স্কুলে বিভিন্ন স্কলারশিপ সহ কন্যাশ্রী ইত্যাদি লেগেই রয়েছে। তাই মিড ডে মিল দেবার সময়স্কুলে আসতে মানা থাকলেও টুক টাক ছেলে মেয়েদের আনাগোনা লেগেই থাকে। কারণ অফিস খোলা। এলেই একটা প্রশ্ন, "স্কুল কবে খুলবে স্যার?" 'ক্লাস কবে থেকে শুরু হবে? আর ভালো লাগছে না। স্যার।'
স্কুলে যাবার পথে, ফেরার পথে, অভিভাবকদের একটাই প্রশ্ন, মাস্টার মশাই স্কুল কবে খুলবে? দার্শনিক হয়ে গিয়ে উপরের দিকে হাত দেখাই। ঈশ্বর জানেন।
অনলাইনে পাঁচ শতাংশ ছেলের হাজিরা ছিল। বাকি পচানব্বই শতাংশ স্কুলে আসতে চায়। বাড়িতে পড়ানোর লোক নেই। তাই পড়াও নেই। হয় মায়ের সাথে বিড়ি বাঁধা। বা টিভি দেখা। বা মোবাইল থাকলে হাতে সবসময়ই মোবাইল। অনলাইন ক্লাসের নামে মোবাইল। উত্তর খোঁজার নামে মোবাইল। এক বেলা এমন কি দুবেলা তাঁর খাবার না হলেও চলবে। কিন্তু গেম খেলা চাইই। একটু বড় ছেলেদের একটা বড় অংশ তো ভিন রাজ্যে উপার্জনের খোঁজে গ্রাম তুতো আত্মীয়ের সাথে।
গেলবার পরীক্ষা হয় নি। পরের ক্লাসে উঠেছে। নতুন বই নতুন খাতা পেয়েছে। সুন্দর করে রাখা আছে। এবারও নতুন ক্লাসে উঠবে। নতুন বই খাতাপাবে। কি মজা। না পড়েই। পরীক্ষা না দিয়েই নতুন ক্লাসে ওঠা।
পড়ুয়াদের মাথায় ঢুকে আছে, এবার নবম শ্রেণীর নম্বর দেখে মাধ্যমিক রেজাল্ট। মাধ্যমিক এর নম্বর দেখে একাদশ এবং একাদশ এর নম্বর দেখে দ্বাদশের রেজাল্ট হয়েছে। পরীক্ষা না দিয়ে নম্বরও এসেছে ভালো। এবারও ক্লাস হয় নি। স্কুলও খুলছে না। পরীক্ষা নিশ্চয়ই হবে না। পরীক্ষা হলে নিশ্চয়ই বলতো। কিছু একটা ধরে নম্বর দিলেই হলো। হয়তো বলবে অষ্টমের নম্বর দেখে এবার রেজাল্ট হোক। তাই এত পড়ে কি লাভ?
আমাদের কথা - লকডাউন পর্বে এবারও রুটিন করে অনলাইনে গুগল মিটে ক্লাস নেওয়া হতো।
বেসরকারি স্কুলে অনলাইন ক্লাসে কে যোগদান করলো, বা করলো না, কে কে ভিডিও অফ করে রাখছে তা দেখার লোক রয়েছে। কিন্তু সরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে প্রথমত, অনলাইনে ক্লাস করবার কোন নির্দেশিকা নেই। ফলে কিছু কিছু সরকারি স্কুলের মতো আমারও নিজেদের উদ্যোগে অনলাইনে রুটিন করে ক্লাস করতাম।
নবম ও দশম শ্রেণীতে পনেরো কুড়ি শতাংশ, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে চল্লিশ শতাংশ পড়ুয়ার স্মার্টফোন ছিল (আত্মীয় স্বজন ধরে)। কিন্তু অনলাইন ক্লাসে উপস্থিতির হার ছিল খুব হতাশাজনক। স্মার্টফোনের অভাবে একটি স্মার্টফোনের সামনে তিন বান্ধবী বসে ক্লাস করেছে। কিছু পড়ুয়া ক্লাস করবার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিল।
কিন্তু সমস্যা হলো, অনলাইন ক্লাস করার নামে হাতে স্মার্টফোন রাখলেও, খুব কম সংখ্যক ছেলে মেয়েরা ক্লাসে যোগদান করতো। ক্লাসে যোগদান করলেও ভিডিও অফ করে অন্য কোন app খুলে নিজেদের ভালো লাগার জিনিস দেখতো। পড়া ধরলে পরের দিন পড়ুয়াদের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যেত। পড়ুয়াদের বাবা মায়েদের বক্তব্য, স্মার্টফোন হাতে পেয়ে ছেলে মেয়ে গুলো নষ্ট হয়ে গেল। হয় ভিডিও গেম নয়তো হোয়াটস আপ, নয়তো অন্য কিছু নিয়ে পড়ে রয়েছে। অনলাইন পড়াশুনার জন্য বাবা মা কষ্ট করে ফোন জোগাড় করেছেন, কিন্তু ছেলে মেয়েরা পড়াশুনা নয় স্মার্টফোনের আকর্ষণীয় নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে।
এক্টিভিটি টাস্ক এর গল্প।
আমাদের স্কুলে নিয়ম করে এক্টিভিটি টাস্ক দেওয়া হয় ছেলে মেয়েদের। ওরা নিয়ম করে জমা দিয়ে যায়। ভেবেছিলাম, ওরা প্রশ্নপত্র পাওয়ার পর বই দেখে খুঁজে খুঁজে উত্তর লিখবে। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এর পড়ুয়ারা যদি বই দেখে উত্তর লিখে এত ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর পায়, এরা পেলে ক্ষতি কি?
কিন্তু মজাটা অন্য জায়গায়। যাঁরা লিখতে পড়তে জানে না, তাঁদেরও এক্টিভিটি টাস্কের খাতা সুন্দর পরিচ্ছন্ন হস্তাক্ষরে পূর্ণ। সব উত্তর ঠিক। এক শিক্ষিকা জিজ্ঞেস করায়, এক মা বললেন, স্যার আমার বিটি তো লিখতে পড়তে পারে না, একঝনা লিখে দিয়েছে। পঞ্চাশ টাকা ল্যাগাছে।
বাড়িতে মা না থাকায় এক সপ্তমের পড়ুয়া এক্টিভিটি টাস্ক জমা দিতে এসেছে। সব উত্তর সঠিক। কে বলে দিল উত্তর!
সে চুপ!
বই দেখে লিখেছিস! মাথা নাড়ে সে।
তাহলে কি দেখে! ক্ষীণ স্বরে বলে, মোবাইল দেখে মানে?
ইউটিউব দেখে?
হ্যাঁ স্যার।
হ্যাঁ, এটাই ঘটনা। যেহেতু গোটা রাজ্যে একই প্রশ্নপত্র। তাই ইউটিউবে প্রতিটি বিষয়ের এক্টিভিটি টাস্কের উত্তর দেওয়া ভিডিও আছে।
তাই বই খোঁজার দরকার নেই। নিজে লেখারও দরকার নেই। কারণ এক্টিভিটি টাস্ক জমা দেওয়াটাই শেষ কথা।
কিছুদিন অনলাইন ক্লাস বন্ধ রেখে গ্রামে গ্রামে ছাত্র ছাত্রীদের পড়া দেখিয়ে দেওয়ার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সফল হয় নি। প্রায় আঠেরোটি গ্রামের ছেলে মেয়েরা পড়তে আসে আমাদের স্কুলে। দুটো গ্রামের ছেলে মেয়েদের নিয়ে একটা শিবির করতাম। এত সংখ্যক ছেলে মেয়েরা আসতো সেই শিবিরে যে কোন বাড়ির বারান্দায় বা গুদামে তাঁদের জায়গা হতো। তখন স্থানীয় প্রাথমিকে বসতে হতো। পঞ্চম থেকে দশম এক সাথে।
অধিকাংশ পড়ুয়াই ইংরেজি অঙ্ক বইয়ের প্রথম চ্যাপ্টার বুঝিয়ে চাইছে। অর্থাৎ নতুন শ্রেণীতে উঠলেও ওরা দেড় বছর পূর্বে যেখানে ছিল সেখানে রয়ে গেছে। সব বিষয়ের অবস্থা কম বেশি এক। যেটা বুঝলাম লাগাতার একই জায়গায় তিন মাস ক্লাস না নিলে উন্নতি হবে না। স্কুলে নিয়মিত ক্লাস ছাড়া যেটা সম্ভব নয়। আমরা হতাশ হয়ে বন্ধ করলাম সেই শিবির।
দরিদ্র অসচতেন পরিবারের ছেলে মেয়েরা যাঁদের পড়াশুনা মূলত বিদ্যালয় নির্ভর তাঁদের ক্ষতিটা অপূরণীয়। মনো জগতেরও বড় ক্ষতি হয়েছে।
পরিস্থিতি যাইহোক না কেন, স্কুল খোলা খুব প্রয়োজন। যদি এক একটি ক্লাসকে সপ্তাহে দুদিনও স্কুলে আনা যায় তাতেও চলবে।
সেটাও সম্ভব না হলে দশম ও দ্বাদশকে প্রতিদিন এবং অন্যান্য শ্রেণীকে সপ্তাহে অন্তঃত একদিন করে ডেকে শ্রেণীকক্ষ প্রতি কুড়ি জন বসিয়ে ক্লাস করাতে হবে। অন্তঃত পড়াশুনা টা চালু থাকবে।
স্কুল খোলাটাই এখন একমাত্র জরুরি কাজ। শহুরে শিক্ষিত অভিভাবকদের একটি অংশ যাঁদের ছেলে মেয়েরা অনলাইনে ক্লাস করে নিয়মিত, তাঁরা সরকারকে ইমেইল করে হয়তো জানাবেন, যতদিন সকলের টিকা না হচ্ছে থাক বন্ধ স্কুল। তখন কোন আধিকারিক বলবেন, তিরিশ হাজার ইমেইল পেয়েছি ক্লাস না শুরু করবার জন্য। না, এগুলো শুনতে চাই না।
যাইহোক, আমরা অপেক্ষা করে রয়েছি, ছেলে মেয়েদের কল কলানি শুনবার জন্য। শ্রেণীকক্ষে গিয়ে ওদের সাথে মিশে গিয়ে পড়াবার জন্য।