রেলস্টেশনে ঘুরে ঘুরে সই সংগ্রহ করছিল একদল অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে। সামনে এসে দাঁড়ালে দেখা গেল এক পরিচিত বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কর্মী ওরা, স্বাক্ষর চাইছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনার দাবির সমর্থনে। চরম বিস্মিত হলুম। একটি দেশের বা একটি রাজ্যের শিক্ষানীতি মত মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ও কি তবে গণভোটের দ্বারা নির্ধারিত হবে?
সই চাইতে আসা ছেলেটিকে প্রশ্নটি করতেই রে রে করে উঠল সে – ‘এই পাশ-ফেল তুলে দেবার জন্য বাচ্চারা পড়াশুনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এর ফলে কিচ্ছু না পড়েও সব পরের ক্লাসে চলে যাচ্ছে। শিক্ষার হাল খুবই খারাপ হয়ে যাচ্ছে’ ইত্যাদি একগাদা মুখস্থ করা কথা বক্তৃতা দেবার ঢঙে আউরে গেল। সবই পরিচিত বস্তাপচা বুলি, রাস্তাঘাটে হামেশাই যা লোকজনের মুখে শোনা যায়। পালটা প্রশ্ন করতেই হল, ‘ক’জন শিক্ষাবিজ্ঞানীর মতামত তোমরা নিয়েছ ভাই? শিক্ষা ব্যাপারটা যাঁরা বোঝেন, তাঁরা এ বিষয়ে কী বলছেন তা জানার চেষ্টা করেছ?’ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে বাঁচাতে তখন এগিয়ে এলেন তারই দাদা-স্থানীয় এক কর্মী, যিনি সেই স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজটি তদারক করছিলেন। তিনি বিনীতভাবেই বললেন, ‘আমরা কিন্তু অনেক স্কুলশিক্ষকের সঙ্গেও কথা বলেছি। তাঁরা কিন্তু প্রায় সকলেই চাইছেন যে পাশ-ফেল ফিরে আসুক’।
হেসে বললাম, ‘আবারও ভুল করলেন ভাই। আমি শিক্ষাবিজ্ঞানীদের মতামত চেয়েছি। শুনতে খারাপ লাগলেও একটা উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। আমি ইঞ্জিনিয়ারের মতামত চাইছি, আপনি মেকানিকের মতামত তুলে ধরছেন। ‘চিকিৎসা-বিজ্ঞানী’ বলতে কি আপনি ‘ডাক্তার’-কে বোঝেন?’ বলাই বাহুল্য, এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর ছেলেটির কাছে ছিল না। থাকার কথাও নয়, যে কোন রাজনৈতিক দলের কর্মীই সচরাচর পার্টি লাইনের ‘পাখি পড়া’ বুলির বাইরে কিছু জানেন না, জানতে চানও না।
মুশকিল হল, ‘শিক্ষাদান’ যে রীতিমত একটা বিজ্ঞান, তা আমাদের চারপাশের বেশিরভাগ মানুষ – মানা তো দূরের কথা – জানেনই না। আমাদের পাড়ার চায়ের দোকানে বসে থাকা রামা-শ্যামাদের মতই আমাদের রাষ্ট্রনেতারাও আজও মনে করেন যে, মাস্টারমশাই চক-ডাস্টার আর বেত হাতে ক্লাসে আসবেন, লেকচার দেবেন, পড়া ধরবেন, পড়া না পারলে দেদার পিটোবেন, আর বছর শেষে পরীক্ষায় ফেল করলে ‘তোর দ্বারা কিস্যু হবে না, যা রিক্সা চালা গিয়ে’ বলে ছাত্রের ভবিষ্যেরও দিক-নির্দেশ সেরে দেবেন। ব্যস, পড়ানোর জন্য এর বেশি আবার কী প্রয়োজন!
এই মানুষগুলিকে কোনোদিনই বোঝানো সম্ভব নয় যে, যেকোনো বিজ্ঞানের মতই শিক্ষাদানের পন্থা-পদ্ধতি নিয়েও সারা পৃথিবী জুড়ে গবেষণা চলছে। যে কোনো বিজ্ঞানের মতই তাতেও প্রতিনিয়ত অনেক ধারণা বাতিল হচ্ছে, যুক্তও হচ্ছে অনেক নতুন আইডিয়া। এবং, সারা পৃথিবীর তাবৎ শিক্ষাবিজ্ঞানের কেতাব তন্ন তন্ন করে খুঁজেও দুটো বিষয়ের সমর্থনে একটা বাক্যও পাওয়া যাবে না। বিষয় দুটো হল-- এক. করপোরাল পানিশমেন্ট বা শাস্তি এবং দুই. পাশফেল।
এই দুটিই সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক, চরম ক্ষতিকর এবং সাদা বাংলায় কুসংস্কারের মত সর্বার্থে পরিত্যাজ্য ধারণা। আমাদের রাজ্যে শিক্ষকতার পেশায় আসার জন্য শিক্ষাবিজ্ঞানের পাঠ নেওয়া বাধ্যতামূলক। বি.এড, ডি.এল.এড আদি ডিগ্রিগুলো সবই শিক্ষাবিজ্ঞানের পাঠক্রম। বিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই সেই পাঠক্রমেও প্রায়শই নানা সংশোধন ও পরিমার্জনও করা হয়। আপনি মানুন আর না-মানুন, শিক্ষাদান কিন্তু একটা অত্যন্ত কঠিন ও জটিল প্রক্রিয়া। তার জন্য নির্দিষ্ট বিষয়ের পাশাপাশি সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, কথনশৈলি, বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপন কৌশল, জনসংযোগ ইত্যাদি অনেক অনেক বিষয়ে অল্পবিস্তর জানতে হয়। এমনকী এই ‘জানা’-গুলো শুধুমাত্র পুঁথিগত হলেও চলে না। প্রায়োগিক (প্রাকটিক্যাল) জ্ঞানটিও সমান জরুরি। সেই কারণেই বি.এড বা ডি.এল.এড করার সময় তাই প্রত্যেকটি হবু-শিক্ষককে কোনো না কোনো স্কুলে গিয়ে কিছুদিন প্রাকটিস টিচিং করতে হয়।
কিমাশ্চর্যমতঃপরম, আদ্যন্ত শিক্ষা-বিজ্ঞান নির্ভর এই বি এড বা ডি.এল.এড কোর্স করে আসার পরও এ রাজ্যের অধিকাংশ শিক্ষক পাশ-ফেল বা করপোরাল পানিশমেন্টকে শিক্ষাদানের জন্য আবশ্যিক বলে মনে করেন। কেন করেন?
উত্তরটা আসলেই লুকিয়ে আছে কিছু নিবিড় কায়েমী স্বার্থের জটিল আবর্তের মধ্যে। ‘পথের পাঁচালি’-তে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, প্রসন্ন গুরুমশায় তার শিক্ষাদানের যাবতীয় উপকরণের অভাব বেত দিয়েই পূরণ করতেন। একালের প্রসন্ন গুরুমশায়রাও তেমন তাদের যাবতীয় ফাঁকিবাজি, অকর্মণ্যতা ঢাকতে কিছু বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে যাওয়া লব্জ ব্যবহার করে চলেছেন বছরের পর বছর ধরে। তেমনি কয়েকটা লব্জ হল, ‘প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া’, ‘বাড়িতে পড়ে না’, ‘ফেলের ভয় না থাকলে কেউ পড়াশুনা করে না’, ‘শাসনের ভয় (পড়ুন লাঠির বাড়ি) না থাকলে কেউ পড়াশুনা করে না’ ইত্যাদি প্রভৃতি।
রাষ্ট্রীয় স্তরে অবিশ্যি এই পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনার কারণটা কিঞ্চিৎ ভিন্ন। আমাদের সমাজ এবং সমাজানুসারী রাষ্ট্র আজও মারাত্মক রকম ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক, মনুবাদী। প্রমাণ হিসেবে হয়তো এইটুকু বলাই যথেষ্ট হবে যে রাজনীতি থেকে শুরু করে কর্পোরেট সেক্টর – সর্বত্রই আজও সেই তথাকথিত উচ্চবর্ণীয়দেরই আধিপত্য। সেই আধিপত্য কখনোই নিজেকে খর্ব করতে চায় না। তার জন্য সবার আগে দরকার শিক্ষার ক্ষেত্রটাতে সেই আধিপত্যকে সর্বার্থে কায়েম রাখা এবং নিজেদের শ্রেণির বাইরে বাকিদের যতদূর সম্ভব তার বাইরে সরিয়ে রাখা। তার জন্যই ফাঁদা হয় মেধার গল্প, তার জন্যই তৈরি করা হয় পাশ-ফেলের মানদণ্ড, তার জন্যই লাঠি চালানো হয় ডাইনে-বাঁয়ে।
আরে বাবা সবাই যদি পড়াশুনা শিখে ফেলে, তাহলে স্বল্প মজুরিতে সোনার কাজ, জরির কাজ, আপেল বাগানের কাজ, সিকিউরিটি গার্ডের কাজ, পাহাড় ফাটিয়ে টানেল বানানোর কাজের শ্রমিকের জোগানটা আসবে কোত্থেকে! সবাই যদি শিক্ষিত হয়ে যায় তাহলে তো সবাই প্রশ্ন করতে শিখে যাবে, বিনা প্রশ্নে মানতে চাইবে না কিছুই। এবং সবথেকে বড় ব্যাপার, দলবেঁধে কেড়ে নিতে আসবে নিজেদের অধিকার। কারণ শিক্ষা, শিক্ষা এবং শিক্ষাই হল যাবতীয় শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তির একমাত্র পথ।
অতএব কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে ফিরিয়ে আনা হল পাশ-ফেল, অতএব রাজ্য-সরকারও জনগণেশের দাবিকে মান্যতা দিয়ে প্রতিবছর অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষার অঙ্গন থেকে ঘাড় ধরে বিদেয় করার ব্যবস্থা পাকা করল আবার।
আমাদেরই তো ব্যবস্থা, আমরা যদি নিজেদের আখেরটুকু গুছিয়ে না নিই, তাহলে চলবে কীভাবে বলুন!