পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

~করোনানামা~ যখন কালো ঝড় তীব্র গতিতে ধেয়ে আসে

  • 03 April, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1395 view(s)
  • লিখেছেন : নীহারুল ইসলাম
আসুন আবার সেই আমার ছেলেবেলার ঝড়ের গল্পে ফিরে আসি। খলিলদাদোর আজান, মুলিকাকার মন্ত্রপাঠ এবং আমাদের খুঁটি চেপে ধরে রাখার ফলে কুঁড়েঘরটা সে যাত্রায় বেঁচে গেল। সেই গোলাকার ‘কী একটা’ আমাদের দিকে ধেয়ে এল না, আমাদের পাশ কাটিয়ে ডোমকুল মাঠের বুক চিরে চলে গেল দক্ষিণ-পূর্ব কোনের দিকে। আমাদের কুঁড়েঘর এবং আমরা অক্ষত রয়ে গেলাম। আমরা নিশ্চিন্ত হলাম।

বৈশাখ মাসে কালবৈশাখী খুব সাধারণ ঘটনা। উত্তর-পশ্চিম কোনে এক খণ্ড কালো মেঘের উদয় দেখলেই ছেলেবেলায় আমরা সব ভাইবোন খুব উল্লসিত হতাম। সবাই মিলে প্রস্তুতি নিতাম ঝড়ের আগে কিভাবে আমাদের আমবাগানে পৌঁছে কে কোন গাছের তলায় দাঁড়াব। একবার হয়েছিল কী, আমি দাঁড়িয়েছিলাম চোকামোটা গাছতলায় আর আমার ভাই পাশের জিল্পী গাছতলায়। ঝড় উঠল। আম পড়তে শুরু করল টুপটাপ করে। ঝড়ের গতি যত বাড়ছে, আম ঝরে পড়ার হার বাড়ছে তত। আমরা আনন্দে আম কুড়োচ্ছি। হঠাৎ জিল্পী গাছের একটা ডাল ভেঙে পড়ল মড়মড় করে। ভাই কোনও রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে এল আমার কাছে। না, এরপর আর চোকামোটা গাছতলাতেও থাকা যায় না। অগত্যা আমরা বাগানের কুঁড়েঘরে ফিরে যাওয়া স্থির করলাম। কিন্তু আমাদের বাগানের কুঁড়েঘর অনেকটা দূরে। সেখানে পৌঁছতে হলে আর অনেক গাছের তলা দিয়ে যেতে হবে। তার মধ্যে আবার যদি কোনও গাছের ডাল ভেঙে পড়ে!

অগত্যা আমরা বাগানের কুঁড়েঘরে গেলাম না। গেলাম পাশেই আমাদের খামারবাড়ির কুঁড়েঘরে। ঝড়ের গতি তখন আরও বেড়েছে। তাতে খামারবাড়ির কুঁড়েঘরটা এমন দুলছে যেন মনে হচ্ছে এই ঝড়ে বুঝি এক্ষুনি উড়ে যাবে। সেখানে আমাদের পাইট-মুনিষদের সঙ্গে খলিলদাদো ছিলেন। তিনি ঝড়ের গতিপ্রকৃতি বুঝে বললেন, তোরা সব কুঁড়্যার খুঁটিগুলানকে চেপে ধর। বলেই তিনি আজান দিতে শুরু করলেন। আমাদের এই অঞ্চলে মুসলিম সমাজে বিপদ তাড়াতে ‘আজান’ দেওয়ার রীতি প্রচলিত। তো যাইহোক, আমরা যে যেমনভাবে পারলাম কুঁড়েঘরের খুঁটি চেপে ধরলাম। আমাদের মধ্যে সাহাবাদের মুলিকাকাও ছিলেন। আমাদের মাঠে তাঁর জমি ছিল। তাঁর সেই জমির চৈতালি আবার আমাদের খামারেই উঠত। দেখি মুলিকাকাও আর সবার সঙ্গে একটা খুঁটি চেপে ধরেছেন। মুখে বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। এসবের মধ্যে দেখি আমাদের ডোমকুল মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোন থেকে বেশ বড় আকারের কালো গোলাকার কী একটা প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসছে। মনে হল সেটা যেন আমাদের কুঁড়েঘরটির দিকেই ধেয়ে আসছে। আমাদের পিষে মারতে। কিংবা উড়িয়ে নিয়ে যেতে। আমরা খুব ভয় পেলাম।

‘জনতা কার্ফিউ’-এর দিন ধরলে আজ দশ দিন আমরা গৃহবন্দি রয়েছি। নিজে বেঁচে থাকার জন্য। অন্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এককথায় মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কতটা সফল হব, সময় তার উত্তর দেবে। সরকারি নির্দেশ মেনে অন্তত আরও দু-সপ্তাহ আমাদের এভাবেই থাকতে হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।

প্রশ্ন সেটা নিয়ে নয়, প্রশ্ন হল এই বিপদেও আমাদের মনের সুপ্ত সাম্প্রদায়িক বিষ কী অবলীলায় ঝরে পড়ছে আমাদের চারপাশে তা নিয়ে। করোনা আজ আছে, কাল থাকবে না। কিন্তু আমাদের মনের এই বিষ! তার কী হবে? এই যে নিজামুদ্দিনের ঘটনা। খবরে শুনছি, বারবার শুনছি লকডাউন ভেঙে ওই ধর্মীয় জমায়েত হয়েছিল। কিন্তু সত্যি কি তাই?

আসুন একটু ক্রোনোলজি বোঝার চেষ্টা করিঃ

১২ ফেব্রুয়ারি, রাহুল গান্ধী ট্যুইট- ভারতের ওপর করোনা অত্যন্ত বড় বিপদ হয়ে আসছে।

১৩ মার্চ, স্বাস্থ্যমন্ত্রক জানাল করোনা ভাইরাস হেলথ্‌ ইমারজেন্সি নয়।

১৩ মার্চ, দিল্লির নিজামুদ্দিন মার্কাজে ৪০০০ জন সদস্য নিয়ে তাবলীগি জামায়াত আরম্ভ।

১৫ মার্চ, তাবলীগি জামায়াত শেষ।

১৬ মার্চ, হিন্দু মহাসভার করোনা রুখতে গোমুত্র পার্টির আয়োজন।

১৬ মার্চ, দিল্লি সরকারের সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ জারি।

১৭-১৮ মার্চ, ৪০০০০ জন তীর্থযাত্রীর জমায়েত তিরুপতি মন্দিরে।

১৯ মার্চ, প্রধানমন্ত্রীর জনতা কার্ফিউ ঘোষণা। তিরুপতি মন্দির বন্ধ।

২২ মার্চ, জনতা কার্ফিউ পালন ও তালি-থালি, কাঁসর-ঘণ্টা, শঙ্খ বাদন। [যদিও বিকেল থেকে রাত্রি পর্যন্ত সেটা পটকা সহযোগে এমনই বিশৃঙ্খল রূপ ধারন করে যা সব রকম সীমা ছাড়িয়ে যায়।]

২৫ মার্চ, সারা ভারত লকডাউনের নির্দেশ। অথচ ওই নির্দেশ অমান্য করে যোগী আদিত্যনাথের রামলালা যাত্রা। শুধু তাই না, ওইদিন উত্তরপ্রদেশের ‘মা আদি শক্তি’ নামের এক সাধিকা মায়ের ১০০ জন শিষ্যকে নিয়ে তলোয়ার হাতে জমায়েত প্রদর্শন।

৩০ মার্চ, সরকারের উদাসীনতায় ২৫ জন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু।

৩০ মার্চ, দিল্লির নিজামুদ্দিন মার্কাজে অংশগ্রহনকারী জামায়াতির মৃত্যু। এবং গোদী মিডিয়া থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার মুসলিম তীর্থযাত্রীরাই করোনা ছড়িয়েছে সারাদেশে।

ক’দিন আগে আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় সব্জিবাজারের ভিড়ের ছবি পোস্টিয়ে মানুষকে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার দোষে দুষছি। শুধু তাই না, পরিযায়ী শ্রমিক যাঁরা কাজ হারিয়ে কোনও রকমে বাড়ি এসে পৌঁছেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আমরা নোংরা কথাবার্তা বলছি, প্রশাসনকে ব্যবহার করে তাঁদের অপমান করছি। তারপর বাড়ি থেকে যেভাবে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, যেন তাঁরা অপরাধী। এছাড়াও দেখছি হাওড়া-শিয়ালদা-ধর্মতলা-দিল্লি-মুম্বাই-চেন্নাই থেকে বাড়ি ফেরার জমায়েত। যা দেখে আমাদের মতো ভদ্রলোকেরা ছিঃ ছিঃ করছি। আর মাথা চাপড়াচ্ছি। এই বুঝি ওরা সব ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের মেরে ফেলতে করোনা বয়ে আনছে। তাই প্রশাসন যখন আটক পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর বিষাক্ত ওষুধ স্প্রে করছে, আমরা ঘরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছি।

আসলে আমরা এমনই। এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। আজকেও হচ্ছে। এই তো কিছুদিন আগে যে আমরা জনতা-কার্ফিউ মেনে কাঁসর-ঘণ্টা-শাঁখ-থালা-বাসন-শঙ্খ বাজিয়ে মিছিল করে স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্দেশ্যে অভিবাদন জানিয়েছি, সেই আমরাই আবার ওই স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি থেকে বিতাড়নের নোটিশ ধরিয়েছি।

যাকগে সেসব। এমন তো কতই হয়! আসুন আবার সেই আমার ছেলেবেলার ঝড়ের গল্পে ফিরে আসি। খলিলদাদোর আজান, মুলিকাকার মন্ত্রপাঠ এবং আমাদের খুঁটি চেপে ধরে রাখার ফলে কুঁড়েঘরটা সে যাত্রায় বেঁচে গেল। সেই গোলাকার ‘কী একটা’ আমাদের দিকে ধেয়ে এল না, আমাদের পাশ কাটিয়ে ডোমকুল মাঠের বুক চিরে চলে গেল দক্ষিণ-পূর্ব কোনের দিকে। আমাদের কুঁড়েঘর এবং আমরা অক্ষত রয়ে গেলাম। আমরা নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্ত ওই ‘কী একটা’ যেদিকে ধেয়ে গেল শেষপর্যন্ত সেদিকে কী ঘটল তা নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা রইল না।

আজ দেখলাম ফেসবুকে এক বন্ধু লিখেছেন- “আমরা প্রায় সবাই স্বভাবগত মুখোশধারী। তারপরও মাস্কের জন্য এত হা পিত্যেশ কেন?”

সত্যিই ...

তথ্যসূত্র : সুমন সেনগুপ্ত

0 Comments

Post Comment