'অনুগ্রহ করে শুনবেন। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে থ্রু ট্রেন যাবে। দয়া করে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন।'
দীর্ঘদিন হয়ে গেছে এ ঘোষণা শোনা যায়নি। তিন মাস ধরে লোকাল ট্রেন বন্ধ, ভারতীয় রেলের ইতিহাসে এই প্রথম। মালগাড়ি চলছে, ক্রমশ চালু হয়েছে শ্রমিক স্পেশাল এবং সম্প্রতি কিছু দূরপাল্লার গাড়িও। এইসব চলাচল মনিটরিং করা সহ অন্যান্য কাজের জন্য রেলকর্মীদের কর্মক্ষেত্রে যেতে হচ্ছে। তাঁদের জন্য গোটা লকডাউন ধরেই চলেছে স্টাফ ট্রেন বা পেট্রলিং কার। অফিসে রেলকর্মীর সংখ্যা যত বাড়ছে, সেই মতো এই গাড়িগুলির বগির সংখ্যা চার, ছয় থেকে বেড়ে আপাতত বারো। তাতেও ক্রমে ভিড় বাড়ছে, স্টাফ ছাড়াও অনেকে লুকিয়ে চুরিয়ে উঠে পড়ছে, সম্পূর্ণ যাত্রাপথে নজরদারির অভাবে। অবশ্য ধরা পড়লে অশেষ দুর্গতিও জুটছে। হাওড়া ও শিয়ালদহর মত প্রান্তিক স্টেশনে চেকিং হচ্ছে। বাকি সর্বত্র চোখ এড়িয়ে প্রবেশের পথ একাধিক। স্টাফেরা আপত্তি করলে শুনতে হচ্ছে, 'আপনারাই বলুন, কতদিন আর বসিয়ে মাইনে দেবে প্রাইভেট ফার্ম?' কিন্তু জিআরপির খপ্পরে পড়লে বিনা টিকিটে ভ্রমণের অপরাধে ফাইন বা হাজতবাস অনিবার্য। আরে, টিকিট কাউন্টারই খুলছে না যে!
লোকাল ট্রেনের সাথে আমার সম্পর্ক মাত্র চার বছরের। এর আগে যাদবপুরে থাকতে কখনো কখনো কলেজস্ট্রিট ফেরত ভয়াবহ সাউথ সেকশনের ট্রেনে চাপতে আমার কান্না পেত। হাওড়া লাইন সে তুলনায় ঢের বেশি সভ্য ও আরামদায়ক। তবু অফিস টাইমে ভিড়ের জন্য কাটোয়া লোকালের লেডিজ কামরায় উঠতে পারিনি এমনও ঘটেছে বৈকি। ফলে লোকাল ট্রেন চালু হয়ে গেলে সামাজিক দূরত্ববিধি কী করে বজায় রাখা যাবে তা আমার মাথাতেই আসছে না। ওদিকে কলকাতার অধিকাংশ অফিস-ব্যবসা চলে মফস্বল থেকে আগত নিত্যযাত্রীদের জন্য। অফিস টাইমে শিয়ালদহ, হাওড়া বা দমদম স্টেশনের ছবি দেখলেই তা বোঝা যায়। রাজ্যসরকারি দপ্তরের কর্মীদের একটা বড় অংশ আসেন লোকাল ট্রেনে। শুধু শিয়ালদহ দিয়ে প্রতিদিন শহরে আসা এবং কাজ সেরে ফিরে যাওয়া 'ডেলি পাষণ্ড' র সংখ্যা আশি হাজারের বেশি। যাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নত তারা কেউ দুচাকা বা চারচাকার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন। কিন্তু শপিংমলের স্টাফ? দোকানের কর্মচারী? প্রাইভেট ব্যাঙ্ক সহ অজস্র বেসরকারি অফিসের কর্মী? আমার বাড়ির ঠিকেঝি? তারা কেউ আধা, কেউ বিনা মাইনেতে ঘরবন্দি। কারো বা চাকরি এতদিনে নেই হয়ে গেছে। অর্থাৎ যতদিন না লোকাল ট্রেন চালু হবে, অনেকেরই জীবন স্বাভাবিক হবে না। আবার চালু হলেই নিঃসন্দেহে রোগও ছড়াবে।
মনে পড়ছে ট্রেন লাইনের অগুনতি ফিরিওয়ালার কথা। কীভাবে বেঁচে আছে তারা? বাদাম ঝালমুড়ি কাঠিভাজা গজা চিঁড়েভাজা থেকে শুরু করে চুলের ক্লিপ গয়না ব্যাগ কাঁচা সবজি শাড়ি .. গোটা এক শপিংমল ছিল লোকাল ট্রেনের যাত্রাপথ। সন্ধে ছটার কাটোয়া লোকালের লক্ষ্মীমাসির ক্ষীরের পাটিসাপটা কিম্বা সাতটা পঁচিশের মিনুর মালপোয়া কোথায় বিক্রি হচ্ছে এখন? কখনো ভিড় ট্রেনে মোসাম্বির ঝুড়ি নিয়ে যাতায়াতে তিতিবিরক্ত হয়েছি, আবার কখনো সকালে সঞ্জয় কেন দুদিন ধরে পেয়ারা নিয়ে উঠছে না, ক্ষুব্ধ হয়েছি। নিত্যযাত্রীদের সাথে কোথাও একটা অবিচ্ছেদ্য আত্মীয়তা গড়ে ওঠে হকারদের। তাই কোন মেয়েটার বর পঙ্গু, কোন ঈষৎ জড়বুদ্ধির ছেলেটার থেকে বাটারচিপস কেনা নৈতিক দায়িত্ব এবং কোন বৌদির মেয়ের বিয়ে সামনে, এসব তথ্য জানে কেবল লেডিজ কামরা। অন্তর্বাস থেকে বেনারসী - বিয়ের কনের পুরো কেনাকাটা ট্রেনের হকারদের থেকে সারতে দেখেছি আমি। 'গতকাল লেবু মিষ্টি ছিল না, তাই আজ একটা বেশি দাও'- এমন দাবী করা এবং তা বিনাবাক্যে মেনে নেওয়া হকার কেবল ট্রেনেই দেখা যায়। ট্রেন চালু হলে তাদের আর দেখতে পাব তো? ফের অফিস যাবে তো সব সহযাত্রীরা? নাকি তারা সবাই থেকে যাবে ওয়ার্ক ফ্রম হোম মোডে? এমনকি রোজ সাবওয়ে জুড়ে জামা জুতো ব্যাগ ফল মায় ভগবতগীতা বিক্রি করা যারা ছুটন্ত যাত্রীদের পদে পদে বিপদ ডেকে আনত, তাদের কথাও মনে পড়ছে, অস্বীকার করি কি করে!
রোজ শূণ্য প্ল্যাটফর্ম দেখে বুকের ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগে! পেট্রল কারের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ঝুপড়ির ছেলেটা, যেন দীঘা লাইনের নতুন ট্রেন। সন্ধেবেলা প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিগুলো দখল করে আড্ডা জমানো বৃদ্ধদের আর দেখতে পাই না। তবে কি আমরাও এক অকাল অবসরের দিকে এগিয়ে চলেছি সবাই? কে জানে! শয়নে স্বপনে শুধু বেজে ওঠে রেলকামরার যান্ত্রিক স্বর, 'আপকি যাত্রা সুখদ ঔর মঙ্গলময় হো!'