলিকে বেসরকারিকরণের পক্ষে সওয়াল করে নি।আসলে সে রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ থেকে গা বাঁচিয়ে এক নতুন পৌর রাজনীতির ভাষ্য তৈরি করতে চেয়েছে।কিন্তু যখন তা সম্ভব হয় নি তখন সে যে অবস্থান নিয়েছে তা ঘটনা প্রবাহে যারা শক্তিশালী তাদের পক্ষে গিয়েছে।আমার এই পর্যবেক্ষণের সমর্থনে দু একটা উদাহরণ উপস্থিত করতে চাই।শাহিনবাগ আন্দোলনের সময়ে মানুষের যাতায়াতের অসুবিধা হচ্ছে, দিল্লির মানুষের পৌর পরিষেবা পেতে অসুবিধা হচ্ছে -- এইসব ধুয়ো তুলে সে শাহিনবাগের ধর্ণামঞ্চকে তুলে দিতে চেয়েছে। আবার দিল্লি দাঙ্গার সময় আইন শৃঙ্খলা কেন্দ্রের দায়িত্ব, এই কথা বলে একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করার প্রাথমিক দায়িত্বটুকুও নিতে অস্বীকার করছে।আবার জাহাঙ্গীরপুরীর ঘটনায় বুলডোজার দিয়ে বস্তি গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করছে এই কথা বলে যে বিজেপি নেতাদের বাড়ি বা তাদের বসানো ঝুপড়ি ভাঙা হচ্ছে না কেন? এই না ভাঙাটা তার কাছে দুর্নীতির ইস্যু,বৃহত্তর চক্রান্ত অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের নিকেশ করার বিষয়টি নিয়ে সে নিশ্চুপ।এটা উত্তর আধুনিকরা যতই মতাদর্শ হীনতার উদাহরণ হিসাবে দেখাক না কেন,এটাও একটা পরিকল্পিত রাজনীতি।

এই পরিকল্পিত রাজনীতিকে বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে আপের জন্ম ঠিকুজিতে।সমাজকর্মী আন্না হাজারে ও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল আপের ভ্রূণ। ভারতীয় সমাজ জীবনের অন্যতম অভিশাপ দুর্নীতির বিরুদ্ধে আম-আদমির অবিমিশ্র ঘৃণা ও রাজনীতিবিদদের প্রতি চরম অনাস্থাকে কাজে লাগিয়ে এই আন্দোলনের সূচনা হয়।কয়েকটি ক্ষুদ্র ব্যতিক্রম বাদ দিলে আন্দোলনের ভরকেন্দ্র ছিল শহুরে মধ্যবিত্ত।আন্দোলনের বার্তা প্রসারিত করার ক্ষেত্রে তাই ফেসবুক,অর্কুট,টুইটার প্রভৃতি মাধ্যমগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়।আশির দশক থেকে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যে বিপ্লব ঘটেছে তার ফলে টিভি চ্যানেলগুলি আজ এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি।কেজরিওয়ালদের আন্দোলন এই শক্তির কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয় নি।দুর্নীতি বিরোধী এই জেহাদ এমন এক উত্তেজক বাতাবরণ তৈরি করে যে এই সুযোগে কোটি কোটি টাকার মালিক আধুনিক ধর্মগুরু থেকে শুরু করে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কর্পোরেট কর্তা-- সবাই নিজেদের সত্যের সৈনিক বলে ঘোষনা করেন।সমগ্র আন্দোলনকে অনেকে সেইসময় ''Televised Revolution " আখ্যা দেন।এর আগে আমরা দেখেছি সামাজিক ন্যায়,মানবাধিকার, আদিবাসীদের অধিকার বা রাষ্ট্রের তার নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ( অপারেশন গ্রীণ হান্ট) -র প্রতিবাদ সিভিল সোসাইটির মানুষ শুরু করলে মিডিয়া তাদের বুদ্ধিজীবী- সন্ত্রাসবাদী,উন্নয়ন বিরোধী বা মাওবাদীদের সমর্থক আখ্যা দেয়।কিন্তু মধ্যবিত্ত মননের অনুসারী আন্দোলনের সমর্থকরা হয়ে ওঠেন জাতীয় নায়ক।মিডিয়ার এই দ্বি মুখী অবস্থান জনমত গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়।প্রথম থেকেই এ আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ( মিডিয়া তখন তাকে আন্নার ফিল্ড মার্শাল বলে অভিহিত করত) অনেকগুলি এন জি ও ছিল, যার মধ্যে একটি ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বিপুল অর্থপুষ্ট।আরেক নেত্রী কিরণ বেদির এন জি ও আবার কোকাকোলা ও লেম্যান ব্রাদার্সের অর্থপুষ্ট।তাছাড়া আন্দোলনের শুরুর সময় থেকে টিম আন্নাকে আর্থিক ও নৈতিক সাহায্য জোগাতে থাকে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা ও শিল্পপতিরা, যেমন কেশব মাহিন্দ্রা ( ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনার সময় ইউনিয়ন কার্বাইডের চেয়ারম্যান),জামশেদ গোদরেজ,দীপক পারেখ,এস পি হিন্দুজা।

টিম আন্না যে সময় আন্দোলন শুরু করেন, সেই সময়টার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।নীরা রাডিয়ার টেপ,উইকিলিকসের কেবেল বার্তা সংসদীয় গণতন্ত্রের আসল চেহারাটা একেবারে নগ্ন করে দিয়েছিল।টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি, আদর্শ আবাসন বা সংসদে টাকার বিনিময়ে সমর্থন কেনা-- সমস্ত উদাহরণ দেখায় যে সরকারি কাজের বরাত থেকে প্রকল্পের অনুমতি,সরকারি আমলার বদলি থেকে সরকারি প্রকল্পের মালিকানা হস্তান্তর, গণ আন্দোলন থেকে জনস্বার্থ মামলা-- প্রত্যেক ক্ষেত্রে কর্পোরেটদের অনিবার্য উপস্থিতি। দেশের আইনকানুন,নিয়ম,মন্ত্রীসভার স্বাধীনতা,জনগণের অধিকার -- সমস্ত কিছুই এক পণ্য যাকে উপযুক্ত মূল্যে খরিদ করা যায়।সেই সময় রাষ্ট্র পরিচালকরা বোঝেন যে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষায় কিছু ' প্রসাধনী সংস্কার' ( প্রয়োজনে ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারার ছকে কিছু পরিবর্তন) দরকার।স্থিতাবস্থা রক্ষার্থে ও কাঠামোর প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে আন্না হাজারে ও তার এন জি ও বন্ধুরা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।

রাষ্ট্রের প্রয়োজনকে আন্দোলন যেমন মিটিয়েছে তেমনি অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা কখনোই রাষ্ট্র নির্ধারিত লক্ষ্মণ রেখা অতিক্রম করেন নি।প্রথম থেকেই অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা দুর্নীতিকে সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করেন।দুর্নীতির বলতে শুধু আর্থিক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারিকে বোঝানো হতে লাগল।যেন দেশের আইন- কানুন,সরকারি নীতি,পরিকল্পনা সমস্ত কিছুই সঠিক কিন্তু কিছু মানুষের দুর্নীতির কারণে গোটা দেশটা গোল্লায় যাচ্ছে। এটা থেকে মুক্তি সম্ভব আন্না হাজারের প্রস্তাবিত লোকপাল বিল পাশ হলে।কিন্তু যে আর্থ- সামাজিক কাঠামো এই দুর্নীতির জন্ম দেয় তার সম্বন্ধে পরিকল্পনামাফিক নীরব থাকা হল।দুর্নীতির এই বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতটিকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র আর্থিক অনিয়মকে একমাত্র কারণ হিসাবে চিহ্নিত করলে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন কানা গলিতে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। বাস্তবত হলও তাই।দু- দফার আন্দোলনে ক্রমশঃ জনগনের উপস্থিতি কমতে লাগল,খোদ শিবিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠল।শেষমেশ যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অবিমিশ্র ক্রোধ ছিল লোকপাল আন্দোলনের চালিকা শক্তি, সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা গড়ে তুললেন আম- আদমি পার্টি, লক্ষ্য সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা।এককথায় বলা যায় রাষ্ট্রের মদতে সিভিল সোসাইটি উদ্যোগকে একটি রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করার সফল উদাহরণ হিসাবে আপের জন্ম চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

একই সঙ্গে একথা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা দরকার যে এনজিও মতাদর্শ ধারণ করে গত দশ বছরে আপ ও তার প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল রাষ্ট্র পরিচালকদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে।অনেক সমাজতত্ত্ববিদ বলেছিলেন শুধুমাত্র দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দল ভারতীয় রাজনীতিতে টিঁকতে পারবে না।কথাটা মিথ্যা নয় কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে আপ তার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নানান ধরণের পরিবর্তন এনেছে।শুধু মাত্র দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন নয় বরং সে পৌর সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করার রাজনীতি ( কেজরিওয়ালের শ্লোগান অনুযায়ী ' কাম কি রাজনীতি ') শুরু করেছে।এই কাজে সাফল্য তাকে দীর্ঘ স্থায়ী ডিভিডেন্ড দিতে পারে।একই সঙ্গে সমাজে চলমান রাজনৈতিক দ্বন্ধ,সংঘাত প্রশ্নে নন- কমিটাল থাকতে পেরেছে। এটা কেজরিওয়াল করতে পেরেছেন এনজিও মতাদর্শের দ্বারা প্রাণিত হয়ে।এন জি ও রা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ' উলম্ব' সাংগঠনিক কাঠামোর পরিবর্তে ' অনুভূমিক ';কাঠামোর পক্ষে সওয়াল করে।আপকে প্রথম থেকেই গড়ে তোলা হয়েছে কেজরিওয়াল নির্ভর এক মুখী আদতে স্বৈরতান্ত্রিক দল হিসাবে।আমরা যদি আপের সূচনাপর্ব থেকে আজকের আপকে বিচার করি তাহলে দেখব এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যারা ভিন্ন স্বরের জোগান দিতে পারতেন সেই প্রশান্তভূষণ,কুমার বিশ্বাস,যোগেন্দ্র যাদব সহ অনেককে দল থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে।তাদের বিভিন্ন লেখাপত্রে আপ সংগঠনের ' আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ' সম্পর্কে বহু উজ্জ্বল মণিমুক্তার সন্ধান পাওয়া যাবে।আরেকটি বিষয় হল আপ প্রথম থেকেই এক সর্বভারতীয় দল হিসাবে নিজেদের পরিচিত করতে চেয়েছে।সেইজন্য সর্তক থেকেছে আঞ্চলিকতা বা কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের দায় তাকে না নিতে হয়।ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের উত্তরাধিকারী হিসাবে একমাত্র কংগ্রেসের পরিচিতি ছিল।আজকের ভারতবর্ষের প্রধান শক্তি বিজেপিকেও উত্তর ভারত ভিত্তিক দল থেকে সর্বভারতীয় দল হিসাবে গড়ে উঠতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।হিন্দুত্বের সঙ্গে মেশাতে হয়েছে উন্নয়ন ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের ( tough state) গল্প। আপকে এখনো সর্বভারতীয় দল হিসাবে গড়ে উঠতে বহু পথ চলতে হবে কিন্তু তার চলার পথে আঞ্চলিকতা বা সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর প্রতি দায়বদ্ধতা কোন প্রতিবন্ধক হবে না।

কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আপ তার তথাকথিত শূন্য মতাদর্শের আড়ালে সুকৌশলে কর্পোরেট রাজনীতিকে অনুসরণ করে চলেছে।ভারতের মত দেশে সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দু জনগনের বিষয়টি তার বিবেচনার বাইরে নয়।সেইজন্য সে নরম হিন্দুত্বের রাজনীতির থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নি।প্রকাশ্যে কেজরিওয়ালের হনুমান চালিশা পাঠ বা দিল্লিবাসীকে নিখরচায় অযোধ্যায় নব নির্মিত রাম মন্দির দেখিয়ে আনার প্রস্তাব এক সংকেত রাষ্ট্র পরিচালকদের কাছে।আজকে যারা দেশকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে চান তাদের কাছে আপ কোন বিপদ নয় বরং হিন্দুত্বের প্রশ্নে তাদের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভেরই অংশ।এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের তাত্ত্বিক নেতা ও সাধারণ সম্পাদক সুরেশ ' ভাইয়াজি' জোশির সাম্প্রতিক বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য ----' BJP singly does not comprise or represent hindu society and opposing the BJP does not mean being at odds with hinduism and the hindu view of nations'nations'।এককথায় বলতে গেলে আপ কিছু জনকল্যাণমুখী কাজ করতে পারে,সে উগ্র হিন্দুত্ববাদী নয় কিন্তু যে প্রজাতন্ত্রকে ফিরে পাবার লড়াই আজ এদেশের গণতান্ত্রিক মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেই লড়াইতে আপ বন্ধু হতে পারে না।সে তৈরি হয়েছে এন জি ও দের মতাদর্শ অনুযায়ী মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে বিপথগামী করার উদ্দেশ্য। আপ এখনো পর্যন্ত তার কাজে সফল,এ শংসাপত্র কিন্তু অরবিন্দ কেজরিওয়ালদের প্রাপ্য।

0 Comments

Post Comment