মনে পড়ে, আমি তখন ছোট, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, একবার বাবা কলকাতায় কোনো কাজে গেলে সঙ্গে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ‘কলকাতা’ দেখাবে ব’লে। হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে আমি “পানি খাব” বলতেই বাবা আমাকে সারি সারি পানীয় জলের ট্যাপের সামনে নিয়ে গিয়ে আঁজলা ভ’রে জল খাইয়ে দিচ্ছিল, আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম সামনের লেখাটা—“পানীয় জল”। আমি ভেবেছিলাম, মুসলমান আর হিন্দু মিলে এখানে জল খায় ব’লে পানি ও জল দুটোই লেখা আছে। অদ্ভুতভাবে বানানের ব্যাপার মাথা থেকে উধাও হয়ে পানি ও জল মুসলমান-হিন্দু বরাবর দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। পরে যখন মানুষ-সমাজ-সম্পর্ক এসব নিয়ে একটু একটু ক’রে বুঝতে শুরু করেছিলাম, বুঝেছিলাম, তখনকার সমাজ-পরিবেশের ছাপটাই ছিল আমার ওরকম ভাবনার মূলে।
মানুষের সমাজ সতত এরকমই হয়। ধর্ম নিজের নিজের থাকে, কিন্তু ধর্মীয় সংস্কৃতি সব সময় পৃথক থাকতে পারে না। দৈনন্দিন জীবনপ্রণালি, সামাজিক যোগাযোগ, মনন মানুষকে যেমন একক সত্তায় থিতু হতে দেয় না, তেমনি ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে এক উন্মুক্ত সামাজিক সম্পর্কে জড়িয়ে নেয়। এরপরও ভেদবুদ্ধি যা-কিছু সমাজকে বিদীর্ণ করে, সেসব আরোপিত।
“জলের উপর পানি, না পানির উপর জল/ বল্ খোদা বল্ খোদা বল্”—এরকম বিতণ্ডা যদি পণ্ডিতদের মধ্যে নিরন্তর চলে, ক্ষতি নাই। সেসবকে শাস্ত্রতত্ত্ব-বিলাস ব’লে মুখ ঘুরিয়ে থাকাই যায়। মানুষের সরল-স্বাভাবিক মিলজুল-সম্পর্কের সব কালেই এরকম বিতণ্ডা ছিল। কিন্তু এই বিতণ্ডা যখন মানুষের জীবনপ্রণালির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার তাল করা হয়েছিল, গোল বেধেছিল তখনই। সেক্সপীয়রের নাটকের সংলাপে পাই—“নামে কী আসে যায়?” যদি সাদাকে সাদা, কালোকে কালো ব’লেই দেখা হয় অথবা দেখাতে চাওয়া হয়, তা হ’লে নামে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু বিপরীত-বুদ্ধিতে আসে যায় বৈকি। আমাদের দেশে এখন সেরকমই রাজনীতির বিভেদ-রঙ্গে নাম-মাহাত্ম্যের পরাকাষ্ঠা দেখছি । মোগলসরাই জংশনের নাম বদলে করা হয়েছে দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশন, এলাহাবাদ হয়েছে প্রয়াগরাজ, রাষ্ট্রপতি ভবনের সম্মুখবর্তী মুঘল উদ্যান হয়েছে অমৃত উদ্যান। মহারাষ্ট্র সরকার দু’টি জায়গার নাম বদলের জন্য কেন্দ্র সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। অতি সম্প্রতি সেই অনুমোদন মেলার পর ঔরঙ্গাবাদ হ’ল ছত্রপতি সম্ভাজিনগর ও ওসমানাবাদ হ’ল ধারাশিব।
নাম বদলে দেওয়া হয়েছে অথবা বদলাতে চাওয়া হচ্ছে এমন সব জনপদ, শহর বা স্মারকের, যেগুলি ভারতে মুসলমান শাসনকালের ইতিহাস বা কীর্তিকে সূচিত করে। এভাবে নাম বদল নিয়ে প্রতিবাদ হচ্ছে সাধারণ নাগরিকদের থেকে ও ইতিহাসবিদদের থেকে। ওদিকে পাল্টা দেখা গেল, সম্প্রতি বিজেপি নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায় শীর্ষ আদালতে আর্জি জানিয়ে বসলেন, যাতে শীর্ষ আদালত এরকম নাম বদল করার উদ্দেশ্যে ‘কমিশন ফর রিনেমিং’ গঠন করে দেয়। গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি শীর্ষ আদালত সেই আর্জি খারিজ ক’রে দিয়েছে। বোঝাই যায়, নাম বদল নিয়ে প্রতিবাদের ঝাঁঝে কেন্দ্র সরকার ও সহযোগী সরকারগুলো বড়ই বিড়ম্বিত ছিল। সেজন্য আদালতকে দিয়ে নাম বদলের সঠিকতা জাহির করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
ভারতের মুসলমান শাসকদের হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি শত্রু-ভাবাপন্ন হিসেবে দেখানো, হিন্দু সংস্কৃতি ও ইসলামীয় সংস্কৃতির মধ্যে ভেদ ও অসাদৃশ্যকে অভেদ্য হিসেবে দেখাতে ইসলামীয় সংস্কৃতিকে কালিমালিপ্ত করা, এসব এখন হিন্দুত্ব চর্চার নিরন্তর কর্মকাণ্ড। ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসেও তার কোপ পড়েছে। ইউজিসি-র ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে মুঘল আমলকে একপ্রকার বাদই দেওয়া হয়েছে। আছে শুধু সম্রাট বাবরের প্রসঙ্গ, যেখানে কার্যত তাঁকে হানাদার হিসেবে দেখানো হয়েছে। নাম বদল এই কর্মকাণ্ডের অঙ্গ। এভাবে ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে মুছে ফেলতে চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস তো কারোর মর্জির ব্যাপার নয়। খণ্ডিত ইতিহাস আদতে ইতিহাসই নয়। কোনো জাতি খণ্ডিত ইতিহাস নিয়ে চলতে গেলে তার যাত্রাপথটাই অনির্দিষ্ট হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে সেই জাতির যে ইতিহাস লেখা হবে, তা হবে ব্যর্থতার ইতিহাস।
প্রশ্ন হ’ল, ইতিহাসকে কীভাবে দেখা হবে। আমরা যখন দেখি, এক কালের ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম বদলে করা হয়েছে বিনয়-বাদল-দীনেশ(বিবাদী) বাগ, তখন আমাদের সামনে এই তিন স্বাধীনতা সংগ্রামীর আত্ম-বলিদানের গৌরবই প্রতিভাত হয়। এই রকম নাম বদল দেশের ইতিহাসের গৌরবকে সূচিত করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ও সহযোগী সরকারগুলো যেরকমভাবে নাম বদলে হাত লাগিয়েছে, তাতে উল্টোটাই করা হচ্ছে—ইতিহাসের গৌরব বা প্রাসঙ্গিকতাকে ছেঁটে দিতে চাওয়া হচ্ছে। এজন্য তাদের উৎসাহের উৎস হ’ল একদেশদর্শিতা ও বিভাজনের রাজনীতি।
তাদের নাম বদলের কীর্তিকলাপ শুধু তাদের অনুগামীদের মধ্যেই কীর্তি হাসিল করছে না, অন্যত্রও তার ছোঁয়াচ লাগছে। কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে ২০২৩-এর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে এই বাংলার এক শিল্পী ‘পানি’ আর ‘দাওয়াত’ (আমন্ত্রণ) শব্দ দু’টি নিয়ে খানিক (ভেদ)জ্ঞান বিতরণ করেছেন, দেখলাম। তিনি বলেছেন, বাংলা ভাষা ও বাঙালির সংস্কৃতিতে এই রকম শব্দ নাকি অবাঞ্ছিত। ‘পানি’ সংস্কৃত থেকে আসা নামশব্দ, ‘দাওয়াত’ আরবি থেকে নেওয়া। তাই বহিরাগত বিধায় মুখের ভাষা নিয়ে তিনি যা বলেছেন, তা প্রকৃতই ভাসা-ভাসা। ভাষা একটি সংস্কৃতি, মানুষের সকল সংস্কৃতির মধ্যে সেরা। ভাষা সংস্কৃতির বাহকও বটে। সংস্কৃতির গুণেই ভাষা পড়শি ভাষার সঙ্গে আদান-প্রদানে মিলিত হয়। ভাষা প্রবহমান। তাই এই আদান-প্রদান অবিরাম। ওই নামটা অবাঙালি-অবাঙালি, ওই শব্দটা বাংলায় অচল—এভাবে শব্দ-ভাণ্ডারকে কাটা-ছেঁড়া করা যায় না।
শিল্পী হ’য়ে ভাষার এই শিল্প-তুল্য শৈলী বোঝেন না, এটা না-হওয়ারই কথা। কিন্তু ‘আরাম’দায়ক ‘কুর্সি’তে ব’সে ‘আয়াস’ ভ’রে ‘কাগজ’-‘কলম’-তুলি নিয়ে তাঁর ‘কারবার’। ‘ইনামে’ তিনি ‘দেদার’ ‘খুশী’ হন। এখন হীরে-‘জহরতের’ মোহে তিনি কি বিভেদ-বোদ্ধাদের ‘মোসাহেবি’ ‘শুরু’ করলেন? অপর ভাবনার আড়াল নিয়ে তিনি আসলে যেটা বলতে চেয়েছেন, তা তো এই যে, দু’টি শব্দই এই বাংলায় বাঙালিদের মধ্যে মুসলমান সমাজে চলে। মানে মুসলমান-আরবী-ফারসী—এই ছকে ভেদবুদ্ধির চালাকি। এই অনুচ্ছেদে উদ্ধৃতি চিহ্ন দেওয়া শব্দগুলো সহযোগে যে-কথা বলতে চেয়েছি, আশা করি, তা স্বচ্ছন্দে প্রকাশ করতে পেরেছি। এই শব্দগুলোর মধ্যে আরাম, কারবার, দেদার ও খুশী এসেছে ফারসী থেকে, বাকিগুলো এসেছে আরবী থেকে। এরকম আরও অজস্র আরবী-ফারসী শব্দ বাংলা ভাষায় সাদরে গৃহীত হয়েছে। এভাবে ভাষাকে বাহক বানিয়ে বিভেদের যে ভাষ্য তিনি রচনা করতে চাইছেন, তাতে তো ভাষাটাই ভেসে যাওয়ার উপক্রম হবে।
নাম বদলের এই কর্মকাণ্ড নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ তো আছেই, পাশাপাশি শীর্ষ আদালতের এই প্রশ্নে সদর্থক ভূমিকা কিছু আশার সঞ্চার করে। তথাপি আমরা ভুলতে পারি না যে, নাম বদল নিয়ে বিভেদকামীদের দৌড় বেশ লম্বা। আমরা স্মরণ করতে পারি, ২০২১-এর ১৭ই ডিসেম্বর থেকে তিন দিন ধ’রে হরিদ্বারে একটি হিন্দু ধর্ম সংসদ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ধর্ম সংসদে দেশের মুসলিমদের নির্মূল করার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। সেখানে সদর্পে উপস্থিত ছিলেন অশ্বিনী উপাধ্যায়, যিনি ‘কমিশন ফর রিনেমিং’-এর আর্জি নিয়ে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।